ড. মশিউর রহমান
নারা কলেজ অফ টেকনলজির সেই ছাত্রজীবনে প্রথমবার যখন আমি ইন্টারনেটে ঢুকতে পারলাম, মনে হয়েছিল এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল। আজকের মতো নয়—তখনকার ওয়েবসাইটগুলো ছিল সাদামাটা, রঙচঙে সাজসজ্জা কিছুই ছিল না। কিন্তু সেই সাধারণতার ভেতরেও লুকিয়ে ছিল বিস্ময়ের ঝলক। নেটস্কেপ নামের একটি ব্রাউজার দিয়েই শুরু হয়েছিল সেই যাত্রা—যা আজও প্রযুক্তির ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়।
জন্ম এক বিপ্লবের
১৯৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এনসিএসএ-তে (National Center for Supercomputing Applications) দুই তরুণ গবেষক মার্ক অ্যান্ড্রিসেন ও এরিক বিনা তৈরি করলেন মোজাইক নামের এক ওয়েব ব্রাউজার। তখনকার দিনে ইন্টারনেট ছিল গবেষণাগার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির ভেতর সীমাবদ্ধ। ওয়েবপেজ বলতে কেবল টেক্সট দেখা যেত, ছবি বা হাইপারলিংকের তেমন ব্যবহারই ছিল না। মোজাইক সেই একঘেয়েমি ভাঙল। একসাথে ছবি, লেখা আর লিংক দেখা গেল সহজবোধ্য গ্রাফিকাল ইন্টারফেসে। এটি ছিল একেবারে বিপ্লবাত্মক ঘটনা।
নেটস্কেপের আবির্ভাব
অ্যান্ড্রিসেন চাইলেন এই উদ্ভাবনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল পেরিয়ে সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দিতে। ১৯৯৪ সালে তিনি যোগ দিলেন সিলিকন গ্রাফিক্সের প্রতিষ্ঠাতা জিম ক্লার্কের সঙ্গে। তারা গড়ে তুললেন নতুন কোম্পানি—প্রথমে নাম ছিল মজাইক কমিউনিকেশনস, পরে পরিবর্তন হয়ে দাঁড়ায় নেটস্কেপ কমিউনিকেশনস। সেই বছরই বাজারে আসে নেটস্কেপ ন্যাভিগেটর ১.০।
দ্রুতগতি, সহজ ব্যবহারযোগ্যতা আর ব্যক্তিগত ব্যবহারকারীদের জন্য বিনামূল্যে—এসব মিলেই নেটস্কেপ রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অনেকে বলেন, নেটস্কেপ ছিল সাধারণ মানুষের জন্য ইন্টারনেটে প্রবেশের প্রথম দরজা।
শেয়ারবাজারে ঝড়
১৯৯৫ সালের ৯ আগস্ট নেটস্কেপ শেয়ারবাজারে আত্মপ্রকাশ করে। শেয়ারের প্রাথমিক দাম ধরা হয়েছিল ২৮ ডলার। কিন্তু প্রথম দিনেই তা লাফিয়ে উঠে ৭১ ডলারে এবং শেষ হয় ৫৮ ডলারে। তখনো কোম্পানির উল্লেখযোগ্য আয়ই শুরু হয়নি, অথচ একদিনেই এটি প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হলো। এই ঘটনাকেই ধরা হয় ডটকম বুম-এর সূচনা হিসেবে—যেখান থেকে শুরু হয় প্রযুক্তি স্টার্টআপে বিনিয়োগের উন্মাদনা।
উদ্ভাবনের ধারাপাত
১৯৯৬ সালের মধ্যে নেটস্কেপ ন্যাভিগেটর দখল করে নেয় বাজারের প্রায় ৮০ শতাংশ। শুধু জনপ্রিয়তাই নয়, নেটস্কেপের হাত ধরেই জন্ম নেয় অনেক মৌলিক প্রযুক্তি। যেমন:
- ওয়েব কুকি: ব্যবহারকারীর তথ্য মনে রাখার ব্যবস্থা।
- ফ্রেম: এক পৃষ্ঠায় একাধিক অংশ দেখানোর কৌশল।
- জাভাস্ক্রিপ্ট: তরুণ প্রকৌশলী ব্রেন্ডন আইকের তৈরি এই ভাষা ওয়েবপেজকে ইন্টারঅ্যাকটিভ করে তোলে।
আজও এই প্রযুক্তিগুলো ইন্টারনেটের ভিত্তি হয়ে আছে।
ব্রাউজার যুদ্ধ
নেটস্কেপের সাফল্য দেখে মাইক্রোসফট বসে থাকেনি। ১৯৯৫ সালে তারা চালু করল ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার। সবচেয়ে বড় চাল ছিল—উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের সঙ্গে এটি বিনামূল্যে বাণ্ডেল করা। অর্থাৎ নতুন কম্পিউটার কিনলেই ব্রাউজার সঙ্গে ফ্রি। নেটস্কেপকে তখনও কিনে ব্যবহার করতে হতো। ফলে বাজার দ্রুত সরে যেতে শুরু করে ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের দিকে।
পতনের শুরু
১৯৯৮ সালে নেটস্কেপকে কিনে নেয় আমেরিকা অনলাইন (AOL) প্রায় ৪.২ বিলিয়ন ডলারে। একই সময়ে নেটস্কেপ নেয় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত—ব্রাউজারের মূল কোড উন্মুক্ত করে দেয় বিশ্বব্যাপী প্রোগ্রামারদের জন্য। এই উদ্যোগের নাম হয় মজিলা প্রজেক্ট। এখান থেকেই জন্ম নেয় ফায়ারফক্স ব্রাউজার, যা দুই হাজারের দশকে আবারও ইন্টারনেটে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে।
কিন্তু নেটস্কেপ ব্র্যান্ডকে আর বাঁচানো গেল না। ২০০৩ সালে এওএল কর্মী ছাঁটাই শুরু করে, এবং ২০০৮ সালের মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে নেটস্কেপ ব্রাউজারের সমর্থন বন্ধ হয়।
নেটস্কেপের উত্তরাধিকার
নেটস্কেপ হয়তো আজ নেই, কিন্তু তার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার আজও টিকে আছে—
- জাভাস্ক্রিপ্টের জন্ম: আজকের ওয়েব ডেভেলপমেন্টের প্রাণ।
- অ্যান্টিট্রাস্ট মামলা: নেটস্কেপ বনাম মাইক্রোসফট লড়াই থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক প্রতিযোগিতা আইন মামলার সূত্রপাত।
- ওপেন সোর্স আন্দোলন: মজিলা প্রজেক্ট আজও উন্মুক্ত ওয়েবের প্রতীক।
শেষ কথা
নেটস্কেপের গল্প শুধু একটি কোম্পানির উত্থান-পতনের কাহিনি নয়। এটি ইন্টারনেটের বেড়ে ওঠার গল্প। আমাদের শেখায়, প্রযুক্তি দুনিয়ায় সাফল্য আসতে পারে দ্রুত, হারিয়েও যেতে পারে দ্রুত। কিন্তু সত্যিকারের উদ্ভাবন—হোক তা নতুন প্রোগ্রামিং ভাষা বা ওপেন সোর্স আন্দোলনের বীজ—সময়কে অতিক্রম করে ভবিষ্যতকে গড়ে তোলে।
নেটস্কেপ হয়তো মুছে গেছে, কিন্তু আমাদের প্রতিটি ক্লিকের ভেতর আজও বেঁচে আছে তার উত্তরাধিকার।
Leave a comment