বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের প্রাক্তন তরুণ গবেষক মো. জাহিন আলম এমন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন, যা ভবিষ্যতে ডাক্তারদের ক্যানসার বা টিউমার আরও নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে সাহায্য করবে। তাঁর এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নাল Healthcare Analytics-এ, যা সারা বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের এক তরুণ বিজ্ঞানী মো. জাহিন আলম এমন এক প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন, যা ভবিষ্যতে ডাক্তারদের শরীরের ভেতরের টিউমার, ফাইব্রোসিস কিংবা প্রদাহ আরও সহজে শনাক্ত করতে সাহায্য করবে। তাঁর এই গবেষণা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের (Johns Hopkins University) PULSE ল্যাব-এ ডক্টরাল গবেষণার পথে তাঁকে নিয়ে গেছে।
কে এই জাহিন আলম?
জাহিন আলম বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (EEE) বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। পড়াশোনার সময় তিনি FujiFilm Healthcare (জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র)-এর সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা করেছেন। তাঁর আগ্রহ বায়োমেডিক্যাল সিগন্যাল ও ইমেজ প্রসেসিং—অর্থাৎ কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক্স ব্যবহার করে মানুষের শরীরের ছবি ও তথ্য বিশ্লেষণ করা। তিনি বিশ্বাস করেন, “চিকিৎসা প্রযুক্তি তখনই সফল, যখন তা সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়।”
আল্ট্রাসাউন্ড ও SWE কীভাবে কাজ করে?
আমরা সবাই আল্ট্রাসাউন্ড শব্দটি চিনি—এটি এমন এক চিকিৎসা পরীক্ষা, যেখানে উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তরঙ্গ শরীরের ভেতর পাঠানো হয় এবং তার প্রতিফলন থেকে ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ছবি তৈরি হয়।
কিন্তু শুধু ছবি দেখলেই সব তথ্য পাওয়া যায় না। কোনো টিস্যু শক্ত না নরম, সেটিও জানা জরুরি, কারণ ক্যানসার বা টিউমারযুক্ত টিস্যু সাধারণত শক্ত হয়।
এই কারণেই তৈরি হয়েছে একটি বিশেষ পদ্ধতি যার নাম Shear Wave Elastography (SWE)। এই পদ্ধতিতে একধরনের ক্ষুদ্র কম্পন বা shear wave শরীরের ভেতরে পাঠানো হয়। এই তরঙ্গ পাশের দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তার গতি (shear wave speed) থেকে বোঝা যায় টিস্যুটি কতটা শক্ত বা নরম। তরঙ্গ যত দ্রুত যাবে, টিস্যু তত শক্ত—এটাই মূল ধারণা।
তাই SWE হলো এমন এক non-invasive (অর্থাৎ অস্ত্রোপচার ছাড়া), real-time (অর্থাৎ সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়) এবং সাশ্রয়ী প্রযুক্তি, যা অনেক উন্নত দেশে চিকিৎসকদের নিয়মিত ব্যবহার্য।

সমস্যাটা কোথায় ছিল?
যদিও SWE প্রযুক্তি খুব কার্যকর, তবুও এতে কিছু বড় সমস্যা ছিল। যখন শরীরের ভেতরে শব্দ তরঙ্গ পাঠানো হয়, তখন সেটি অনেক জায়গায় প্রতিফলিত হয় বা মিশে যায়, যার ফলে noise তৈরি হয়—মানে ভুল বা অপ্রয়োজনীয় সিগন্যাল।
এই নয়েজ বা প্রতিফলন তরঙ্গের সঠিক গতি মাপতে বাধা দেয়। অনেক সময় কম্পিউটার ভুল করে ধরে নেয় কোনো মিথ্যা সিগন্যালই আসল তরঙ্গ, ফলে ভুল ফলাফল পাওয়া যায়।

