ড. তোফাজ্জল ইসলাম
প্রকাশ: বুধবার ১২ নভেম্বর ২০২৫,
আধুনিক জীববিজ্ঞানের এক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব ড. জেমস ডিউই ওয়াটসন। ১৯৫৩ সালে ফ্রান্সিস ক্রিকের সঙ্গে যৌথভাবে ডিএনএ অণুর ডাবল হেলিক্স কাঠামো আবিষ্কার করে তিনি বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।
আধুনিক জীববিজ্ঞানের এক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব ড. জেমস ডিউই ওয়াটসন। ১৯৫৩ সালে ফ্রান্সিস ক্রিকের সঙ্গে যৌথভাবে ডিএনএ অণুর ডাবল হেলিক্স কাঠামো আবিষ্কার করে তিনি বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। এ যুগান্তকারী আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি, ফ্রান্সিস ক্রিক ও মরিস উইলকিন্স ১৯৬২ সালে ফিজিওলজি বা মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তার কাজটি এতটাই মৌলিক ছিল যে এটিকে জীববিজ্ঞানের আধুনিক যুগের সূচনা বলে বর্ণনা করা হয়। তিনি ১৯২৮ সালের ৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৯৭ বছর বয়সে ২০২৫ সালের ৬ নভেম্বর নিউইয়র্কের ইস্ট নর্থপোর্টে মারা যান। আজ বিজ্ঞান জগৎ ড. জেমস ডি ওয়াটসনকে বিদায় জানাচ্ছে। তিনি ছিলেন ডিএনএ ডাবল হেলিক্স কাঠামোর আবিষ্কারের পেছনের অন্যতম অগ্রণী মন, যা জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসার গতিপথ চিরতরে বদলে দিয়েছে।
কিন্তু ওয়াটসনের দীর্ঘ ৯৭ বছরের প্রভাবশালী জীবন শুধু বৈজ্ঞানিক সাফল্যের দ্যুতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তার বিতর্কিত মন্তব্য ও নৈতিক অবস্থান তার অসাধারণ উত্তরাধিকারকে বারবার প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। তবু জেমস ওয়াটসন বা ‘জিম’ শতাব্দীর একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী ও শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানী। মানবসভ্যতার বিকাশ এবং অনাগত বিজ্ঞানেও তার প্রভাব অনেক আলোচিত ও সমালোচিত হবে। এ মহান বিজ্ঞানীর কর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে এ প্রবন্ধে বিজ্ঞানে জেমস ওয়াটসনের গৌরবময় অবদান এবং তার কিছু বিতর্কিত বক্তব্য ও নৈতিক অবস্থান নিয়ে আলোকপাত করব।
শৈশবেই জেমস ডিউই ওয়াটসন বিজ্ঞান ও মানবিক জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। জেমস শিকাগোর সাউথ সাইডে বেড়ে ওঠেন এবং সাউথ শোর হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। একজন অকালপক্ব ছাত্র হিসেবে তিনি ১৯৪০-এর দশকের রেডিও সিরিজ কুইজ কিডসের প্রতিযোগী ছিলেন। রবার্ট হাচিন্সের উদারনীতির কারণে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানেই তিনি কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী আরউইন শ্রোডিঙ্গার কর্তৃক সাধারণ মানুষের জন্য লেখা জীববিজ্ঞান সম্পর্কিত একটি বইয়ের সম্মুখীন হন। ‘What Is Life? The Physical Aspect of the Living Cell’ (জীবন কী? জীবন্ত কোষের ভৌত দিক)’ বইটি তরুণ ওয়াটসনকে নিশ্চিত করে জিনগুলোই