চিকিৎসা বিদ্যাজেনেটিকস

আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে প্রিসিশন মেডিসিন এবং ফার্মাকোজেনোমিক্স

Share
Share

লেখক: সরকার এম শাহীন

ডিএনএ বা জিনের সমন্বয়ে বর্তমান চিকিৎসা সম্পর্কে চিন্তাভাবনার এক নতুন পদ্ধতি হল প্রিসিশন মেডিসিন। অর্থাৎ নির্ভুলভাবে ওষুধের সুপারিশ, সঠিক মাত্রা, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ পরিহার, অনুপযুক্ত চিকিৎসার খরচ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে চিকিৎসার অভিনব পদ্ধতিই প্রিসিশন মেডিসিন। বর্তমানে প্রচলিত প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতিতে ‘One-Size Fits all approach’ বা ‘সবার জন্য একই নিয়ম’ পদ্ধতিটি প্রচলিত, যা সাধারণত ওষুধের নির্দেশিকা ও অন্যান্য রোগীর চিকিৎসাতত্ত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত। রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে একজন মানুষের নিজস্ব জেনেটিকস, বিপাক এবং অন্যান্য পার্থক্যের কারণে এ ট্রায়াল অ্যান্ড এরর অ্যাপ্রোচ সবার জন্য কার্যকর নাও হতে পারে। এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য, একজন রোগী প্রথাগত ওষুধের পরিবর্তে রোগীর নিজস্ব জেনেটিক মেকআপ, মলিকুলার প্রোফাইল এবং তার ব্যক্তিগত তথ্য বিবেচনা করে রোগ নির্ণয় এবং সে অনুসারে চিকিৎসা দেওয়ার পদ্ধতিটিকে প্রিসিশন বা পার্সোনালাইজড মেডিসিনও বলা হয়ে থাকে। https://www.youtube.com/watch?v=6NdXsoo0j3I

প্রিসিশন মেডিসিনে ডিএনএ বা জিনের প্রভাব বা গুরুত্ব:

জিন মানবদেহের বংশগতির বাহক। এটি আমাদের দেহের কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা ডিএনএর সমন্বয়ে গঠিত উপাদান। জিন বাবা-মা থেকে সন্তানদের মাঝে প্রবাহিত হয় এবং পরে বংশ পরম্পরায় এ ধারা অক্ষুণ্ণ রাখে। যা মানব ইতিহাসের শুরু থেকে এভাবেই চলে আসছে। মানুষের নিজস্ব গতি, প্রকৃতি, দৈহিক গঠন, বেড়ে ওঠা, উচ্চতা, চোখের রং, এমনকি রোগ-বালাইসহ যাবতীয় তথ্য বহনকারী উপাদান হিসাবে কাজ করে এই জিন। তবে মানবদেহে জিন প্রবাহের এ পদ্ধতি কিন্তু ১০০ ভাগ সঠিক নিয়ম অনুসরণ করে না। পদ্ধতিগত এ ত্রুটিকে জিনোম ভ্যারিয়েশন (বৈচিত্র্য) বা মিউটেশন বলা হয়। বাংলায় যাকে বলা হয় ডিএনএ পরিবর্তন বা পরিব্যক্তি। ডিএনএ মিউটেশনের হার ০.০১ শতাংশ। বাকি ৯৯.৯৯ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকে। একজন মানুষের সঙ্গে অন্যজনের ডিএনএর ০.০১ শতাংশ মিউটেশন বা পরিবর্তনের জন্যই এ জগতের প্রতিটি মানুষই আলাদা। এ কারণেই প্রত্যেক মানুষ তার একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বহন করে। তা রোগের ধরন ও গতি-প্রকৃতিসহ সব ক্ষেত্রেই সত্যি। প্রিসিশন মেডিসিন পদ্ধতিতে রোগনিরাময়ের নির্দেশিকা তৈরিতে জিন বিন্যাস বা জিনোটাইপিং (Gene Sequence or Genotyping) যে পদ্ধতি ফলো করা হয় তার অন্যতম একটি পদ্ধতিটির নাম  হল ফার্মাকোজেনোমিক্স।

