বিজ্ঞানীদের জীবনীরসায়নবিদ্যা

নাইলনের সৃষ্টিকথা

Share
Share

রউফুল আলম
গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

খাদ্যের পর মানুষের মৌলিক বস্তু হলো বস্ত্র। সে বস্ত্রের জন্য চাই সুতা। কুড়ি শতকের শুরুতেও বস্ত্রশিল্প ছিল প্রধানত প্রকৃতিনির্ভর। তাই সব ধরনের চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া শিল্পের বিকাশ ও বৈচিত্র্যে প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় কৃত্রিম সুতার। দুনিয়াজুড়ে রসায়নবিদেরা সুতা তৈরির জন্য চেষ্টা করছিলেন তখন। ওয়ালেস ক্যারোথাস তাঁদেরই একজন। তাঁর মগজজুড়ে ছিল সুতা তৈরির নেশা।

ক্যারোথাসের কর্মজীবন শুরু শিক্ষকতা দিয়ে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করেছিলেন। এক বছরের মাথায় সেখান থেকে চলে আসেন। ১৯২৭ সালে তিনি কাজ শুরু করেন পৃথিবীর বিখ্যাত রাসায়নিক কোম্পানি ডুপন্টে। ক্যারোথাস সেখানে পলিমার গবেষণা শুরু করেন। সে গবেষণার জন্য ল্যাবরেটরি গড়ে তোলেন। কয়েকজন তরুণ সহকর্মী নিয়ে শুরু হয় তাঁর কাজ।

গবেষণা করতে গেলে চোখ-কান খোলা রাখা অত্যন্ত জরুরি। সারা দুনিয়ায় একই সময়ে বহু মানুষ একই বিষয় নিয়ে চিন্তা করে। সফলভাবে যে আগে কাজ করতে পারে, কৃতিত্ব তার হাতেই চলে যায়। পলিমার গবেষণায় তখন অনেক খ্যাতনামা রসায়নবিদ মনোনিবেশ করেছিলেন। ক্যারোথাস সে বিষয়ে খোঁজ রাখতেন। দিনরাত তাঁর প্রচেষ্টা চলতে থাকে।

সফলভাবে কোনো রাসায়নিক যৌগ তৈরির বেশ কিছু ধাপ থাকে। একটি যৌগ তৈরি করতে হয়। সেটিকে বিশুদ্ধ করতে হয়। বিশুদ্ধ যৌগের গঠন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য করতে হয় নানান ধরনের পরীক্ষা। পলিমার যৌগের বিশুদ্ধকরণ তখন খুব কষ্টসাধ্য ছিল। সেসব যৌগের গঠন নির্ণয় ছিল আরও দুরূহ। ক্যারোথাস হাল ছাড়ার মানুষ নন। তিনি লেগে থাকলেন। ১৯৩৪ সালের দিকে তিনি মানসিকভাবে অনেক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ডুপন্টে তাঁর কাজের বয়স তখন প্রায় সাত বছর। বড় কোনো সাফল্যের মুখ তখনো তিনি দেখেননি। তবু তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশেষে ১৯৩৫ সালের শুরুতে আসে তাঁর জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত। সৃষ্টির সেই সোনালি ক্ষণ। ক্যারোথাস উদ্ভাবন করলেন এক অভাবনীয় রাসায়নিক বিক্রিয়া। এডিপিক অ্যাসিড নামক যৌগকে হেক্সামিথিলিন ডাই অ্যামিন নামক যৌগের সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করলেন চমত্কার এক অ্যামাইড যৌগ। বিক্রিয়াটি খুবই সাধারণ। তবে এমন অ্যামাইড যৌগ কেউ আগে কখনো দেখেনি। সে যৌগকে পাক দিয়ে সুতার মতো করে রাখা যায়। দুটি রাসায়নিক যৌগ মিশিয়ে দিলে সেখান থেকে তৈরি করা যাচ্ছে সুতা। সে সুতা শক্ত, নমনীয়! কী জাদুকরি ব্যাপার! সেই এমাইড যৌগের নাম হয়ে গেল    নাইলন (Nylon)।