জীবন্ত কোষের মূল উপাদান। তিনি ১৯৪৭ সালে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে স্নাতক হওয়ার পর তিনি ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্কুলে যান, যেখানে তিনি এ ক্ষেত্রের দুই কিংবদন্তি, হারম্যান জে মুলার (যিনি ১৯৪৬ সালে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন) ও সালভাডর ই লুরিয়ার দেখা পান। ড. লুরিয়ার তত্ত্বাবধানে ড. ওয়াটসন ১৯৫০ সালে তার ডক্টরেট লাভ করেন। এরপর তিনি কেমব্রিজ ও খ্যাতির দিকে যাত্রা করেন।
তার কর্মজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে, যেখানে তিনি ক্রিকের সঙ্গে পরিচিত হন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ওয়াটসন ফ্রান্সিস ক্রিকের সঙ্গে মিলে ডিএনএর মনোরম ডাবল হেলিক্স মডেলটি প্রস্তাব করেন। তারা ১৯৫৩ সালের ১৫ এপ্রিলে যৌথভাবে নেচার জার্নালে ‘A Structure for Deoxyribose Nucleic Acid’ শীর্ষক মাত্র এক পৃষ্ঠার যুগান্তকারী গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন। ১৫ এপ্রিল প্রতি বছর বিশ্ব ডিএনএ দিবস হিসেবে পালিত হয়। তারা দুজন প্রস্তাব করেন ডিএনএ একটি পেঁচানো মইয়ের মতো আকৃতির, যার বাইরের রেল তৈরি হয়েছে চিনি ও ফসফেট অণু দিয়ে। মইয়ের প্রতিটি ধাপ ডিএনএর চারটি রাসায়নিক বেসের দুটি করে গঠিত—অ্যাডেনিন, থাইমিন, সাইটোসিন ও গুয়ানিন। অ্যাডেনিন সবসময় থাইমিনের সঙ্গে এবং গুয়ানিন সবসময় সাইটোসিনের সঙ্গে জোড় বাঁধে। তারা ব্যাখ্যা করেন কোষের অভ্যন্তরে থাকা উৎসেচকগুলো (এনজাইম) এ পেঁচানো মইটিকে মাঝখান দিয়ে কেটে ফেলতে পারে ও কোষের ভেতরের বেসগুলো ব্যবহার করে একটি ডিএনএ অণু থেকে দুটি নতুন ডিএনএ অণু তৈরি করতে পারে। এ আবিষ্কার প্রকাশ করে কীভাবে জিনগত তথ্য এনকোড, প্রতিলিপিকৃত ও স্থানান্তরিত হয়। এ আবিষ্কার জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ফলে জেনেটিক উত্তরাধিকারের প্রক্রিয়া, প্রোটিন সংশ্লেষণ ও ক্যান্সার চিকিৎসায় মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির মতো যুগান্তকারী উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। এ স্বীকৃতির জন্য ওয়াটসন, ক্রিক ও উইলকিন্সকে ১৯৬২ সালে ফিজিওলজি বা মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। তাদের এ আবিষ্কার আধুনিক জেনেটিকস, জিনোমিকস ও কম্পিউটেশনাল বায়োলজির ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
সেই সময় তারা বলেছিলেন, আমরা জীবনের রহস্য আবিষ্কার করেছি। ডিএনএ ১৮৬৯ সালে আবিষ্কৃত হলেও এটি কোষের জিনগত উপাদান তৈরি করে এ তথ্য বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন ১৯৪৩ সালে। তবে ডিএনএর কাঠামো তখনো রহস্য ছিল। তার এ আবিষ্কার রোগ সৃষ্টিকারী জিনগত মিউটেশন আবিষ্কার, জিনগতভাবে পরিবর্তিত শস্য ডিজাইন ও বর্তমানে ক্রিসপার-কাস জিনোম এডিটিংয়ের মতো আকর্ষণীয় কিন্তু অত্যন্ত নিখুঁত জীবনের কোড পরিবর্তনের প্রযুক্তির পথ খুলে দিয়েছে। জিনোমিকস, জিনোম এডিটিং, সিস্টেম বায়োলজি ও জীবনের কোড পরিবর্তনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে চলমান শিল্প, চিকিৎসা ও কৃষিতে বিপ্লবের ভিত্তি রচনায় জেমস ওয়াটসন সংক্ষেপে জিমের অবদান অবিস্মরণীয়।
