ভ্রমণপিপাসু বাঙালিরা প্রায়শই প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য উপভোগ করতে জাপানের কিওটো শহরে যান। এই শহরের শান্ত, প্রাচীন আর মনোরম পরিবেশে বসে আলাপ হচ্ছিল এক ব্যতিক্রমী মানুষের সঙ্গে। তিনি হলেন তরুণ গবেষক এবং অধ্যাপক ড. মাহফুজুল ইসলাম, যিনি কিওটো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কেবল প্রযুক্তি বা গবেষণা নিয়েই আলোচনা হয়নি, বরং উঠে এসেছে জীবনবোধ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা।
মাহফুজের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেকটা ছোট ভাইয়ের মতো। আমরা যারা জাপানের বৃত্তি নিয়ে স্নাতক পর্যায়ে জাপানে পড়াশুনা করেছি, তারা মিলে তৈরি করেছি “শশি” নামে একটি সংগঠন। এই শশি’র অন্যতম সদস্য মাহফুজ। তাই তার সাথে মাধে মধ্যেই গল্প হয়। ২০১৭ এর দিকে কিয়োতো শহরে একটি প্রোজেক্টের কাজে যাওয়ার সময় আবারও তার সঙ্গে দেখা হল। এক সকালে হঠাৎ ফোন করে মাহফুজ বলল, “চলেন কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে দেখাই।” এমন সুযোগ লুফে নিলাম। মূল ক্যাম্পাস থেকে কিছুটা দূরে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত কাৎসুরা ক্যাম্পাস—পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কাৎসুরা নদী। মাহফুজ আমাকে তার ল্যাব ও অন্যান্য গবেষণাগার ঘুরিয়ে দেখাল। পাহাড়ের উপর থেকে অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্যে আমি সত্যিই বিমোহিত। শহরের কোলাহল থেকে দূরে গবেষকদের জন্য সরকারের এমন উদ্যোগ কেবল প্রশংসারই দাবি রাখে। মনে হলো, এই শান্ত ও সৃজনশীল পরিবেশই কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চমানের গবেষণার ফলাফলের অন্যতম কারণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে চোখ বুলিয়ে দেখলাম—এখান থেকে ইতিমধ্যেই উনিশ (১৯) জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
গবেষণার স্বাধীনতা ও কিওটোর দর্শন
ড. মাহফুজ তাঁর কথোপকথনে প্রথমেই তুলে ধরলেন কিওটো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের মূলমন্ত্র। সেটি হলো, একাডেমিক চিন্তাভাবনার স্বাধীনতা। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, “টোকিওর গবেষণার পরিবেশ অনেক বেশি বাজারমুখী। অর্থাৎ, যে গবেষণা থেকে দ্রুত কোনো পণ্য তৈরি করা যায়, সেটির দিকেই সেখানে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়।”
অন্যদিকে কিওটোর চিত্রটি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে মৌলিক গবেষণাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। বছরের পর বছর ধরে একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় নিয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে এখানে। এর পেছনে রয়েছে একটি গভীর দর্শন — “Ouyou o suru ni wa, kiso o yare” — যার অর্থ হলো, “যদি কোনো কিছুকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে চাও, তবে আগে তার ভিত্তিটা মজবুত করো।” এই দর্শনের কারণেই কিওটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক গবেষক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
একজন বিজ্ঞানীর পথচলা
ড. মাহফুজুল ইসলাম তাঁর জীবনের গল্পটি বর্ণনা করলেন। ২০০১ সালে সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি হন। এরপর জাপানের একটি সরকারি বৃত্তি নিয়ে তিনি জাপানে যান। সেখানে জাপানি ভাষা শেখার পর তিনি প্রথমে একটি কলেজ অফ টেকনোলজিতে ভর্তি হন। তারপর কিওটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
