১৯৯৫ সালের জুলাই মাস। জার্মানির একদল বিজ্ঞানী একটি নতুন শব্দ ফাইল ফরম্যাটের নাম ঠিক করলেন—একটি অভ্যন্তরীণ ইমেইল ভোটাভুটির মাধ্যমে। নামটি ছিল ছোট্ট, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ: এমপিথ্রি। তখন কেউ ভাবেনি, এই তিন অক্ষরের নাম শুধু সংগীত জগৎকেই নয়, আমাদের দৈনন্দিন সংস্কৃতিকে বদলে দেবে। এরপরের গল্পটা হলো প্রযুক্তি ও মানুষের অভ্যাসের এক অভূতপূর্ব রূপান্তরের ইতিহাস।
যারা ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে মোবাইল ফোন বা আইপডে গান শুনেছেন, তাদের কাছে এমপিথ্রি একটি আবেগময় স্মৃতি। ১৬ মেগাবাইটের এমপিথ্রি প্লেয়ারে যখন মাত্র চারটি গান রাখা যেত, তখনও সেটাই ছিল এক বিস্ময়। কিছু বছর পর অ্যাপলের আইপড বাজারে এল ৫ গিগাবাইট জায়গা নিয়ে, আর মানুষ প্রথমবারের মতো বুঝল—একটি ছোট্ট যন্ত্রে হাজার গান বহন করা সম্ভব। এই বিপ্লবের নেপথ্যে ছিল জার্মানির ফ্রাউনহোফার আইআইএস, যার অবস্থান আর্লাঙ্গেন শহরে।
ফ্রাউনহোফারের গবেষকরা এক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন: কীভাবে শব্দকে ডিজিটাল ফরম্যাটে এমনভাবে সংরক্ষণ করা যায় যাতে সেটা যতটা সম্ভব কম জায়গা নেয়, অথচ মানের কোনো বড় ক্ষতি না হয়? এই ভাবনা থেকেই তৈরি হয় এমপিইজি-১ অডিও লেয়ার থ্রি—সংক্ষেপে এমপিথ্রি। এর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল ‘লসি কমপ্রেশন’। মানুষের শ্রবণ ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে অপ্রয়োজনীয় সাউন্ড ডেটা বাদ দেওয়া হতো, ফলে ফাইল সাইজ অনেক ছোট হয়ে যেত, কিন্তু কানে খুব একটা তফাৎ ধরা পড়ত না।
নাম ঠিক হওয়ার পর খুব বেশি সময় লাগেনি প্রযুক্তিটিকে জনপ্রিয় হতে। ফ্রাউনহোফার দল তাদের লক্ষ্য পূরণ করে দেখিয়েছে—ছোট ও বহনযোগ্য ডিভাইসেও এমপিথ্রি ফাইল বাজানো সম্ভব। এরপর শুরু হয় এক নতুন যুগ। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে আর দুই হাজার সালের শুরুতে এমপিথ্রি প্লেয়ার ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়াজুড়ে। উইনঅ্যাম্প, ন্যাপস্টার, লাইমওয়্যার—এসব নাম তখনকার তরুণ প্রজন্মের কাছে শুধুই সফটওয়্যার নয়, এক নতুন সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে ওঠে।
অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসও এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করেন আইপড, যা প্রযুক্তির ইতিহাসে অন্যতম সফল পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। একই সঙ্গে ন্যাপস্টারের মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে গান শেয়ারের এক নতুন ধারা শুরু হয়। এটি সংগীতকে গ্লোবালাইজেশনের এক বাস্তব উদাহরণে পরিণত করেছিল।
এমপিথ্রি শুধু প্রযুক্তিগত সাফল্যই আনেনি, এনেছে বিশাল অর্থনৈতিক সাফল্যও। ফ্রাউনহোফার সোসাইটি এমপিথ্রি পেটেন্ট থেকে শত শত মিলিয়ন ইউরো আয় করেছে। এই আয় তারা ব্যবহার করেছে গবেষণার পরিধি বাড়াতে, আর্লাঙ্গেনের ফ্রাউনহোফার আইআইএস-কে পরিণত করেছে পুরো সংস্থার সবচেয়ে বড় গবেষণা ইনস্টিটিউটে। এমপিথ্রির সাফল্যের পর তারা আরও উন্নত অডিও কোডেক তৈরিতে মনোযোগ দেয়, যার প্রভাব আজও আমরা অনুভব করি।