ড. ওয়াটসন অবশেষে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ থেকে ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজে চলে যান। যেখানে ১৯৫৫ সালে তিনি হার্ভার্ডে জীববিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি তার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ছাত্রদের মধ্যে একজন তীক্ষ্ণ প্রতিভা-শনাক্তকারী ছিলেন ও ড. হপকিন্সের মতো বেশ কয়েকজন নারীসহ তাদের অনেকের উল্লেখযোগ্য গবেষণা কর্মজীবন শুরু করতে সাহায্য করেছিলেন। ড. হপকিন্সের স্মৃতিচারণ অনুসারে, ড. ওয়াটসন ছিলেন একজন অনুপ্রেরণাদায়ী শিক্ষক, যদিও তার ছাত্রদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে বিড়বিড় করার প্রবণতা ছিল। তিনি বলেন, তার সঙ্গে থাকাটা খুব মজার ছিল, তবে তিনি সহজেই বিরক্ত হয়ে যেতেন এবং যদি বিরক্ত হতেন তবে একটি বাক্যের মাঝেই ঘুরে চলে যেতেন। ১৯৫৬-৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগে মলিকুলার বায়োলজির গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যান।
জেমস ডি. ওয়াটসন (১৯২৮—২০২৫) ছবি: রয়টার্স
এরপর ১৯৬৮ সাল থেকে শুরু করে প্রায় ৩৫ বছর তিনি কোল্ড স্প্রিং হার্বার ল্যাবরেটরির (সিএসএইচএল) পরিচালক, সভাপতি ও আচার্য হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির তহবিল ও গবেষণাকে বিশ্বমানের শীর্ষে নিয়ে যেতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন। ড. ওয়াটসন ১৯৪৮ সালে সিএসএইচএলে প্রথম সফর করেন। এ প্রতিষ্ঠানকে তিনি অবশেষে বৈজ্ঞানিক খ্যাতিতে পুনরুদ্ধার করবেন। সেখানে তিনি ব্যাকটেরিওফোজ বা ফেজের জিনতত্ত্ব নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন। কিন্তু ১৯৬৮ সালে যখন তাকে এটির নেতৃত্ব দেয়ার জন্য নিয়োগ করা হয়, তখন ল্যাবটি তার খ্যাতি হারিয়ে ফেলেছিল। কোল্ড স্প্রিং হার্বার ল্যাবরেটরির সভাপতি ব্রুস স্টিলম্যান ওয়াটসনের কাজকে মূল্যায়ন করে বলেন, ডাবল হেলিক্স কাঠামোর ব্যাখ্যা মেন্ডেল ও ডারউইনের আবিষ্কারের পাশাপাশি জীববিজ্ঞানের তিনটি সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কারের একটি।
ডিএনএর কাঠামো আবিষ্কারের পর ওয়াটসন মলিকুলার বায়োলজি নিয়ে পাঠ্যপুস্তক ‘মলিকুলার বায়োলজি অব দ্য জিন (১৯৬৫) এবং তার বেস্ট সেলিং বই’ দ্য ডাবল হেলিক্স (১৯৬৮) লেখেন, যা তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে। তবু বইটি বিজ্ঞানের সাহিত্য জগতে তাৎক্ষণিকভাবে ক্লাসিক হিসেবে প্রশংসিত হয়। লাইব্রেরি অব কংগ্রেস এটিকে আমেরিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্মের তালিকায় স্থান দিয়েছিল।
