ধরুন, আপনি ভিনদেশে গিয়েছেন। নতুন একটি ভাষা শিখছেন—ধরা যাক জার্মান বা জাপানি। একদিন রাস্তা জিজ্ঞেস করলেন একজনকে। সে যা বলল, তার শেষ শব্দটা ছিল ক্রিয়া — অর্থাৎ আসল কাজটা কী সেটা বোঝার জন্য আপনাকে পুরো বাক্য শুনে যেতে হল। আপনি ভাবলেন, “ইশ! বাংলায় হলে তো শুরুতেই বুঝে যেতাম।”
এটা নিছক ভাষাগত পার্থক্য নয়—এটা মস্তিষ্কের চিন্তার পথের পার্থক্য। আপনি যেভাবে ভাবেন, সেটাই গড়ে উঠছে আপনার ভাষার গঠনের উপর নির্ভর করে।
একই রকমের এক ঘটনা ঘটছে একটি ডাচ ক্লাসে। শিক্ষক তার ডাচ ছাত্রদের বললেন, “আজ আমরা একটা বাক্য বিশ্লেষণ করব: ‘আমি গতকাল এই নিবন্ধটি পড়েছি।’” ছাত্ররা বিভ্রান্ত। তাদের চোখে ক্লান্তি, কেননা ডাচ ভাষায় এমন বাক্যের গঠন সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে ক্রিয়া বা verb আসে অনেক দেরিতে — শেষদিকে। ক্লাসে তখন আলোচনা চলছে, বাক্যের কাঠামো কিভাবে আমাদের মস্তিষ্কের ভবিষ্যদ্বাণীর অভ্যাস গড়ে তোলে।
এই ঘটনাটিই তুলে ধরছে এক যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের প্রেক্ষাপট।
ভাষা এবং মস্তিষ্ক: কীভাবে কাজ করে ভবিষ্যদ্বাণী
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সাইকোলিংগুইস্টিকস ইনস্টিটিউটের ভাষাবিজ্ঞানী ড. আন্দ্রেয়া মার্টিনের মতে, “একটি সহজ বাক্য বুঝতেও আমাদের মস্তিষ্ককে অনেক জটিল হিসাব করতে হয়।” উদাহরণস্বরূপ, “আমি গতকাল এই নিবন্ধটি পড়েছি” — এখানে একটি ব্যক্তি (আমি), একটি কাজ (পড়া), একটি বস্তু (নিবন্ধ), এবং একটি সময় (গতকাল) — সব কিছু একত্রে মস্তিষ্ক বুঝে নেয় এক নিমিষে।
সম্প্রতি PLOS Biology-তে প্রকাশিত এক গবেষণায়, ডাচ ভাষাভাষীদের উপর একটি পরীক্ষা চালানো হয়। গবেষকদল জানতে চেয়েছেন, ভিন্ন ভাষার ব্যাকরণগত কাঠামো কি মানুষের চিন্তাভাবনার অভ্যাসে প্রভাব ফেলে? ফলাফলে দেখা যায়, ডাচ ভাষাভাষী ব্যক্তিরা বাক্য শুনে আগেভাগেই ভবিষ্যদ্বাণী করার প্রবণতা রাখেন — বাক্য শেষ হওয়ার আগেই তারা অনুমান করে নিচ্ছেন বাক্যের বাকিটুকু। ইংরেজিভাষীদের ক্ষেত্রে এটি তুলনামূলকভাবে কম।
ভাষার গঠনের পার্থক্য আমাদের প্রসেসিং স্ট্র্যাটেজিও বদলায়
গবেষণার প্রধান লেখক, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির কাস কুপম্যানস বলেন, “ডাচ ভাষায় ‘Because I ate a cookie with chocolate’ বলা হয় ‘Because I a cookie with chocolate ate’। এখানে ক্রিয়া আসে একদম শেষে, ফলে আমাদের মস্তিষ্ক আগে থেকেই বাক্য শেষের অনুমান করে নিতে বাধ্য হয়।”
তবে কুপম্যানস আরও বলেন, “কোন পদ্ধতি ভালো বা খারাপ নয়। মস্তিষ্ক শুধু সংশ্লিষ্ট ভাষার উপযোগে নিজেকে মানিয়ে নেয়।”
কেন দরকার ভাষাভিত্তিক বৈচিত্র্যপূর্ণ গবেষণা
সিটি ইউনিভার্সিটি হংকং-এর ভাষাবিজ্ঞানী জিক্সিং লি, যিনি এই গবেষণায় অংশ নেননি, বলেন, “যদি ভাষাগত মডেল কেবল ইংরেজিভাষী ব্যক্তিদের উপর ভিত্তি করে বানানো হয়, তবে তা মানব চিন্তার বৈচিত্র্যকে উপেক্ষা করে।” তার মতে, চীনা ও ইংরেজি প্রক্রিয়াকরণে মস্তিষ্কের ভিন্ন অঞ্চল সক্রিয় হয় — এবং এই বাস্তবতা বিবেচনায় না নিলে ভাষার বৈজ্ঞানিক মডেল অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
ড. আন্দ্রেয়া মার্টিন বলেন, “আমরা যখন বুঝতে চাই ভাষা কীভাবে কাজ করে, তখন শুধুমাত্র ব্যাকরণ নয় — বরং ভাষার সামাজিক গুরুত্ব ও চিন্তার গঠনও বোঝা জরুরি।”
শেষ কথা: ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি চিন্তার কাঠামোও গড়ে দেয়
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কীভাবে ভাবেন? আপনার মাতৃভাষা কি আপনাকে আগে থেকে অনুমান করতে শেখায়, নাকি আপনি অপেক্ষা করে শুনে বোঝেন বাক্যের মানে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বুঝে নিতে হবে, ভাষা আসলে মস্তিষ্কের চিন্তাধারারই এক প্রতিবিম্ব — এবং সেটি ভাষাভেদে ভিন্ন হতে বাধ্য। তাই ভাষা শিক্ষার সাথে সাথে আমরা হয়তো ভিন্নভাবে ভাবতেও শিখি।
“ভাষার গঠন আমাদের শুধু কথা বলতেই শেখায় না, শেখায় কীভাবে ভাবতে হয়” — ড. আন্দ্রেয়া মার্টিন
পাঠকদের মতামত:
“আমি জাপানিজ ভাষা শিখছি, আর বুঝতে পারছি, তাদের চিন্তা প্রক্রিয়া সত্যিই ভিন্ন। হয়তো ভাষার গঠন আমাদের ভাবনার পথকেই বদলে দেয়।” — আব্দুল্লাহ আল মামুন, ভাষা শিক্ষার্থী
উৎস:
- Scientific American, April 2025
- PLOS Biology, 2025
Leave a comment