সন্ধ্যা সাতটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বসে শুভ চেষ্টা করছে আগামিকালের পরীক্ষার জন্য পড়তে। মোবাইল ফোনটা পাশে রাখা, কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে, একটা মিনিট ফেসবুক চেক করি। “এক মিনিটে কিছুই হবে না,” ভেবে সে স্ক্রল করতে শুরু করল। একটা পোস্ট, দুটো কমেন্ট, একটা ভিডিও… এরপরে শুরু হল ট্রেন্ডিং রিলস, ভাইরাল নিউজ, মজার ভিডিও… শুভ বুঝতেই পারল না, সময় কখন কেটে গেল। এভাবেই কেটে গেল ৪০ মিনিট!
মাথায় হাত দিয়ে শুভ ভাবল, “এই এত সময় কোথায় চলে গেল?“
আপনি কি কখনো এমন অভিজ্ঞতা পেয়েছেন? আপনি ঠিক করলেন মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য ফোনে ঢুঁ মারবেন, কিন্তু সেটা কখন ঘন্টার পর ঘন্টা হয়ে যায়, তা টেরও পান না!
আপনি কি কখনো ভেবেছেন, প্রতিদিন কতটা অপ্রয়োজনীয় তথ্য আপনার মাথায় প্রবেশ করছে, যা আপনাকে ধীরে ধীরে অন্যমনস্ক করে তুলছে? আপনি একা নন। একটি পরিসংখ্যান বলছে, গড়পড়তা একজন মানুষ দিনে প্রায় ৭ ঘণ্টা ৫৮ মিনিট ইন্টারনেটে কাটান। এর মধ্যে ২ ঘণ্টা ২৭ মিনিট শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায়! (Source: Global Digital Report 2023)
এই তথ্য অতিরিক্ত গ্রহণের প্রবণতাকে বলে ইনফরমেশন ওভারলোড। আর এটা আমাদের প্রোডাক্টিভিটিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
তথ্যের স্রোতে ডুবে যাওয়া মস্তিষ্ক
একটা সময় মানুষ তথ্যের অভাবে ভুগতো। তখন আমরা চেষ্টা করতাম কিভাবে আরো তথ্য সংগ্রহ করা যায়। এখন উল্টো সমস্যা—তথ্যের অতিরিক্ত জটলা। ২০০০ সালের পর থেকে মানুষের গড় মনোযোগের সময় ক্রমাগত কমছে। মাইক্রোসফটের এক গবেষণা বলছে, মানুষের মনোযোগ ধরে রাখার গড় সময় মাত্র ৮ সেকেন্ড! (Source: Microsoft Study)
এর ফলে কী হচ্ছে?
- আমরা অনেক কিছু জানছি, কিন্তু গভীরভাবে বুঝতে পারছি না।
- অপ্রয়োজনীয় তথ্যের কারণে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
- আমাদের একাগ্রতা কমছে, পড়াশোনা বা কাজের সময় সহজেই মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
Harvard Business Review-এর গবেষণায় দেখা গেছে, যারা অপ্রয়োজনীয় তথ্য কম গ্রহণ করেন, তারা ২৫% বেশি উৎপাদনশীল।
তাহলে কি তথ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া উচিত? একদমই না! বরং তথ্য গ্রহণের একটি স্বাস্থ্যকর কৌশল অবলম্বন করতে হবে, যাকে বলা হয় “ইনফরমেশন ডায়েট”।
ইনফরমেশন ডায়েট কী?
“ইনফরমেশন ডায়েট” হলো সঠিক তথ্য বেছে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। যেমন আমরা শরীর সুস্থ রাখতে ভালো খাবার খাই, তেমনি মস্তিষ্ক সুস্থ রাখতে ভালো এবং প্রয়োজনীয় তথ্য গ্রহণ করতে হবে।
একজন ভালো ইনফরমেশন ডায়েট অনুসারী যা করে—
✅ ফিল্টার করে – অপ্রয়োজনীয় বা বিভ্রান্তিকর তথ্য এড়িয়ে চলে।
✅ সিলেক্টিভ কনজাম্পশন করে – প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনে মনোযোগ দেয়।
✅ ডিজিটাল হাইজিন মেনে চলে – সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় সীমিত রাখে।
✅ ডিপ ওয়ার্ক করে – একবারে একটি কাজে ফোকাস রাখে।
কীভাবে ইনফরমেশন ডায়েট শুরু করবেন?