ওয়াটসন শুধু এ যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্যই পরিচিত নন; তিনি হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট শুরু করতে ও একে এগিয়ে নিয়ে যেতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৮৮-৯২ সালের মধ্যে এ প্রজেক্ট প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেন, যা ২০০৩ সালে মানব জিনোম ম্যাপিংয়ের কাজ সম্পন্ন করে। ২০০০ সালে মানব জিনগত কোডের তিন বিলিয়ন অক্ষরের একটি তালিকাসহ একটি ওয়ার্কিং ড্রাফট সম্পন্ন হয়। এটি হোয়াইট হাউজ থেকে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও ১০ ডাউনিং স্ট্রিট থেকে প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের টেলিভিশন ঘোষণার মাধ্যমে প্রশংসিত হয়েছিল। জিন পেটেন্ট করার বিষয়ে মতবিরোধের কারণে ড. ওয়াটসন ১৯৯২ সালে প্রকল্পটি ছেড়ে দেন। তিনি জীবনের নীলনকশা পেটেন্ট করার ঘোর বিরোধী ছিলেন।
তার এক পুত্র কৈশোরে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন, যা ডিএনএ সম্পর্কে আরো জানতে ও সম্ভবত ছেলেকে সাহায্য করার আশায় ওয়াটসনকে গবেষণায় আরো বেশি অনুপ্রাণিত করে। জেমস ওয়াটসন সংক্ষেপে ‘জিম’-এর উজ্জ্বল বৈজ্ঞানিক সাফল্যের বিপরীতে রয়েছে গুরুতর নৈতিক প্রশ্ন ও বিতর্কিত মন্তব্য। ১. রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিনের প্রতি অবিচার: ডিএনএর কাঠামো ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ওয়াটসন ও ক্রিক কিংস কলেজ লন্ডনে কর্মরত রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন ও তার সহকর্মীদের সংগৃহীত ডাটা ও ধারণার সহায়তা নিয়েছিলেন। অভিযোগ রয়েছে এ ডাটা—বিশেষ করে ফ্র্যাঙ্কলিনের ছবি-৫১ ও তার গবেষণা অগ্রগতি প্রতিবেদন, ওয়াটসন ও ক্রিক ফ্র্যাঙ্কলিনের অনুমতি বা পূর্ণ স্বীকৃতি ছাড়াই ব্যবহার করেছিলেন। ফ্র্যাঙ্কলিন চার বছর আগেই ওভারিয়ান ক্যান্সারে ৩৭ বছর বয়সে মারা যাওয়ায় তিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতে পারেননি। দ্য ডাবল হেলিক্স বইতে ওয়াটসন ফ্র্যাঙ্কলিনকে নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করেন এবং তার কাজকে ছোট করেন। ফ্র্যাঙ্কলিনের প্রতি তার যে ‘মিসোজিনিস্টিক ট্রিটমেন্ট’ বা নারীবিদ্বেষী আচরণ ছিল, তা বিজ্ঞান ও সমাজের কাছে তার নৈতিক অবস্থান নিয়ে গভীর প্রশ্ন তোলে। দুই. বর্ণবাদী ও শ্রেণীবাদী মন্তব্য: ওয়াটসনের খ্যাতিমান জীবনকে সবচেয়ে বেশি কলঙ্কিত করেছে তার বর্ণবাদী ও শ্রেণীবাদী কিছু মন্তব্য। ২০০৭ সালে তিনি লন্ডনের দ্য সানডে টাইমস ম্যাগাজিনকে বলেন যে তিনি আফ্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই হতাশ। কারণ সব পরীক্ষা বলছে যে কৃষ্ণাঙ্গদের বুদ্ধি শ্বেতাঙ্গদের মতো নয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে গড় আইকিউয়ের পার্থক্য জিনগত কারণে। তার এ মন্তব্যের জেরে ২০০৭ সালে কোল্ড স্প্রিং হার্বার ল্যাবরেটরির ট্রাস্টি বোর্ড তার প্রশাসনিক দায়িত্ব স্থগিত করে ও তিনি আচার্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