পিএইচডি শেষ করার পর তিনি টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ শুরু করেন, কিন্তু কিওটোর প্রতি ভালোবাসার টানে ২০১৮ সালে আবার ফিরে আসেন কিওটো বিশ্ববিদ্যালয়ে, তবে এবার একজন অধ্যাপক হিসেবে। তাঁর ৩০টিরও বেশি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং সার্কিট ডিজাইনের উপর দুটি পেটেন্টও রয়েছে, যা তাঁর পরিশ্রম ও মেধার বড় প্রমাণ।
এলএসআই সার্কিট ডিজাইন: বিজ্ঞানের এক রোমাঞ্চকর জগৎ
তাঁর গবেষণার মূল ক্ষেত্র হলো লার্জ স্কেল ইন্টিগ্রেশন (LSI) সার্কিট ডিজাইন। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, আমাদের ব্যবহৃত কম্পিউটার, স্মার্টফোন বা যেকোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ভেতরে যে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ট্রানজিস্টর দিয়ে তৈরি চিপ থাকে, সেই চিপগুলো কীভাবে আরও দক্ষতার সাথে কাজ করবে, তা নিয়েই তাঁর গবেষণা।
ড. মাহফুজ ব্যাখ্যা করেন, চিপ যত ছোট হয়, তার মধ্যে তত বেশি ট্রানজিস্টর বসানো যায়। কিন্তু এর একটি বড় সমস্যা হলো, ট্রানজিস্টরগুলো অত্যন্ত ক্ষুদ্র হওয়ার কারণে তাদের কার্যকারিতায় ‘নয়েজ’ বা ত্রুটি দেখা যায়। এই নয়েজের কারণে সার্কিটের গতি কমে যায় এবং অতিরিক্ত তাপ উৎপন্ন হয়।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি একটি বুদ্ধিদীপ্ত পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। তিনি এমন একটি কৌশল তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে সার্কিটের কোন ট্রানজিস্টরগুলো ধীর গতির, তা চিহ্নিত করা যায়। এরপর ‘বডি-বায়াস ইফেক্ট’ নামক একটি কৌশল ব্যবহার করে সেই ধীর ট্রানজিস্টরগুলোকে দ্রুত গতির করা হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে সার্কিটের কার্যকারিতা ৩০-৫০% পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব হয়েছে, যা তাঁর গবেষণার একটি বড় সাফল্য।
অবশ্যই। প্রদত্ত লেখাটিকে উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য আরও সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় করে পুনরায় লিখছি।
কিভাবে কিওটো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেন?
কিওটো বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন পূর্ণকালীন শিক্ষক হওয়া মোটেও সহজ ছিল না। এটি ছিল কঠোর পরিশ্রম ও ধৈর্যের এক দীর্ঘ পথ। জাপানে সরকারি নীতি অনুযায়ী নতুন শিক্ষক পদের সংখ্যা কমে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে কিওটোর মতো বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তবে ড. মাহফুজুল ইসলাম একটি বিশেষ আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামের মাধ্যমে এই কঠিন পথ পাড়ি দেন। ২০১৩ সালে জাপানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি তহবিল চালু করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জাপানে পড়াশোনায় আকৃষ্ট করা। এই প্রকল্পের অধীনে কিওটো বিশ্ববিদ্যালয় ইঞ্জিনিয়ারিং, পদার্থবিদ্যা ও গণিতের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের কিছু কোর্স ইংরেজিতে পড়ানো শুরু করে। এর ফলে ভাষা আর বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বাধা হয়ে থাকল না।
যেহেতু ড. মাহফুজুল ইসলাম জাপানি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই সমান পারদর্শী ছিলেন, তাই বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে একজন বিদেশি গবেষক হিসেবে এই প্রকল্পের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তিনি বলেন, “জাপানে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা কমছে। তাই বিদেশি মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ না করলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিকে থাকবে কীভাবে?”
