অর্থনীতিইতিহাসের এই দিনে

ইতিহাসের জ্যোতির্ময় পথিক: ইবনে খালদুন ও সভ্যতার তাত্ত্বিক ভাস্কর্য

Share
Share

প্রথম অংশ: গল্পের ভেতরে প্রবেশ


গভীর রাতে যখন মরুপ্রান্তরের নিঃসীম নীরবতা ভেঙে উটের পায়ের শব্দ শোনা যেত, তখন তিনি বসে থাকতেন ধূসর বাতির আলোয়—চোখে স্বপ্ন আর কলমে ইতিহাস। তাঁর নাম ইবনে খালদুন। মরক্কোর নীরব মরুভূমি থেকে শুরু করে মিশরের ব্যস্ত নগরজীবন পর্যন্ত, এই অসামান্য পণ্ডিতের পথচলা ছিল একদিকে জ্ঞান-তৃষ্ণার খোঁজ, অন্যদিকে ইslamic ভাবধারার ভিত নির্মাণের প্রয়াস। ছোটবেলার সেই উত্তাল দিনের স্মৃতিগুলো বুকে নিয়ে তিনি চেয়েছিলেন এমন এক সংস্কৃতি ও সভ্যতার ভিত্তি গড়তে, যার কথা আগে কেউ ভাবেনি। যে পথেই তাঁর পদচিহ্ন, সেখানেই বুদ্ধিবৃত্তিক আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সমাজ, ইতিহাস আর অর্থনীতির জগৎ।

দ্বিতীয় অংশ: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বিশ্লেষণ

ইবনে খালদুনকে অনেকে “সামাজিক বিজ্ঞানের জনক” বলে থাকেন, আবার কেউ বলেন “আধুনিক ইতিহাসবিদদের পথপ্রদর্শক।” তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল-মুকাদ্দিমাহ (‘আল-মুকাদ্দিমাহ’ বা Muqaddimah)—ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, এবং রাজনীতি নিয়ে অনবদ্য বিশ্লেষণ। এখানে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে একটি সভ্যতা উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে চলে এবং তার পেছনে কাজ করে নানা সামাজিক আর অর্থনৈতিক কারণ।

আধুনিক ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি একবার বলেছিলেন, “ইবনে খালদুন সেই সব মহাপুরুষদের একজন, যিনি আজও আমাদের ইতিহাসচর্চার সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠে, কীভাবে ইবনে খালদুনের চিন্তাধারা সময়ের সীমানা ভেঙে আজ পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়ে গেছে।

বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার ড. মোস্তাফা কামাল বলেন, “ইবনে খালদুন শুধু মুসলিম বিশ্বে নয়, সমগ্র মানবজাতির জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর তাত্ত্বিক কাঠামো সমাজ ও রাজনীতির গভীরতম স্তর ব্যাখ্যা করতে আজও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।”

তৃতীয় অংশ: পাঠকের অভিমত

গতকাল রাজধানীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইবনে খালদুনকে নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে শিক্ষার্থী ও সাধারণ পাঠকদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সেমিনারে অংশগ্রহণকারী আবদুল্লাহ হাসান, একজন তরুণ গবেষক, আমাদের প্রতিবেদককে বলেন, “ইবনে খালদুনের রচনা পড়তে গিয়ে আমি উপলব্ধি করেছি, কতটা আগে থেকেই তিনি সমাজের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে পেরেছিলেন। তাঁর ধারণাগুলো আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায়ও প্রাসঙ্গিক।”

তরুণ সমাজবিজ্ঞানীরাও বলছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক পরিবর্তন নিরীক্ষায় ইবনে খালদুনের তত্ত্বগুলো নতুন আলোকপাত করতে পারে। স্থানীয় একজন বিশ্লেষকের ভাষ্য, “শুধু অতীত নয়, সমকালীন বিশ্বেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবতার সঙ্গে অসাধারণভাবে মিলে যায়। আমরা তাঁর তত্ত্ব ব্যবহার করে নিজস্ব সমাজব্যবস্থার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারি।”