এর পরও ২০১৯ সালে একটি ডকুমেন্টারিতে তিনি তার বর্ণবাদী মতামত পুনর্ব্যক্ত করলে সিএসএইচএল তার সব সম্মানসূচক পদবি বাতিল করে এবং তার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। সিএসএইচএল তার এ মন্তব্যগুলোকে অসম্মানজনক ও বিজ্ঞান দ্বারা অসমর্থিত উল্লেখ করে চরম ব্যবস্থা নেয়। প্রতিষ্ঠিত ও আজীবন যুক্ত থাকা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো বিজ্ঞানীকে এভাবে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন করার ঘটনা মানব ইতিহাসে বিরল ও নজিরবিহীন।
এছাড়া তিনি স্থূলতা ও সৌন্দর্যের মতো ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যকে জিনগতভাবে ‘চিকিৎসা’ করার পক্ষে মতামত দেন। তিনি একবার বলেন, যখনই আপনি মোটা লোকদের সাক্ষাৎকার নেন তখন আপনার খারাপ লাগে। কারণ আপনি জানেন আপনি তাদের কাজে নিতে যাচ্ছেন না। তার এসব বক্তব্য বিশ্বব্যাপী ব্যাপক নিন্দা ও সমালোচিত হয়।
বিতর্কের জেরে জেমস ওয়াটসনকে ‘একঘরে’ করে দেয়া হয়েছে দাবি করে ও গবেষণার জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালে তিনি তার নোবেল পদকটি নিলামে তোলেন। তিনি ছিলেন প্রথম জীবিত নোবেল বিজয়ী যিনি তার পদক নিলামে বিক্রি করেন। পদকটি ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়। তবে আশ্চর্যজনকভাবে পদকটির ক্রেতা রুশ ধনকুবের আলিশের উসমানভ পরে পদকটি ওয়াটসনকে ফিরিয়ে দেন।
জেমস ওয়াটসনকে বিচার করতে গেলে তার বৈজ্ঞানিক অবদান ও নৈতিক আচরণের মধ্যে এক তীব্র বৈপরীত্য দেখতে পাওয়া যায়। তিনি আধুনিক জিনতত্ত্বের অন্যতম স্থপতি, যার কাজ চিকিৎসাবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের গতিপথ চিরতরে বদলে দিয়েছে। তবে তার অহংকারী, বিতর্কিত ও বিশেষ করে জাতি ও লিঙ্গ সম্পর্কে তার বৈষম্যমূলক মন্তব্যগুলো সমাজের জন্য বিষাক্ত ছিল। তার মন্তব্যগুলো বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে সামাজিক বৈষম্যকে বৈধতা দেয়ার এক নিন্দনীয় প্রচেষ্টা বলে মনে করা হয়।
ওয়াটসনের জীবন আমাদের দেখায় একজন ব্যক্তি কীভাবে বিজ্ঞানে অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে। অথচ একই সঙ্গে সমাজের নৈতিক মানদণ্ডে ব্যর্থ হতে পারে। জেমস ডিউই ওয়াটসন ডিএনএ ডাবল হেলিক্সের আবিষ্কারক হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন। কিন্তু তার উত্তরাধিকারকে শুধু বৈজ্ঞানিক সাফল্যের মাপকাঠিতে বিচার করা অসম্ভব। একজন বিজ্ঞানীর সামাজিক দায়বদ্ধতা, নৈতিকতা ও মানবিক সংবেদনশীলতাও তার সামগ্রিক মূল্যায়নের অংশ। আধুনিক বিজ্ঞানকে অবশ্যই ওয়াটসনের এ ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে, শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পথে যেন নৈতিকতা ও সহমর্মিতা বিসর্জন না হয়।
ড. তোফাজ্জল ইসলাম: অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফেলো, ফুলব্রাইট, বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমি
তথ্যসূত্র: https://www.bonikbarta.com/editorial/q8OlrMIixek8jNa9

Leave a comment