এভাবেই কিওটো বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের আন্তর্জাতিকীকরণ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং ড. ইসলাম এই অগ্রযাত্রার একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছেন।
জাপানের জীবনদর্শন
জাপানে থাকাকালীন একটি বিশেষ ঘটনা ড. মাহফুজুল ইসলামকে খুব প্রভাবিত করেছিল। তাঁর টেকনোলজি কলেজের একজন সেনসেই (সেনসেই শব্দের অর্থ শিক্ষক, জাপানিজ ভাষায় শিক্ষকদের কে সম্মান করে তাদের নামের পরে সেনসেই বলে সম্মোধন করে) তাঁকে বলেছিলেন, “সব জায়গাতেই ভালো এবং খারাপ, দুই ধরনের পানিই থাকে। তোমার কাজ হলো সেখান থেকে কেবল ভালো পানিটাই পান করা।”
এই সহজ কথাটি তাঁর জীবনের দর্শনকে পুরোপুরি বদলে দেয়। এর পর থেকে তিনি কোনো কিছুকে শুধু সমালোচনা করেন না, আবার অন্ধভাবে প্রশংসাও করেন না। তাঁর মূলমন্ত্র হলো— “যা ভালো, তা গ্রহণ করব, আর যা খারাপ, তা সংশোধনের চেষ্টা করব।”
জাপানের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাই স্কুলের পর সরাসরি হাতে-কলমে কারিগরি ও পেশাগত দক্ষতা শেখানো হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো জাপানের প্রযুক্তিগত উন্নতির জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও শিক্ষার্থীদের জন্য পরামর্শ
ড. মাহফুজ মনে করেন, কম্পিউটিংয়ের ভবিষ্যৎ কেবল ট্রানজিস্টর ছোট করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এখন প্রয়োজন হলো সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যারকে একসাথে তৈরি করা। তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী জিন অ্যামডালের একটি সূত্র (Amdahl’s Law) উল্লেখ করেন। এই সূত্র অনুযায়ী, একটি প্রোগ্রামের একটি ছোট অংশও যদি ধারাবাহিকভাবে কাজ করে, তবে হাজারো প্রসেসর থাকলেও সেই প্রোগ্রামটির সামগ্রিক গতি সেই ছোট অংশটি দ্বারাই সীমিত থাকবে। তাই শুধু কোর বা প্রসেসরের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, বরং প্রোগ্রামটিকেও এমনভাবে সাজাতে হবে, যেন তা সমান্তরালভাবে কাজ করতে পারে।
মুরের সূত্র (Moore’s Law) নিয়ে তিনি বলেন, অনেকেই একসময় ভেবেছিলেন, ট্রানজিস্টর আরও ছোট করা সম্ভব হবে না। কিন্তু সেমিকন্ডাক্টর শিল্প বারবার নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করে এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। তিনি আশা করেন, আগামী ১৫-২০ বছরে আলোক বা চৌম্বকীয় প্রভাবের উপর ভিত্তি করে তৈরি সার্কিট আমাদের প্রযুক্তিতে নতুন বিপ্লব নিয়ে আসবে।
তিনি বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু মূল্যবান বার্তা দিয়েছেন:
- “অ্যাপ্লিকেশন চাইলে বেসিক করো।”: যদি কোনো কিছুতে ভালো ফল পেতে চাও, তাহলে আগে তার মূল ভিত্তিটা শক্ত করো।
- ধৈর্য ধরো: দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার জন্য ধৈর্য ও একাগ্রতা খুবই জরুরি।
- ভাষার বাধাকে গুরুত্ব দাও: বিশেষ করে বিদেশের মাটিতে উচ্চশিক্ষা বা কর্মজীবনে সফল হতে হলে ইংরেজি এবং স্থানীয় ভাষা জানা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
- নিজেই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করো: যদি কোনো সুযোগ না দেখো, তবে নিজেই নতুন কিছু শুরু করো। হয়তো একদিন সেটাই অন্যদের জন্য একটি বড় সুযোগের সেতু হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য পরামর্শ
