অতিথি লেখক: রউফুল আলম
লেখক ও গবেষক
ইমেইল: [email protected]
আজ থেকে মাত্র চার দশক আগে চীনের গবেষণা ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনের সংস্কৃতি এতটা অগ্রসর ছিল না। চীনের অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়তেন। তাঁদের বেশির ভাগই নিজ দেশে ফিরতে চাইতেন না। চীন সরকার এই অবস্থার পরিবর্তন করতে চেয়েছে। ফলে প্রতিটি প্রদেশে তারা গড়ে তুলেছে বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র (স্টেট কি ল্যাবরেটোরিজ-এসকেএল) এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধুনিক গবেষণার ওপর জোর দিয়েছে।
চীনে বর্তমানে পাঁচ শতাধিক স্টেট ল্যাবরেটরি আছে। আমার অনেক চীনা সহকর্মী এই পরিবর্তনের জন্য টেং সিয়াওপিংকে কৃতিত্ব দেন। টেং সিয়াওপিংকে অনেকেই আধুনিক চীনের স্থপতি মনে করেন।
২০১৮ সালে চীনের সিয়ান জিয়াওতং বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই একটি বিজ্ঞান সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য। আমি তখন আমেরিকার আইভি লিগ প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করছিলাম। সিয়ান জিয়াওতং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার সুযোগ-সুবিধা দেখে আমি খুবই বিস্মিত হই।
আমেরিকার বহু প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সেখানে গবেষণার সুযোগ-সুবিধা ছিল অনেক বেশি। অনেক ব্যয়বহুল অবকাঠামো ওরা তৈরি করে রেখেছে। আর সারা পৃথিবী থেকে বাছাই করে সেরাদের সেরা তরুণ গবেষকদের সেসব প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে।
২০০৮ সাল থেকে চীন সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ প্রকল্প শুরু করে। সহস্র মেধাবী প্রকল্প বা থাউজেন্ড ট্যালেন্ট প্ল্যান নামে সেটি পরিচিত। এই প্রকল্পের অধীন, তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তরুণ গবেষকদের চীনে ফেরানো হয়। তাঁদের উচ্চ বেতন-ভাতা ও গবেষণার জন্য ফান্ড দেওয়া হয়।
পিএইচডি এবং পোস্ট ডক গবেষণার মান, পাবলিকেশন ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে ৩০-৩৫ বছর বয়সী তরুণ গবেষকদের সরাসরি প্রফেসরশিপও দেওয়া হতো। শুধু গত ১০ বছরেই চীনের গবেষণা ও আবিষ্কার-উদ্ভাবনের সংস্কৃতি আগের চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে। সহস্র মেধাবী প্রকল্প, সেই সমৃদ্ধির একটি বড় কারণ।
অনুরূপ প্রভাব আমি ভারতেও লক্ষ্য করেছি। বিশেষ করে ভারতের আইআইটিগুলো বিশ্বমানের গবেষণা করে। প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয়ভাবে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন তরুণ তৈরি করছে। যেটি তাদের বিনিয়োগব্যবস্থাকে টেকসই করছে। স্থানীয় উদ্যেক্তা তৈরিতে সাহায্য করছে। ভারতের একাডেমিক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল গবেষণার সংস্কৃতিকে অনেক শক্তিশালী করছে।
মুম্বাই আইআইটির একজন অধ্যাপকের নাম দেবব্রত মাইতি, বাঙালি ও বয়সে তরুণ। দেবব্রত মাইতি, শুধু ভারতের নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে নামকরা অর্গানিক কেমিস্ট। অধ্যাপক মাইতি, জন হপকিন্সে পিএইচডি করেছেন। অধ্যাপক বাকওয়াল্ড নামের একজন নামকরা গবেষকের অধীন পোস্ট ডক করেছেন। দেবব্রত মাইতির সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১১-১২ বছর আগে। স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে।
অধ্যাপক মাইতি, পোস্ট ডক শেষে আমেরিকা থেকে ফিরে ভারতে গিয়ে কাজ শুরু করেন। তাঁর কাজের মান এবং গতি অভাবনীয়। তাঁর ল্যাবে তৈরি হচ্ছে সেরা অর্গানিক কেমিস্ট। ওষুধশিল্প, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিসহ বহু শিল্পে ভারত পৃথিবীতে এখন এগিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে এই মাইতির মতো অধ্যাপকেরা অনেক বড় ভূমিকা রাখছেন।
অধ্যাপক মাইতি পিএইচডি-পোস্টডকের সময় যে মানের পাবলিকেশন করেছেন, বাংলাদেশের অনেক তরুণ সে মানের পাবলিকেশন করেন। তিনি বিদেশে যে মানের অধ্যাপকদের সঙ্গে কাজ করেছেন, বাংলাদেশের অনেক তরুণ সেই মানের অধ্যাপকদের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি ভারতে ফিরে যত কাজ করেছেন, বাংলাদেশি কোনো মেধাবী তরুণ দেশে ফিরে গেলে, তাঁর অন্তত ৫ ভাগ কাজও করতে পারতেন; কিন্তু বাংলাদেশি একজন তরুণের বেলায় বিষয়টা অধ্যাপক মাইতির মতো সহজ নয়!
