কৃষিপরিবেশ ও পৃথিবী

আধুনিক মুরগির ওজন বেড়েছে ৩৬৪% — বিজ্ঞান ও অর্থনীতির টানাপোড়েনের গল্প

Share
Share

নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
📩 যোগাযোগ: [email protected]

আজকের বাজারে যখন আপনি এক কেজি বা তার বেশি ওজনের একটি মুরগি কিনে আনেন, হয়তো আপনি জানেন না—এই মুরগির পূর্বপুরুষ পঞ্চাশ বছর আগে ছিল অনেকটাই ছোট, প্রায় ১ কেজির কাছাকাছি। গত পাঁচ দশকে খাওয়ার জন্য পালন করা মুরগির গড় ওজন বেড়েছে প্রায় ৩৬৪%, যা শুধুই একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং পশুপালন, জিনতত্ত্ব, কৃষি প্রযুক্তি ও ভোক্তাপছন্দের জটিল এক মিশ্র প্রতিচ্ছবি।

কেমন ছিল অতীতের মুরগি?

১৯৭০-এর দশকে, একটি গৃহপালিত ব্রয়লার মুরগির গড় ওজন ছিল প্রায় ২ পাউন্ড (প্রায় ৯০০ গ্রাম)। তখন এগুলো সাধারণত বাড়ির উঠোনে খোলা পরিবেশে বড় হতো এবং স্বাভাবিক হারে বেড়ে উঠত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ভোক্তাদের চাহিদা বেড়েছে, খাবারের ধরন বদলেছে, আর শিল্পায়িত কৃষি ব্যবস্থাপনায় এসেছে বিপ্লব।

ওজন বৃদ্ধির পেছনের বিজ্ঞান

এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি হলো নির্বাচন ভিত্তিক প্রজনন (Selective Breeding)। গবেষকরা ও খামারিরা এমন মুরগি নির্বাচন করেছেন যেগুলো দ্রুত বাড়ে, কম খাবারে বেশি ওজন নেয়, এবং যাদের বুকের মাংস তুলনামূলকভাবে বেশি। বিশেষ করে Cornish Cross নামের একটি হাইব্রিড জাত এখন শিল্প খামারগুলোর মূল নির্ভরতা।

এর পাশাপাশি এসেছে উন্নত খাদ্য প্রস্তুতি (Feed Optimization), যার মাধ্যমে মুরগিরা আরও কার্যকরভাবে খাদ্য গ্রহণ করে দ্রুত ওজন অর্জন করতে পারে। নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আলো, এবং আবদ্ধ পরিবেশেও রাখা হয় যাতে বাড়তি শক্তি খরচ না হয়।

হরমোন ও স্বাস্থ্যবিষয়ক বিতর্ক

অনেক ক্ষেত্রে মুরগির বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে গ্রোথ হরমোন ব্যবহারের অভিযোগও উঠে এসেছে, যদিও উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যেমন যুক্তরাষ্ট্র USDA এরকম ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করেছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই দ্রুত বেড়ে ওঠা শরীর কি সত্যিই স্বাস্থ্যকর?

অনেক সময় দেখা যায়, মাত্র ৫-৬ সপ্তাহেই যে মুরগি প্রায় ৪ কেজি হয়ে যাচ্ছে, তার পা শরীরের ভার সইতে পারছে না। হৃদযন্ত্র, হাড় এবং ফুসফুসে সমস্যা দেখা দেয়। হাঁটাচলার ক্ষমতা কমে যায়, এমনকি কিছু মুরগি হাঁটতেই পারে না। এই অবস্থাকে বলা হয় “Broiler Welfare Crisis”—একটি নীরব সংকট যা সাধারণ ভোক্তার চোখে পড়ে না।

মাংসের গুণমান ও স্বাদ

মুরগির ওজন যত বাড়ছে, ততই কমে যাচ্ছে তার স্বাভাবিক জীবনকাল, আর তার সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে মাংসের স্বাদ ও গুণমান। অনেকেই এখন বলেন, দোকানে কেনা ব্রয়লার মাংসে সেই আগের ঘ্রাণ ও স্বাদ নেই। এর কারণ হতে পারে কৃত্রিম খাদ্য, কম বয়সে জবাই, এবং জিনগত বৈচিত্র্যের অভাব।

পরিবেশগত প্রভাব

প্রশ্ন উঠছে—এই উচ্চ উৎপাদনশীল মুরগির খামারগুলো পরিবেশে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?