শুভ ঠিক করল, এবার থেকে সে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করবে। কীভাবে?
📌 নোটিফিকেশন বন্ধ করুন –
মোবাইল ফোনের নোটিফিকেশন আমাদের মনোযোগ ভাঙার সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষ প্রতি ১১ মিনিটে একবার নতুন নোটিফিকেশন বা মেসেজ চেক করে, এবং এতে উৎপাদনশীলতা প্রায় ৪০% কমে যেতে পারে। (Source: University of California, Irvine)
➡ করণীয়: অপ্রয়োজনীয় অ্যাপগুলোর নোটিফিকেশন বন্ধ করুন, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া এবং নিউজ অ্যাপগুলোর।
📌 একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন –
একজন সাধারণ মানুষ দিনে ২ ঘণ্টা ২৭ মিনিট সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যয় করে, যা বছরে প্রায় ৩৭ দিন! (Source: Global Digital Report 2023)
➡ করণীয়: একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন, যেমন দিনে ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যয় করার জন্য টাইমার সেট করুন।
📌 গঠনমূলক কনটেন্ট পড়ুন –
অনেক সময় ভাইরাল ভিডিও, ট্রেন্ডিং মিম বা গসিপ নিউজ দেখে সময় নষ্ট হয়ে যায়। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষণা বলছে, গঠনমূলক কনটেন্ট পড়লে মস্তিষ্কের নিউরোনাল সংযোগ শক্তিশালী হয়, যা চিন্তা-ভাবনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ায়।
➡ করণীয়: গবেষণা পেপার, বই, বা শিক্ষামূলক ভিডিও দেখা অভ্যাস করুন, যা ব্যক্তিগত দক্ষতা বাড়াবে।
📌 ডিজিটাল ডিটক্স করুন –
ডিজিটাল ওভারলোড থেকে মুক্তির জন্য সপ্তাহে অন্তত একদিন ইন্টারনেট ছাড়া সময় কাটানো দরকার। এটি মানসিক চাপ কমায় এবং একাগ্রতা বৃদ্ধি করে।
➡ করণীয়: প্রতি সপ্তাহে ‘No Internet Day’ পালন করুন—এই দিনটিতে বই পড়ুন, প্রকৃতির মাঝে সময় কাটান বা কোনো নতুন দক্ষতা শিখুন।
এই অভ্যাসগুলো আপনাকে স্মার্ট ইনফরমেশন ইউজার হতে সাহায্য করবে। 😊 আপনি চাইলে এগুলো আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি!
বিশ্বের সফল ব্যক্তিরা যেমন—স্টিভ জবস, বিল গেটস, এলন মাস্ক—তারা সবসময় তাদের তথ্য গ্রহণের প্যাটার্নকে কন্ট্রোল করতেন। তারা অপ্রয়োজনীয় তথ্য থেকে দূরে থাকতেন এবং শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় তথ্যকেই গুরুত্ব দিতেন।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা বলছে, আমাদের গ্রহণ করা তথ্যের মাত্র ৩০% আসলেই দরকারি, বাকিটা অপ্রয়োজনীয়। (Source: Harvard Business Review)
তাহলে আর দেরি কেন? আজ থেকেই আপনার ইনফরমেশন ডায়েট শুরু করুন! মনে রাখবেন, অপ্রয়োজনীয় তথ্য আপনার মস্তিষ্কের জন্য একটি ভারী বোঝা।
আপনার চিন্তাধারাকে বদলাতে এখনই উদ্যোগ নিন। আপনি কি প্রস্তুত? 🚀
Leave a comment