ক্যারোথাস জানতেন, এই সুতা বদলে দেবে পুরো পৃথিবীকে। তবে এতটা দ্রুত সেটি ভাবেননি ঘুণাক্ষরেও। ১৯৩৯ সালের মধ্যে নাইলন জয় করেছিল সারা পৃথিবী। ডুপন্টের সহস্র সহস্র টন নাইলন সপ্তাহের মধ্যে ফুরিয়ে গেছে। সাত মহাদেশে নাইলন পৌঁছে গিয়েছিল ঘরে ঘরে। শুধু কাপড় নয়; টুথব্রাশ, গিটারের তার, কার্পেট—কোথায় ব্যবহূত হয়নি নাইলন! ক্যারোথাস অত সৌভাগ্যবান ছিলেন না। তাঁর সৃষ্টি কীভাবে সারা দুনিয়ার ঘরে ঘরে পৌঁছেছে, সেটি দেখে যেতে পারেননি তিনি।

১৯৩৭ সালের ৩০ এপ্রিল। ডুপন্ট কোম্পানিতে শোকের ছায়া। বিহ্বল হয়ে আছে শত শত কর্মী। তাদের মেধাবী রসায়নবিদ ওয়ালেস ক্যারোথাস মৃত! পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন তিনি। বয়স হয়েছিল মাত্র একচল্লিশ বছর। আসলে ক্যারোথাসের সৃষ্টিশীল জগতের অন্য পিঠে ছিল যন্ত্রণা। তিনি ছিলেন মানসিকভাবে হতাশাচ্ছন্ন! প্রকৃতি এই মেধাবীকে অনেকভাবে ঠকিয়েছে। দেখে যেতে পারেননি তাঁর সন্তানের মুখও। ক্যারোথাসের মৃত্যুর আট মাস পর, পৃথিবীর আলো দেখেছিল তাঁর সন্তান।

জগতকে যারা জয় করতে জানে, তারা হয়তো অন্যান্য বহু দিক দিয়ে হতভাগ্যই হয়। ক্যারোথাস রাসায়নিক শিল্পে এক নতুন যুগ সূচনা করেছিলেন। পলিমারশিল্পে তিনি যে বিপ্লব ঘটিয়েছেন, সেটার ওপর ভিত্তি করে রসায়নশিল্প অনেক দূর এসেছে। এই ক্ষণজন্মা মেধাবী রসায়নের ইতিহাসে নক্ষত্র হয়ে জ্বলছেন। নাইলনকে রাসায়নিকভাবে নাইলন-৬,৬ নামেও উল্লেখ করা হয়। এডিপিক অ্যাসিড ও হেক্সামিথিলিনডাইঅ্যামিনে ছয়টি করে কার্বন পরমাণু থাকায় এমন নামকরণ করা হয়েছে। অ্যামিন হলো জৈব ক্ষারক (Organic Base)। তাই অ্যাসিড ও ক্ষারের এই বিক্রিয়ায় পানি উত্পন্ন হয় আর সঙ্গে তৈরি হয় অ্যামাইড বন্ধন। যেহেতু ওই অ্যাসিড ও অ্যামিন যৌগে দুটি করে কার্বক্সিলিক গ্রুপ ও এমিন গ্রুপ থাকে, তাই এই বিক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। ফলে অসংখ্য অণু বিক্রিয়া করে, একটির পর একটি যুক্ত হয়ে বৃহত্ অণু তৈরি করতে পারে। আর সে বৃহত্ অণুটিতে থাকে অসংখ্য অ্যামাইড বন্ধন বা অ্যামাইড লিংক।

এই বৃহত্ অণুটিকে একটি চেইনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। একটি চেইনে যেমন একই রকমের রিং একের পর এক যুক্ত থাকে, তেমনি এই অণুটিতে নির্দিষ্টসংখ্যক কার্বন অন্তর অন্তর একটি এমাইড বন্ধন থাকে। এ ধরনের অণুগুলোকে রসায়নে বলা হয় পলিমার। নাইলন একটি পলিমার অণু।

আকারে বড় তাই আণবিক সংখ্যাও বেশি। প্লাস্টিক, রাবার, পলিথিন, পিভিসি পাইপ, প্রোটিন ইত্যাদি সবই পলিমার। পলিমার অণুগুলোকে বিভিন্ন গঠন, আকার ও আকৃতি দেওয়া যায়। নিত্যদিনে ব্যবহার্য বহু কিছু পলিমার থেকে তৈরি করা হয়। মানবজীবনে পলিমারের ব্যবহার বহুমুখী।


তথ্যসূত্র:
এই লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিনের ২০১৮ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে সংগৃহীত। লেখক: ড. রউফুল আলম, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org