বাংলাদেশি একজন তরুণ, দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার পথটাই আজও সুগম হয়নি। দেশের কোনো ভিসি কি কখনো ট্যালেন্ট হান্টের উদ্যোগ নিয়েছেন? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো একজন প্রভাষক কিংবা সহকারী অধ্যাপককে বিদেশে পাঠায় পিএইচডি ডিগ্রির জন্য। অথচ যথারীতি পিএইচডি-পোস্ট ডক আছে এমন কাউকে নিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানায় না। দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও একই নিয়ম। ৫৪ বছর ধরে চলে আসা এই রীতির পরিবর্তন তো কখনো না কখনো করতেই হবে।
কারণ, অধ্যাপক মাইতি ফিরে যাওয়ার মতো একটি পরিবেশ পেয়েছেন। সঙ্গে পেয়েছেন কাজ করার একটি সেটআপ। তাঁদের মতো মানুষদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য আইআইটিগুলো ট্যালেন্ট হান্ট করে। তরুণেরা ফিরে গিয়ে ফান্ডের জন্য আবেদন করেন। সরকার সামর্থ্য অনুযায়ী ফান্ড দেয়। একটা ইকো সিস্টেম দাঁড়িয়েছে। দেবব্রত মাইতি জানতেন, আমেরিকায় না থেকে ভারত ফিরে গেলে, তাঁর দেশকে অনেক কিছু দিতে পারবেন। কারণ, আমেরিকা থেকে ১০ জন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীও যদি অন্যত্র চলে যান, আমেরিকার তেমন কিছুই হবে না। আমেরিকার গবেষণা ও উদ্ভাবনের সংস্কৃতি এত সমৃদ্ধ।
বাংলাদেশি একজন তরুণ, দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার পথটাই আজও সুগম হয়নি। দেশের কোনো ভিসি কি কখনো ট্যালেন্ট হান্টের উদ্যোগ নিয়েছেন? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো একজন প্রভাষক কিংবা সহকারী অধ্যাপককে বিদেশে পাঠায় পিএইচডি ডিগ্রির জন্য। অথচ যথারীতি পিএইচডি-পোস্ট ডক আছে এমন কাউকে নিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানায় না। দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও একই নিয়ম। ৫৪ বছর ধরে চলে আসা এই রীতির পরিবর্তন তো কখনো না কখনো করতেই হবে।
আজ ভারত, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের প্রশিক্ষিত ও দক্ষ প্রবাসী তরুণদের মধ্য থেকে সেরাদের সেরাকে বাছাই করে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং এর সুফল ওরা পাচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হলেও স্থানীয় দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা অনিবার্য। দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকে দুর্বল করে রেখে দুনিয়ার কোনো দেশ বিশ্বমানের পর্যাপ্ত দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারেনি। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে পারেনি। টেকসই বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে পারেনি।
বাংলাদেশের অনেক গবেষক, উদ্ভাবক, শিক্ষক, উদ্যেক্তা পৃথিবীর বহু দেশে সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। যাঁদের অনেকেই দেশে ফিরে অবদান রাখতে চান। দেশের জন্য কিছু করতে চান। তাঁদের মধ্য থেকে বাছাই করে সেরা মানুষদের ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিজ্ঞান গবেষণাগারে নিয়োগ দিতে হবে। তাহলে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সংস্কৃতিতে সুফল আসবে। ভবিষ্যতে অনেক মেধারী তরুণেরা দেশে ফেরার আগ্রহ পাবেন। অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে ট্যালেন্ট হান্ট করতে হবে এখনই! বর্তমান সরকার কি এমন একটি রাষ্ট্রীয় প্রকল্প দ্রুত শুরু করবেন?
তথ্যসূত্র:
এই লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিনের প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে সংগৃহীত।
লেখক: ড. রউফুল আলম, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।
Leave a comment