যদিও আজ এমপিথ্রি আগের মতো প্রচলিত নয়, তবুও তার ভিত্তি আজও আধুনিক অডিও স্ট্রিমিং-এর ভেতর বেঁচে আছে। এমপিথ্রির উত্তরসূরি নানা কোডেক, যেমন এক্সএইচই-এএসি, এখন বিলিয়ন মানুষের হাতে—পডকাস্ট, সিনেমা কিংবা গান স্ট্রিমিং-এ। স্পটিফাই, ইউটিউব বা নেটফ্লিক্সে আমরা যে পরিষ্কার, কম জায়গায় উচ্চমানের অডিও শুনি, তার পেছনে এমপিথ্রিরই দীর্ঘ ছায়া।
এই প্রযুক্তির ইতিহাসে এক মজার অধ্যায় হলো, প্রথম যে গানটি এমপিথ্রিতে রূপান্তরিত হয়, সেটি ছিল সুজান ভেগার “টম’স ডাইনার”। প্রায় সম্পূর্ণ অ্যাকাপেলা এই গানটি ছিল কোডেক পরীক্ষা করার জন্য আদর্শ। আরও মজার ব্যাপার, এই টম’স ডাইনার আসলে নিউ ইয়র্ক সিটির এক রেস্টুরেন্ট, যা পরে সিটকম সাইনফেল্ড-এর বিখ্যাত “মঙ্ক’স ক্যাফে” হিসেবে পরিচিত হয়।
তবে এমপিথ্রির বিপ্লব সব সময় ইতিবাচক ছিল না। এই ফরম্যাটই বিশ্বজুড়ে সংগীত পাইরেসির এক নতুন যুগের সূচনা করে। অবৈধভাবে গান ডাউনলোড ও শেয়ার করা রেকর্ড কোম্পানি ও শিল্পীদের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়। তবুও, প্রযুক্তির ইতিহাসে এমপিথ্রি এমন একটি নাম, যা ইতিবাচক বা নেতিবাচক সব আলোচনাতেই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।
বাংলাদেশে এমপিথ্রির আগমনও ছিল এক ভিন্ন গল্প। ২০০০-এর দশকে শহরের কম্পিউটার দোকানে “এক টাকায় এক গান” অফারে সিডিতে গান বার্ন করার ধারা শুরু হয়। গ্রামে-শহরে সমানভাবে মোবাইলে ব্লুটুথ বা ইনফ্রারেড দিয়ে গান আদান-প্রদান ছিল তরুণদের জন্য এক আনন্দঘন অভিজ্ঞতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, গ্রামের চায়ের দোকানে, শহরের বাসে—এমপিথ্রি ছিল সর্বত্র উপস্থিত।
আজ আমরা এআই-ভিত্তিক অডিও উন্নয়ন, থ্রিডি স্পেশাল সাউন্ড, লসলেস ফরম্যাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তবুও, এই প্রযুক্তিগত বিপ্লবের শিকড় রয়েছে এমপিথ্রির ভেতরেই। আর্লাঙ্গেনের ছোট্ট ল্যাবরেটরিতে যে গবেষণা শুরু হয়েছিল, সেটি আজ বিলিয়ন মানুষের অডিও অভিজ্ঞতার ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমপিথ্রি আমাদের শুধু গান শোনার ধরনই বদলায়নি, বদলে দিয়েছে সাংস্কৃতিক অভ্যাস, তথ্যের আদান-প্রদান ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ধরণ। এটি প্রমাণ করেছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একসঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কত গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। আজকের তরুণ প্রজন্ম, যারা পডকাস্ট রেকর্ড করেন বা ইউটিউবে গান তৈরি করেন, হয়তো ভাবেন না তাদের এই সৃজনশীল স্বাধীনতার পেছনে এক সময়কার ক্ষুদ্র একটি ফাইল ফরম্যাটের দীর্ঘ পথচলা রয়েছে।
আজ এমপিথ্রির জন্মদিনে, আমাদের উচিত সেই বিজ্ঞানী দলকে স্মরণ করা—যারা সঙ্গীতকে সীমাহীনভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং তা বাস্তবায়ন করেছিলেন। একটি ছোট ফাইল ফরম্যাট, যার হাত ধরে পৃথিবী পেয়েছিল এক বড় বিপ্লব।
Leave a comment