কলাম

কলাম: চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়!

Share
Share

প্রফেসর ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের শেষ বয়স ৩০ বছর এবং অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯ বছর। এ নিয়ম দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত, যা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি—বিশেষ করে করোনাভাইরাস মহামারি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চাকরির বাজারে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। এর ফলে দেশের উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই দাবি করছেন যে, চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২, ৩৪, বা ৩৫ করা উচিত। তবে এই বয়সসীমা বৃদ্ধি করলে দেশ ও জাতির জন্য যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে, তা গভীরভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন।

সমস্যা ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ

১. উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের সংকট:

দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার নয়, লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করে বের হচ্ছেন। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারি খাতে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। এই বেকারদের অনেকেই সরকারি চাকরির অপেক্ষায় থাকেন, যেখানে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ হারিয়ে ফেলেন, ফলে হতাশা বাড়ে এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যান।

2. করোনা মহামারির প্রভাব:

মহামারি করোনার কারণে বিগত কয়েক বছরে অনেক চাকরির পরীক্ষা এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত বা বাতিল হয়েছে। এর ফলে, যারা চাকরির শেষ বয়সের কাছাকাছি ছিলেন, তাদের জন্য সমস্যা আরও বেড়েছে। মহামারি শুধু স্বাস্থ্য খাতেই নয়, অর্থনৈতিক খাতেও মারাত্মক আঘাত হেনেছে, যা বেকারত্বের হারকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

3. রাজনৈতিক অস্থিরতা:

দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিভিন্ন সেক্টরে স্বচ্ছতার অভাবও বেকারত্বের একটি বড় কারণ। অনেক সময় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীরা নিয়োগ পরীক্ষায় সুযোগ হারান, যা বেকারত্বকে আরও সংকটময় করে তোলে।

4. চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর প্রস্তাবের সমস্যা:

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বা ৩৫ বছর করা হলে তা কেবল সাময়িকভাবে সমস্যার সমাধান হতে পারে। এতে আরও বেশি শিক্ষার্থী সরকারি চাকরির অপেক্ষায় থেকে অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পিছিয়ে পড়বেন। দীর্ঘমেয়াদে এতে আরও বেশি জনসংখ্যা সরকারি চাকরির প্রতীক্ষায় থাকবেন, যার ফলে কর্মসংস্থান সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠবে। এ ছাড়া, বয়সসীমা বৃদ্ধির ফলে কর্মদক্ষতারও সংকট দেখা দিতে পারে, কারণ যেসব প্রার্থীর বয়স বেশি, তাদের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা নতুনদের তুলনায় কম হতে পারে।


করণীয় সমাধান:

১. বয়সসীমা সাময়িকভাবে বৃদ্ধি করা:

মহামারির প্রভাব বিবেচনা করে সাময়িকভাবে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২ থেকে ৩ বছর বাড়ানো যেতে পারে। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়, বরং একটি জরুরি ব্যবস্থা। বয়সসীমা বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকারদের সাময়িক আশ্বস্ত করা যেতে পারে, কিন্তু এটার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী নীতিগত পরিবর্তন প্রয়োজন।

2. কর্মসংস্থান খাতের সম্প্রসারণ:

সরকারি চাকরিতে সুযোগ সীমিত হওয়ায় বেসরকারি ও উদ্যোক্তা খাতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে বিভিন্ন সেক্টরে প্রশিক্ষিত করে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি, ফ্রিল্যান্সিং, কৃষি এবং উৎপাদন খাতের প্রসার ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে নীতি সহায়তা, ঋণ সুবিধা এবং অন্যান্য প্রণোদনা প্রদান করতে হবে।

3. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর জোর:

উচ্চশিক্ষার পরিবর্তে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র সরকারি চাকরির উপর নির্ভর না করে বিভিন্ন দক্ষতা অর্জন করে বেসরকারি খাতেও প্রবেশ করতে পারে। কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে দক্ষ কর্মী তৈরি করতে হবে, যাতে দেশের উৎপাদন খাতেও উন্নয়ন ঘটে।

4. স্টার্টআপ ও উদ্যোক্তা সংস্কৃতির বিকাশ:

তরুণদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করতে স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। সরকার ও বেসরকারি খাত মিলে স্টার্টআপ গঠনে সহায়তা করতে পারে, যাতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। উদ্যোক্তা হওয়া মানে শুধু নিজের কর্মসংস্থান নয়, বরং নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা।

5. চাকরি পরীক্ষার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা:

সরকারি চাকরির পরীক্ষায় স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনীতি, দুর্নীতি এবং পৃষ্ঠপোষকতামূলক নিয়োগ প্রক্রিয়া রোধ করতে হবে। এতে করে যোগ্য প্রার্থীরা সঠিকভাবে চাকরির সুযোগ পাবেন এবং বেকারত্ব কমবে।

6. ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং এবং কর্মমুখী প্রশিক্ষণ:

শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া এবং তাদের কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রদান করা প্রয়োজন, যাতে তারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি চাকরি খুঁজতে দক্ষ হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং সেল স্থাপন করা যেতে পারে, যা শিক্ষার্থীদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেবে।


উপসংহার:

বাংলাদেশের বেকারত্ব সমস্যা শুধু বয়সসীমা বাড়ানোর মাধ্যমে সমাধান হবে না। বরং এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি এবং সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা। কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, দক্ষতা উন্নয়ন, উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য প্রণোদনা এবং কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে এই সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব। দেশের উন্নয়ন ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের জন্য সরকারের উচিত এই বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

বিদ্র: ফেসবুক থেকে সংগ্রহীত:——–
https://www.facebook.com/share/p/1PJMzziHgF/

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org