প্রিসিশন মেডিসিন এবং ফার্মাকোজেনোমিক্স: রোগী ওষুধ গ্রহণের পর ওষুধের কার্যকারিতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং বিপাক প্রক্রিয়ায় একধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এই বিষয়টি জিনগত প্রভাব বা তারতম্যের কারণে হয়ে থাকে। ফার্মাকোজেনোমিক্স ওষুধের কার্যকারিতা এবং জিনের এই আন্ত-পারস্পরিক সম্পর্ক (Interpersonal Relationship) নিশ্চিত করে যেমন, কিছু কিছু জিনসমূহ শরীরকে নির্দেশনা দেয় কীভাবে ওষুধ ব্যবহার করতে হবে বা ভেঙে ফেলতে হবে। ওষুধ ভেঙে ফেলার ক্যাটাবলিজম প্রক্রিয়াটি সবার জন্য কিন্তু একই নিয়ম মেনে চলে না। ব্যক্তি বিশেষে কারও  জন্য এই প্রক্রিয়া “দুর্বল” (ধীর) থেকে ‘স্বাভাবিক’ (মাঝারি) থেকে ‘অতি-দ্রুত’ (দ্রুত) হয়ে থাকে। এর মানে হল একই ওষুধ গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি ভিন্নভাবে বিপাকীয় প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। রোগীর জিনগত তফাৎ এবং বৈশিষ্ট্যের তারতম্যের জন্য, কিছু ওষুধ একজনের বিপাকীয় প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তুলতে পারে, এবং তার জন্য স্বাভাবিক ডোজ কার্যকর নাও হতে পারে ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। আবার একই ওষুধ আরেকজনের ক্ষেত্রে এমনকি ডোজের মাত্রা স্বাভাবিকের নিচেও কোনও ক্ষতিকারক প্রভাব না ফেলেই দুর্দান্ত কার্যকর হতে। ফার্মাকোজেনেটিক্স (PGx)পরীক্ষা নির্দিষ্ট জিনের বৈচিত্র্য মূল্যায়ন করে ওষুধের বিপাকীয়করণের হারকে প্রভাবিত করে প্রিসিশন মেডিসিন পদ্ধতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে।

ফার্মাকোজেনোমিক্স PGx পরীক্ষা কীভাবে কাজ করে?

ফার্মাকোজেনোমিক্স পরীক্ষায় একজন ব্যক্তির ডিএনএ বা জিন বিশ্লেষণ করে তার জেনেটিক প্রোফাইল বা ধরন যেমন ডিএনএ ভ্যারিয়েশন বা মিউটেশন জাতীয় রূপগুলি সনাক্ত করা হয়, এবং সেইসাথে বিপাকীয় প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে কোন ধরনের ওষুধ এবং ওষুধের সঠিক ডোজ কি হওয়া  উচিত তা নির্ধারণ করে থাকে। এই টেস্টিংপদ্ধতিতে রোগীর  ক্লিনিকাল প্রয়োগের জন্য যে  চিকিৎসা নির্দেশিকা অনুসরণ করা হয় সেটা আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক কনসোর্টিয়াম ‘ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোজেনেটিক্স ইমপ্লিমেন্টেশন কনসোর্টিয়াম (CPIC), ডাচ ফার্মাকোজেনেটিক্স ওয়ার্কিং গ্রুপ (DPWG) এবং ইউএস, ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিসট্রেশণ (US, FDA) দ্বারা স্বীকৃতি প্রাপ্ত। ওষুধ এবং জিনের মিথস্ক্রিয়ার স্বীকৃতি প্রাপ্ত একধরনের নির্দেশিকা ইতিমধ্যেই অনলাইন রিসোর্স (www.pharmgkb.org) হিসাবে বিনামূল্যে পাওয়া যাবে যেটা ক্লিনিকাল প্রয়োগের নির্দেশিকা হিসাবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।https://youtu.be/BjUlLkSbhxk 