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের প্রসঙ্গে ড. ইসলাম জানালেন যে, কিওটো বা টোকিওর মতো বড় শহরগুলোতে স্নাতক পর্যায়ে (আন্ডারগ্র্যাজুয়েট) বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখনো কম। তবে মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়ছে।
তিনি বলেন, জাপানের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই একটি কথা শোনা যায়— “আতামা গা ইই” (মাথা ভালো)। অর্থাৎ, জাপানীরা মনে করে বাংলাদেশিরা খুবই মেধাবী এবং পরিশ্রমী।
তবে কিছু সমস্যাও আছে। বিশেষ করে ভাষার বাধা অনেক বাংলাদেশি পরিবারকে জাপান ছেড়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য করে। কারণ, জাপানি ভাষা না জানার কারণে সন্তানদের স্কুলশিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। একই সাথে জাপানের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না যে, এই মুহূর্তে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনার জন্য জাপান সেরা পছন্দ হবে কিনা।
উপসংহার
ড. মাহফুজুল ইসলামের জীবন ও কাজ আমাদের শেখায় যে, বিজ্ঞানের আসল শক্তি লুকিয়ে আছে কৌতূহল, ধৈর্য এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের সমন্বয়ের মধ্যে। তাঁর মতো মানুষেরা প্রমাণ করেন যে, কঠোর পরিশ্রম, কৌতূহল এবং একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে একজন বাংলাদেশি তরুণও বিশ্বের বুকে প্রযুক্তির জগতে একটি অসাধারণ অবদান রাখতে পারে। তাঁর এই যাত্রা উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা, যা তাদের নিজেদের স্বপ্ন পূরণের পথে সাহস যোগাবে।
আপডেট
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫: বর্তমানে ড. মাহফুজুল ইসলাম ইন্সটিটিউট অফ সাইন্স টোকিও তে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিজ্ঞানী অর্গ এর সম্পাদক ড. মশিউর রহমান।
ড. মাহফুজ এর ওয়েবসাইট হল: http://lowpower.iis.u-tokyo.ac.jp/~mahfuzul/
এছাড়াও আরো তথ্য পাবেন নিম্নের সাইটগুলো থেকে,
https://www.linkedin.com/in/akmmahfuzulislam/
https://www.researchgate.net/profile/Mahfuzul_Islam3
প্রযুক্তিগত শব্দগুলির ব্যাখ্যা
১. ট্রানজিস্টর (Transistor) কম্পিউটারের সবচেয়ে ছোট ইলেকট্রনিক অংশ, যেটি সুইচের মতো কাজ করে। বিদ্যুৎপ্রবাহ চালু বা বন্ধ করে ‘০’ আর ‘১’ নামের ডিজিটাল সিগন্যাল তৈরি করে। কোটি কোটি ট্রানজিস্টর একসাথে কাজ করেই কম্পিউটারের মস্তিষ্ক গঠিত হয়।
২. ন্যানোমিটার (Nanometer, nm) দৈর্ঘ্যের একটি অতি ক্ষুদ্র একক। ১ ন্যানোমিটার মানে এক মিটারের এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ (১ মিটারের ১,০০০,০০০,০০০ ভাগের এক ভাগ)। উদাহরণ হিসেবে, মানুষের চুলের ব্যাস প্রায় ৮০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ ন্যানোমিটার।
৩. MOS গেট-অক্সাইড (MOS Gate-Oxide) ট্রানজিস্টরের একটি পাতলা স্তর যা বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণের দরজা হিসেবে কাজ করে। এটি খুব পাতলা কাচের মতো পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়, যাতে কারেন্ট কখন চালু আর কখন বন্ধ হবে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৪. নয়েজ (Noise) বা ইলেকট্রিক্যাল নয়েজ: ইলেকট্রনিক সার্কিটে অবাঞ্ছিত সিগন্যাল বা বিঘ্ন। যেমন রেডিওতে ঝিরঝির শব্দ হয়—তেমনভাবেই ক্ষুদ্র সার্কিটে অনাকাঙ্ক্ষিত বৈদ্যুতিক দোলাচলকে বলা হয় নয়েজ, যা সার্কিটের কাজের গতি ও নির্ভুলতা কমিয়ে দেয়।