  • প্রচুর পরিমাণে মিথেন ও অ্যামোনিয়া গ্যাস নির্গত হচ্ছে।
  • বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব থেকে সৃষ্টি হচ্ছে মাটির ও পানির দূষণ
  • মুরগির খাবার তৈরিতে প্রয়োজন হয় প্রচুর পরিমাণে সয়া ও ভুট্টা, যা পৃথিবীর বনভূমি ধ্বংস করে উৎপাদন করা হয়।

নৈতিক প্রশ্ন: কতটা ন্যায্য?

যখন আমরা এই ধরনের উৎপাদনকে ‘সফলতা’ বলি, তখন পশুর দুর্দশা কি আমরা উপেক্ষা করছি? Animal Welfare Organizations বারবার বলছে, মুরগির দেহবৃত্তীয় স্বাভাবিক চাহিদা, চলাচলের অধিকার, ও স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার সুযোগ তাদের দেয়া হচ্ছে না।

অনেক উন্নত দেশে ‘কেফ্রি রেঞ্জ‘ বা ‘অর্গানিক মুরগি‘ বলে যেসব মুরগি বিক্রি হয়, তাদের স্বাভাবিক পরিবেশে চলাচল, প্রাকৃতিক খাদ্য এবং পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয় বড় হওয়ার জন্য। কিন্তু সেগুলোর দাম তুলনামূলক বেশি—যা উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে।

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে

বাংলাদেশেও ব্রয়লার মুরগির চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। দাম তুলনামূলক কম, রান্না করা সহজ, এবং দ্রুত উৎপাদনযোগ্য। কিন্তু এখনই সময়—আমাদের কৃষিবিদ, খামার মালিক, ও নীতিনির্ধারকদের ভাবা উচিত, দীর্ঘমেয়াদে এই উৎপাদন পদ্ধতি আমাদের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য কতটা নিরাপদ?

শহর ও গ্রামের অনেক তরুণ খামারিরা এখন ডিপ লিটার বা অর্গানিক পোল্ট্রি ফার্মিং শুরু করছেন। এসব খামার তুলনামূলকভাবে টেকসই ও স্বাস্থ্যসম্মত, যদিও উৎপাদন খরচ বেশি।

ভবিষ্যৎ পথ কী?

বিশ্বজুড়ে এখন গবেষণা হচ্ছে কিভাবে খাদ্য উৎপাদনকে করা যায় আরও টেকসই, ন্যায্য ও স্বাস্থ্যকর। এর মধ্যে রয়েছে—

  • ল্যাবে উৎপাদিত মাংস (Cultured Meat): যেখানে জীবন্ত প্রাণীকে হত্যা ছাড়াই কোষ থেকে মাংস তৈরি করা যায়।
  • ভিন্ন প্রজাতির মুরগি ব্যবহার: যারা স্বাস্থ্যবান, পরিবেশ সহনশীল এবং তুলনামূলক কম সমস্যায় ভোগে।
  • ভোক্তার সচেতনতা বৃদ্ধি: যেন তারা শুধু সস্তা না দেখে, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের কথাও বিবেচনায় আনে।

উপসংহার

একটি মুরগির শরীর কেবল মাংসের আধার নয়—তার পেছনে আছে বিজ্ঞান, অর্থনীতি, পরিবেশ ও নৈতিকতার একটি জটিল জগৎ। তাই আমাদের প্রতিটি খাবারের পেছনে থাকা এই গল্পগুলো জানা প্রয়োজন। ভবিষ্যতের পৃথিবী শুধু উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল হবে না, বরং টেকসইতা, নৈতিকতা এবং বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্তই গড়ে দেবে খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি।


📚 আরও জানুন:

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org