প্রিসিশন মেডিসিনের সুবর্ণ অগ্রযাত্রায়ঃ একবিংশ শতাব্দিতে ফার্মাকোজেনোমিক্স ও প্রিসিশন মেডিসিন ওষুধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে  উদিয়মান (Emerging Approach) একটি উদ্ভাবন যা চিকিৎসা সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই অগ্রযাত্রা ইতিমধ্যেই বেশ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। শিশু এবং তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করে কানাডার প্রথম প্রমাণ ভিত্তিক ফার্মাকোজেনোমিক্স টেস্টিংপদ্ধতি (www.psychpgxlab.com/projects/pgx-spark) গত কয়েক বছর যাবত অত্যন্ত সফলতার সাথে কাজ করছে। গবেষণামূলক এই গ্রুপটি শিশু ও যুবকদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন, বিষণ্ণতা, উদ্বেগ অথবা স্নায়ুবিক বিকাশজনিত রোগ অটিজম (Autism), অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD), এডিআইচডি (ADHD), ওসিডি (OCD) এবং উদ্বেগ স্পেকট্রাম (Anxiety Spectrum) আক্রান্ত শিশুদের ফার্মাকোজেনোমিক্স পরীক্ষা পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে ইতিমধ্যেই দুই হাজারের অধিক রোগীর চিকিৎসা সেবা সম্পন্ন করেছে। চলমান  ফার্মাকোজেনোমিক্স এই গ্রুপটি বিশ্বাস করে যুবক এবং শিশুদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত ওষুধের (যেমন, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস, অ্যান্টিসাইকোটিকস) বর্তমান ব্যবহার একটি ট্রায়াল-এন্ড-এরর (পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভিত্তিক) প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ যা ওষুধ গ্রহণকারীদের সুস্থতার এবং তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক খরচের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারে। এই ট্রায়াল-এন্ড-এরর (পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভিত্তিক) প্রক্রিয়াটি আংশিকভাবে ফার্মাকোজেনোমিক্স পরীক্ষা প্রয়োগের মাধ্যমে এড়ানো যেতে পারে, পাশাপাশি ওষুধের কার্যকারিতা উন্নত করার এবং অনুপযুক্ত ওষুধের প্রতিক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত অসুস্থতা, মৃত্যুহার এবং অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানোর ঝুঁকি এড়াতেও সক্ষম।  ফলা স্বরূপ, একজন চিকিৎসকের ক্ষেত্রে প্রিসিশন মেডিসিনের এই পদ্ধতিতে সঠিক সময়ে সঠিক ওষুধ সঠিক রোগীকে দেওয়া সম্ভব হতে পারে।

পরিশেষে ফার্মাকোজেনোমিক্স ও প্রিসিশন মেডিসিন পদ্ধতির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে চিকিৎসা জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন নিউরোডেভেলপমেনটাল ডিস-অর্ডারসমূহ, কান্সার, আর্থাইটিস, ডায়াবিটিস, হৃদরোগের মত জটিল রোগসমূহের চিকিৎসায় যথাযথ ব্যবহারের সমূহ সম্ভাবনা রাখে। উন্নয়নশীল দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের মত জনবহুল দেশে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নে দেশের জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবীর অর্থনৈতিক খরচের বোঝা কমানোসহ ইতিবাচক প্রভাব ও ভূমিকা রাখতে পারে ।


লেখক:
সরকার এম শাহীন
গবেষক, নিউরোজেনেটিকস অ্যান্ড প্রিসিশন মেডিসিন।
ডিপার্টমেন্ট অব সাইকাইয়াট্রি, ফার্মাকোলজি অ্যান্ড মেডিকেল জেনেটিকস।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগেরি, কানাডা।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org