চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় একটি নতুন জমির সৃষ্টি হয়েছে। কৃষকের চোখে-মুখে হাসি, এলাকাবাসী আরেকটু সাবলম্বী হওয়ার আশায় শ্বাস ফেলছে, তবে খবরটি যেতেই ব্যাবসায়ীদের আঙ্গুল উশখুশ করছে টাকা গোনার জন্য।
কিন্তু বিপদ ঘটলো তখন, যখন সোনার ফসলের চেহারা দেখতে দেখতে অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেল! কৃষকের এত কষ্টের জমানো অর্থ খরচ করেও ফসলগুলো সাজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই কাদামাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সব জায়গায় কানাঘুষা শুরু হলো। খবর ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেল গবেষক পাড়ায়।
নদীর ভাটিতে সুখ-দুঃখের গল্প
নদীর ভাটিতে এই বিশাল ভূমি তৈরি হয়েছে। বাইরে থেকে যত সুন্দর দেখায়, ভিতরে ততটাই দুঃখ জমা। পানি ছাড়া যেমন ফসল বাঁচে না, ঠিক তেমন পানির কারণেই ফসল মারা যাচ্ছে। জানা গেল, নদীর পানির গুণাগুণ ও ফসল উৎপাদনের মধ্যে সরাসরি এবং মৌসুমি সম্পর্ক আছে।
এই এলাকায় প্রায়ই ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ার-ভাটা লেগেই থাকে। এসব দুর্যোগ মাটিকে অনুর্বর করে তুলছে, প্রতিদিনই যেন লড়াই চলছে। কৃষকের মাথায় হাত — কোথায় পাবেন গুণ ফসল, গুণ দাম? নিজের না খাওয়া টাকাই যেন গচ্ছা যাচ্ছে!
বাঙালি গবেষকদের তৎপরতা
নিজ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের এমন কষ্ট দেখে গবেষক দলের গলায় যেন ভাত নামছে না। তারা ছুটে গেলেন চট্টগ্রামে, মিরসরাই এলাকায়। সেখান থেকে মাটি, পানি, কাঁদা — সব আলাদা করে সংগ্রহ করলেন। লক্ষ্য: সমস্যাটি কোথায়, কতটুকু এবং কীভাবে সমাধান সম্ভব, তা খুঁজে বের করা।
প্রথমেই তারা একটি নির্দিষ্ট গবেষণা এলাকা বেছে নিলেন। এরপর এলাকা ভাগ করলেন চারভাগে — পুরাতন সংরক্ষিত, নতুন সংরক্ষিত, অরক্ষিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা।
প্রতিটি স্থান থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হলো তিনটি স্তর থেকে:
- উপরের স্তর
- মাঝের স্তর
- ভূগর্ভস্থ স্তর
গবেষণার ফলাফল
- আমন ও রবি মৌসুমে গবেষণা এলাকার লবণাক্ততা ৪ ডিএস/মিটারের কম ছিল।
- রবি মৌসুমে অরক্ষিত এলাকা ছাড়া বাকি সব এলাকায় লবণাক্ততা কম ছিল।
- ক্রস ড্যামের ভেতরের পানির লবণাক্ততা রবি মৌসুমে ছিল ০.১ ডিএস/মিটার (সেচের জন্য চমৎকার)।
- কিন্তু ক্রস ড্যামের বাইরে আমন মৌসুমে লবণাক্ততা ছিল ৪.৮-৫.৪ ডিএস/মিটার, এবং এমএইচআই সি’ইলেনে ১২.৪-২০.৮ ডিএস/মিটার — যা সেচের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
ধান ৪ ডিএস/মিটার পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে, তাই আমন মৌসুমে মাটির লবণাক্ততা খুব বাধা নয়। তবে মূল সমস্যা দেখা দিল জলাবদ্ধতা নিয়ে।
সমাধানের প্রস্তাব
গবেষকরা জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪টি প্রস্তাব দেন —
- পুরাতন সংরক্ষিত এলাকা: গাদাশারা খালের জলাবদ্ধতা দূর করতে হবে।
- নতুন সংরক্ষিত এলাকা: মাছের পুকুরের সীমানা অপসারণ করতে হবে।
- অরক্ষিত এলাকা: ফণী নদীর পূর্ব পাশে একটি বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
- ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা: জলাবদ্ধতা-সহনশীল ফসল এবং আমন মৌসুমে উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ।
মৌসুমি চাষের নির্দেশনা
- রবি মৌসুমে অরক্ষিত এলাকা ছাড়া সব এলাকায় ধান চাষ সম্ভব।
- বর্ষা মৌসুমে উচ্চ ফলনশীল ধান পুরাতন ও নতুন সংরক্ষিত এলাকায় চাষ করা যাবে।
- ফণী নদীর পানি, মুহুরি রেগুলেটর ও রাজার ড্যামের ভেতরের পানি সেচের জন্য ব্যবহার করে HYV ধান উৎপাদন সম্ভব।
এক চমকপ্রদ আবিষ্কার
গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন—মাটির লবণাক্ততা ও খেসারি উৎপাদনের মধ্যে একটি ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ, লবণাক্ততার সমস্যা থাকলেও (৪ ডিএস/মিটার) খেসারি চাষ করা যায়। এমনকি অরক্ষিত এলাকাও (যা আগে বিষাক্ত বলে ধরা হত) বর্ষা মৌসুমে খেসারি চাষে সফল হতে পারে।
শেষ কথা: গবেষকদের কল্যাণে প্রমাণিত হলো — সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় মিরসরাইয়ের কৃষকরা আবারও সফলভাবে ফসল ফলাতে পারবেন।
তারান্নুম বিনতে জাকির
প্রকৌশল শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিক | পানি, এনভায়রনমেন্ট, আবহাওয়া পরিবর্তন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, নাগরিক সুবিধা ও নগর পরিকল্পনা নিয়ে আগ্রহী।
Leave a comment