চতুর্থ অংশ: সামনের পথচলা ও গুরুত্ব

ইবনে খালদুনের চিন্তা ও বিশ্লেষণ প্রাচ্য-পাশ্চাত্য উভয় জগতেই মূল্যবান। তাঁর গবেষণাপত্র ও বইগুলোতে বারবার উঠে আসে সামাজিক বন্ধন, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এবং নৈতিকতা—যা শুধুমাত্র ইসলামিক সভ্যতার ভিত নয়, বরং যে কোনো জনপদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চর্চা।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সংকট, ধর্মীয় সহাবস্থান, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব—এসব জটিল সমীকরণে ইবনে খালদুনের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক উত্তরের সন্ধান দিতে পারে। তাঁর তাত্ত্বিক কাঠামো শুধু বইয়ের পাতা আর একাডেমিক আলাপের মধ্যেই আটকে না রেখে, বাস্তব জীবনেও প্রয়োগ করতে পারলে সমাজের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা সহজতর হবে।

পঞ্চম অংশ: উপসংহার

ইবনে খালদুনের জীবনকাহিনি মরুভূমির বুকে ভেসে ওঠা এক শাশ্বত আলোর মতো—যেখানে দুঃসহ প্রতিকূলতার মধ্যেও মানুষের চিন্তা, গবেষণা এবং সৃষ্টিশীলতার বিজয়গাথা লেখা হয়েছিল। ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি আর সমাজগত বিশ্লেষণের এক অভূতপূর্ব সমন্বয়ে তিনি স্থাপন করেছিলেন এক নতুন জ্ঞান-ভিত্তি, যা কেবল মুসলিম সভ্যতার নয়, সমগ্র মানবসভ্যতার অমূল্য সম্পদ। যুগ পেরিয়ে গেলেও এই মনীষীর আলো আজও অসামান্যভাবে আলোড়িত করে জ্ঞানপিপাসু মনকে।

সেই গভীর রাতের উটের পায়ের শব্দের মতোই তাঁর চিন্তার ধ্বনি এখনো আমাদের বিবেকের দরজায় কড়া নাড়ে। ইতিহাস পড়তে গেলে, সমাজের নির্মাণ আর ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়া বুঝতে গেলে, এমনকি অর্থনীতির বহুস্তরে স্থিতিশীলতা খুঁজতে গেলে—ইবনে খালদুনের কাছে আমাদের ফিরে যেতেই হয়। হয়তো তাঁকে স্মরণ করার মধ্যে নিহিত আছে আমাদের আগামী দিনের পথচলা এবং উন্নয়নের মূলমন্ত্র।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
ইতিহাসের এই দিনেবিজ্ঞানীদের জীবনী

আব্বাস ফারনাস: আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে ঋদ্ধ এক মুসলিম কিংবদন্তি

নবম শতাব্দীর মুসলিম বহুবিদ্বান আব্বাস ইবনে ফিরনাসের অনুপ্রেরণামূলক গল্পটি আবিষ্কার করুন -...

ইতিহাসের এই দিনেকলাম

কলাম: আল তুসো: ইতিহাসের গভীর থেকে আধুনিক আলোচনার অগ্রভাগে

ঐতিহ্যের সাথে আধুনিক শৈল্পিকতার মিশ্রণে উদ্ভাবনী মোমের ভাস্কর্যের মাধ্যমে "আল তুসো" কীভাবে...

ইতিহাসের এই দিনেবিজ্ঞানীদের জীবনী

আল বিরুনি: ইতিহাসের ধুলো ঝেড়ে জেগে উঠা এক জ্ঞানযাত্রার নক্ষত্র

আল বিরুনির অসাধারণ জীবন এবং অবদান অন্বেষণ করুন - একজন মধ্যযুগীয় মুসলিম...

অর্থনীতিউচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ

কেন তরুণরা সুখের সংকটে ভুগছে?

তরুণরা কেন সুখের সাথে লড়াই করছে? তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক...

অর্থনীতিকলাম

ড. ইয়াসুইউকি সাওয়াদা সেমিনার: বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ পথচলার উপর পর্যালোচনা

সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (ADB) সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং জাপানি সরকারে গুরুত্বপূর্ণ...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.