এক সময়ের সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ মানেই ছিল অভিজ্ঞ কোনো মানুষের পরামর্শ নেওয়া। কিন্তু সময় বদলেছে, বদলেছে সেই পরামর্শদাতাও। এখন আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ভরসা করি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের ওপর। প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কি একটু বেশিই নির্ভর করছি এই যন্ত্রচালিত পরামর্শদাতার ওপর?
একজন খেলোয়াড়, একটি পরামর্শ, এবং একটি ভুল সিদ্ধান্ত
ইউরোপের মার্টিন লুথার ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় এমনই একটি উদাহরণ উঠে আসে। এক খেলোয়াড় একটি গেম খেলছিলেন, যেখানে তার ইনভেস্ট করা অর্থ দ্বিগুণ হওয়ার সুযোগ ছিল—শর্ত ছিল, অপর খেলোয়াড়কে বিশ্বাস করতে হবে। তার কাছে প্রতিপক্ষের পূর্বের তিন রাউন্ডের তথ্য ছিল, যেখানে বারবার প্রতারণার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল। তবুও, যেহেতু এআই বলেছিল “বিশ্বাস করুন,” তিনি সেই পরামর্শ মানলেন। ফলাফল—সব হারালেন তিনি।
গবেষণা কী বলছে?
২০২৪ সালে Klingbeil et al. কর্তৃক প্রকাশিত Computers in Human Behavior জার্নালে এক গবেষণায় দেখা যায়, মানুষ যখন জানে কোনো পরামর্শ একটি এআই থেকে এসেছে, তখন তারা সেটার ওপর বেশি নির্ভর করে—even যদি সেটি তাদের নিজের যুক্তি বা প্রমাণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছিল একটি সংশোধিত “ট্রাস্ট গেম” ব্যবহার করে, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কিছু পেত এআইয়ের পরামর্শ, কিছু পেত একজন মানব “বিশেষজ্ঞের” পরামর্শ। ফলাফল ছিল সুস্পষ্ট—এআইয়ের পরামর্শ অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল।
বাস্তব উদাহরণে কী ঘটল?
এক খেলোয়াড় তার প্রতিপক্ষের পূর্বের সিদ্ধান্ত বিশ্লেষণ করে ভেবেছিলেন—এই ব্যক্তি আবার প্রতারণা করতে পারেন। কিন্তু যখন এআই পরামর্শ দিল “বিশ্বাস করুন,” তখন তিনি নিজের মূল্যায়নকে পাশ কাটিয়ে সেই ঝুঁকি নিলেন। ফলাফল? নিজের অর্থ হারালেন, আর প্রতারক খেলোয়াড় লাভবান হলেন।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
জার্মান গবেষক ড. আর্থার ক্লিংবেইল বলেন,
“মানুষ প্রায়ই মনে করে, যেহেতু এটি একটি এআই, এটি ভুল করবে না। কিন্তু এই বিশ্বাস অনেক সময় অনুপযুক্ত এবং ক্ষতিকর হতে পারে।”
মনোবিজ্ঞানী ড. ক্যাসান্দ্রা গ্রুটজনার যোগ করেন,
“বিশ্বাস এবং নির্ভরতা—এই দুটি আলাদা ধারণা। একজন মানুষ বিশ্বাস করতে পারে, কিন্তু সেটি মানেই নয় যে সে নির্ভর করবেই। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, এআইয়ের ক্ষেত্রে এই পার্থক্য প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।”
সবাই কি একইভাবে এআইয়ের ওপর নির্ভর করে?
না। কেউ কেউ প্রযুক্তির প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী, আবার কেউ ঝুঁকি নিতে ভয় পান। গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁদের ‘trust propensity’ অর্থাৎ বিশ্বাসপ্রবণতা বেশি, তাঁরা কিছুটা কম নির্ভর করেন এআইয়ের ওপর। তবে সাধারণভাবে দেখা যায়, ‘AI-generated’ ট্যাগটাই অনেকের সিদ্ধান্তে বড় প্রভাব ফেলে।
গভীরতর সমস্যা কোথায়?
এই অতিরিক্ত নির্ভরতা শুধু ব্যবহারকারীকে নয়, ক্ষতিগ্রস্ত করছে তৃতীয় পক্ষকেও। যেমন: যদি একটি ব্যাংক লোন মঞ্জুরের সময় ভুলভাবে এআই কাউকে অযোগ্য ঘোষণা করে, তবে সেই ব্যক্তি তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হন। সমাজের প্রেক্ষাপটে এটি একটি গভীর সমস্যা।
উপসংহার: প্রযুক্তি হোক সহকারী, নেতা নয়
এই গবেষণা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—অন্ধভাবে এআইয়ের ওপর ভরসা করা মানেই বিপদের পথে পা বাড়ানো। আমাদের প্রয়োজন ‘AI Literacy’—যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারব কখন একটি পরামর্শ গ্রহণযোগ্য, আর কখন সেটির যৌক্তিকতা যাচাই করা প্রয়োজন।
এআই অবশ্যই উপকারী, তবে সেটি কোনো সর্বজ্ঞ ঈশ্বর নয়—এটি কেবলমাত্র একটি টুল, যার ব্যবহার আমরা যদি ঠিকমতো না বুঝি, তবে সেটি আমাদের নিয়ন্ত্রণ না করে, আমরাই তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাব।
বিশেষ পরামর্শ:
নতুন প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। তবে সেটি যেন যুক্তিকে অতিক্রম না করে। মনে রাখুন, মানুষ ভুল করতে পারে—কিন্তু যন্ত্র সেই ভুল করে আরও নিঃসংকোচে, কারণ তার কাছে মানবিক বিবেচনার জায়গা নেই।
তথ্যসূত্র:
ক্লিংবেইল, এ., গ্রুটজনার, সি., ও শ্রেক, ফ. (২০২৪)। Trust and reliance on AI: An experimental study on the extent and costs of overreliance on AI, Computers in Human Behavior, 160. Elsevier.
Leave a comment