৫. ভ্যারিয়েবিলিটি (Variability): প্রতিটি ট্রানজিস্টর একদম একই রকম বানানো গেলেও, ক্ষুদ্র পার্থক্য থেকে গতি বা কারেন্টে তারতম্য ঘটে। এই অমিলকেই বলা হয় ভ্যারিয়েবিলিটি।
৬. বডি–বায়াস ইফেক্ট (Body-Bias Effect): একটি বিশেষ পদ্ধতি যেখানে ট্রানজিস্টরের ভেতরের ভোল্টেজ সামান্য বাড়ানো বা কমানো হয়, যেন যে ট্রানজিস্টর ধীরগতির সে একটু দ্রুত কাজ করে আর যে বেশি কারেন্ট লিক করে, তাকে একটু কমিয়ে আনা যায়।
৭. এলএসআই (Large Scale Integration – LSI): অনেকগুলো (লক্ষ বা কোটি) ট্রানজিস্টর একসাথে বসিয়ে একটি চিপে জটিল সার্কিট বানানোর কৌশল। কম্পিউটার চিপের আসল শক্তি আসে এই এলএসআই থেকে।
৮. পাওয়ার ডেনসিটি (Power Density): একটি ছোট এলাকায় কতটা বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহার বা উৎপন্ন হচ্ছে তার পরিমাপ। এটি বেশি হলে চিপ গরম হয়ে যায়, কুলিংয়ের খরচও বাড়ে।
৯. মুরের সূত্র (Moore’s Law): ১৯৬৫ সালে গর্ডন মুর বলেছিলেন, প্রায় প্রতি দুই বছরে চিপের ট্রানজিস্টরের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে এবং দাম কমবে। অর্থাৎ কম দামে দ্রুততর কম্পিউটার সম্ভব হবে। বহু দশক ধরে এই ধারাটাই কম্পিউটার প্রযুক্তির গতি নির্ধারণ করেছে।
১০. অ্যান্ডালের সূত্র (Amdahl’s Law): কম্পিউটারে যত কোর বা প্রসেসরই যোগ করা হোক না কেন, যদি প্রোগ্রামের কিছু অংশ একসাথে চালানো না যায় (মানে সিরিয়াল থাকে), তবে গতি বাড়ানো সীমিত হবে। এটি বোঝায় যে শুধুমাত্র হার্ডওয়্যার বাড়ালেই কাজের গতি অসীম বাড়বে না।
১১. ৩–ডি ট্রানজিস্টর বা ট্রাই-গেট (3D Transistor / Tri-Gate): প্রচলিত সমতল (প্ল্যানার) ট্রানজিস্টরের বদলে উঁচু-নিচু তিনদিক দিয়ে কারেন্ট প্রবাহের নতুন গঠন। এতে কারেন্ট নিয়ন্ত্রণ ভালো হয় এবং বিদ্যুৎ কম খরচ হয়।
১২. হাই-কে/মেটাল-গেট (High-K/Metal Gate): এক ধরনের বিশেষ পদার্থ দিয়ে তৈরি ট্রানজিস্টরের গেট, যা খুব পাতলা হয়েও কারেন্টের অপচয় বা লিকেজ কমিয়ে দেয়। ফলে চিপ ছোট করলেও বিদ্যুৎ নষ্ট হয় না।
১৩. এজ কম্পিউটিং (Edge Computing): ডেটা প্রক্রিয়াকরণ সরাসরি ডিভাইসের কাছেই (যেমন সেন্সর বা স্মার্টফোনে) করা, যাতে সব ডেটা ক্লাউডে না পাঠিয়ে তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
১৪. ক্লাউড কম্পিউটিং (Cloud Computing): ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূরের বড় সার্ভারে ডেটা সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ করা। এতে নিজের কম্পিউটারে শক্তিশালী প্রসেসর ছাড়াই বড় কাজ করা সম্ভব হয়।
১৫. আইওটি (Internet of Things – IoT): বাসার ফ্রিজ, গাড়ি, ঘড়ি থেকে শুরু করে শিল্পকারখানার মেশিন—সবকিছুকে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত করে তথ্য সংগ্রহ ও আদানপ্রদানের প্রযুক্তি।
১৬. অ্যানালগ বনাম ডিজিটাল সিগন্যাল: অ্যানালগ সিগন্যাল অবিচ্ছিন্ন ঢেউয়ের মতো—যেমন মানুষের কণ্ঠস্বরের তরঙ্গ। ডিজিটাল সিগন্যাল আলাদা আলাদা ধাপে বিভক্ত—যেমন কম্পিউটারের ০ আর ১।
১৭. সুপারকম্পিউটার: অত্যন্ত দ্রুত গতির বিশাল কম্পিউটার, যা কোটি কোটি ক্যালকুলেশন একসাথে করতে পারে। আবহাওয়া পূর্বাভাস, মহাকাশ গবেষণা, বা জটিল বৈজ্ঞানিক হিসাবের জন্য ব্যবহৃত হয়।
১৮. প্লাগ-অ্যান্ড-প্লে ডিভাইস: এমন ডিভাইস যেটি যেকোনো সিস্টেমে লাগিয়েই ব্যবহার করা যায়, আলাদা করে ইনস্টল বা কনফিগার করার দরকার হয় না।
বাংলা বিজ্ঞান পোস্টের জন্য এই সাইটটিতে বারবার আসি। অনেক ভালো লাগা একটি সাইট। ধন্যবাদ এডমিনকে।
good article