জাহিন আলমের নতুন সমাধান
এই সমস্যাগুলো দূর করার জন্য জাহিন আলম তাঁর স্নাতকোত্তর গবেষণায় তৈরি করেছেন এক নতুন গণিত-ভিত্তিক পদ্ধতি, যার নাম Constrained Optimization ভিত্তিক Shear Wave Speed Estimation।
সহজভাবে বললে, এই পদ্ধতিতে কম্পিউটার শুধুমাত্র এক জায়গার ডেটা না দেখে, পাশের অঞ্চলগুলোর ডেটাও একসাথে বিশ্লেষণ করে। এতে করে যদি কোনো অংশে নয়েজ বা বিকৃতি থাকে, পাশের তথ্য তা ঠিক করে দেয়। ফলে ফলাফল হয় অনেক বেশি নির্ভুল ও স্থিতিশীল।
এই পদ্ধতিতে তিনি আরও একটি নতুন ধাপ যোগ করেছেন—Time-Lateral Plane Cleaning। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যা SWE ডেটা থেকে মিথ্যা সিগন্যাল বা প্রতিফলন সরিয়ে দেয়। ফলে শুধু আসল তরঙ্গের তথ্যই বিশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়।
এইভাবে তাঁর তৈরি সিস্টেমটি noise-resistant, অর্থাৎ নয়েজ বা প্রতিধ্বনির প্রভাব থেকে অনেক বেশি সুরক্ষিত।

পরীক্ষায় কী দেখা গেছে?
জাহিন আলম এই নতুন পদ্ধতি পরীক্ষা করেছেন বিভিন্ন ডেটাসেটে—
একটি ডিজিটাল সিমুলেশন ডেটা, এবং আরও তিনটি পরীক্ষামূলক ফ্যান্টম ডেটাসেট, যেমন Mayo Clinic ও RSNA-QIBA থেকে সংগৃহীত।
সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তাঁর তৈরি মডেলটি আগের পাঁচটি প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় অনেক বেশি সঠিক (accurate) এবং নির্ভরযোগ্য (robust) ফলাফল দেয়।
এটি তৈরি করে একদম পরিষ্কার stiffness map, যা চিকিৎসকদের শরীরের ভেতরের কঠিন ও নরম অংশগুলো সহজে আলাদা করতে সাহায্য করে।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
এই আবিষ্কার শুধু একটি গবেষণাপত্র নয়, এটি ভবিষ্যতের চিকিৎসা ব্যবস্থার এক দিকনির্দেশনা। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ডাক্তাররা এখন লিভার, স্তন, প্রোস্টেট এমনকি পেশি ও টেন্ডন-এর মতো টিস্যুর রোগ আরও দ্রুত ও স্পষ্টভাবে নির্ণয় করতে পারবেন। সবচেয়ে বড় কথা—এটি সাশ্রয়ী, বাস্তবায়নযোগ্য, এবং বাংলাদেশের মতো দেশেও প্রয়োগযোগ্য।
উপসংহার
বুয়েটের গবেষণাগার থেকে শুরু করে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান জনস হপকিন্স পর্যন্ত জাহিন আলমের যাত্রা প্রমাণ করে—বাংলাদেশের তরুণরাও বিশ্বমানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সক্ষম।
তিনি দেখিয়েছেন, মেধা ও পরিশ্রম থাকলে পৃথিবীর যেকোনো ল্যাব থেকে নতুন ইতিহাস লেখা সম্ভব।
তাঁর এই কাজ কেবল চিকিৎসা প্রযুক্তির উন্নতিতেই নয়, বাংলাদেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের জন্যও এক অনুপ্রেরণার প্রতীক।
উল্লেখ্য ২০২৪ সনে বিজ্ঞানী জাহিন এর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় বিজ্ঞানী অর্গ এ যেখানে তিনি তার গবেষণা সমন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বিস্তারিত পড়ুন: https://biggani.org/jahin-alam/

Leave a comment