বিজ্ঞান মানেই কি শুধু পরিমিত তথ্য, নির্ভুল সূত্র আর গবেষণাগারের নীরবতা? নাকি বিজ্ঞান হচ্ছে একধরনের মনোবিদ্যার অনুশীলন, যেখানে কল্পনা আর সংশয় একসঙ্গে পথচলা করে? ফ্রিম্যান ডাইসন, বিশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, তার প্রবন্ধ সংকলন The Scientist as Rebel–এ এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজেছেন। তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন এমন এক বিজ্ঞানীর চিত্র, যিনি বিদ্রোহ করেন প্রচলিত চিন্তার বিরুদ্ধে, যারা শুধু নিয়ম মানেন না—নতুন নিয়ম সৃষ্টি করেন। ডাইসনের এই চিন্তা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, যেখানে বিজ্ঞান এখনো অনেকাংশেই পাঠ্যবই আর পরীক্ষার ঘেরাটোপে বন্দি।
ডাইসনের যুক্তির মূলভিত্তি হলো—যে বিজ্ঞানী কেবল প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুন মেনে চলে, সে সত্যিকারের বিজ্ঞানী হতে পারে না। বিজ্ঞান জন্ম নিয়েছে প্রশ্ন থেকে, আর প্রশ্ন করার মানেই হলো সংশয় প্রকাশ করা। গ্যালিলিও যখন বলেছিলেন পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘোরে, তখন তিনি কেবল একটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় তত্ত্ব দেননি, বরং বিদ্রোহ করেছিলেন ধর্মীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে। আইনস্টাইন যখন নিউটনের স্থির মহাকাশের ধারণা চ্যালেঞ্জ করেন, তখন তা ছিল একটি বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি। ডাইসনের মতে, এসব উদাহরণই প্রমাণ করে যে, সত্যিকার বৈজ্ঞানিক চিন্তা একটি সৃষ্টিশীল বিদ্রোহ।
এই বিদ্রোহ, অবশ্যই, সুনির্দিষ্ট কাঠামোর ভেতরেই ঘটে। এটি কখনোই উন্মাদনা বা চরমপন্থা নয়। বরং এটি এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা, যেখানে নতুন প্রশ্ন তোলা হয় পুরোনো উত্তরগুলোর বিরুদ্ধে। ডাইসন দেখিয়েছেন, বিজ্ঞানীরা কেবল গবেষণাগারে কাজ করেন না, তারা সংস্কৃতি, রাজনীতি ও দর্শনের সঙ্গেও জড়িত। তার মতে, যারা সমাজের গঠনমূলক সমালোচনা করেন, তারাই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যান। বিজ্ঞানীরাও সেই কাজটিই করেন, শুধু একটু ভিন্ন কৌশলে—তারা অদৃশ্য জগতের গোপন বার্তাগুলো উন্মোচন করেন।
ফ্রিম্যান ডাইসনের এই ধারণা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে বর্তমান পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে, যেখানে বিজ্ঞানকে প্রায়ই কেবল প্রযুক্তির দাস করে ফেলা হচ্ছে। আমরা যেন ভুলে যাচ্ছি—বিজ্ঞান একটি মানবিক প্রচেষ্টা। সেটি কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার নয়, বরং নৈতিক, বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির অংশ। যখন একজন বিজ্ঞানী নির্ভীকভাবে বলেন, “আমি জানি না”—তখন সেটাই বিজ্ঞানচর্চার মূল শক্তি। কারণ সত্যিকারের জ্ঞানীরাই জানেন, অজানা জগত কত বিশাল।
ডাইসনের প্রবন্ধগুলোতে বারবার উঠে আসে একটি অভিন্ন সুর—স্বাধীন চিন্তার অপরিহার্যতা। তিনি কেবল আধুনিক বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নয়, বিজ্ঞানের রাজনৈতিক ব্যবহারের দিকেও তীব্র সমালোচনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা কিংবা বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নজরদারির নীতিকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন। এতে বোঝা যায়, ডাইসন কেবল তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক প্রকার নৈতিক দার্শনিক। তার চোখে বিজ্ঞান ছিল মানবিক মূল্যবোধ আর স্বাধীনতার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে বিজ্ঞানচর্চা এখনো খুব সীমিত পরিসরে হয়, ডাইসনের চিন্তা এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ঝাঁকুনি দিতে পারে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো মুখস্থনির্ভর, যেখানে পরীক্ষায় ভালো ফল করাই মেধার একমাত্র মানদণ্ড। এর বিপরীতে ডাইসন আমাদের মনে করিয়ে দেন, মেধা মানে কেবল তথ্য ধারণ নয়, বরং নতুন করে চিন্তা করার সাহস। যদি আমরা সত্যিই চাই যে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা গবেষক বা বিজ্ঞানী হোক, তবে তাদের শেখাতে হবে কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়, কীভাবে নিজের যুক্তি দিয়ে তর্ক গড়ে তুলতে হয়, কীভাবে প্রচলিত ভাবনার বাইরে চিন্তা করা যায়।
ফ্রিম্যান ডাইসন নিজেও কোনো নির্দিষ্ট পথে চলেননি। তিনি ছিলেন একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের বাইরের মানুষ, তবুও তিনি গণিত, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, এমনকি সাহিত্য ও দর্শনের ক্ষেত্রেও নিজস্ব অবদান রেখেছেন। তার এই বহুমাত্রিক চিন্তা আমাদের শেখায়—বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নয়, কৌতূহলই প্রকৃত বিদ্যার উৎস। যে সমাজ কৌতূহলকে দমন করে, সে কখনোই সৃজনশীল বিজ্ঞান সৃষ্টি করতে পারে না।
আজকের পৃথিবীতে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জিন সম্পাদনা বা মহাকাশযাত্রা আমাদের নিত্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেখানে বিজ্ঞানকে কেবল পেশা হিসেবে দেখলে চলবে না। বিজ্ঞান হতে হবে একধরনের নৈতিক দায়িত্ব। ডাইসনের দৃষ্টিভঙ্গি এখানে আমাদের চোখ খুলে দেয়। তিনি বলেন, বিজ্ঞানীকে অবশ্যই সমাজের প্রশ্ন করতে হবে—তুমি কোন পথে চলছো? কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করছো, আর তা কার স্বার্থে? এই আত্মজিজ্ঞাসাই বিজ্ঞানকে করে তোলে মানবিক।
এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের জন্য The Scientist as Rebel একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক পাঠ্য। এটি কেবল বিজ্ঞানীদের জন্য নয়, যে কোনো চিন্তাশীল নাগরিকের জন্যই প্রেরণার উৎস হতে পারে। কারণ, এই বইয়ের প্রতিটি প্রবন্ধ একটি মৌলিক বার্তা দেয়—যদি তুমি সত্য খুঁজতে চাও, তাহলে প্রতিষ্ঠিত মতবাদকে প্রশ্ন করতে শিখো। বিদ্রোহ করো, কিন্তু তা হোক যুক্তির মাধ্যমে। সন্দেহ করো, কিন্তু তা হোক অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে।
শেষ পর্যন্ত, ফ্রিম্যান ডাইসনের বিজ্ঞানচিন্তা আমাদের শেখায়—সর্বোচ্চ সত্যের পথ কখনোই সোজা নয়। সেখানে পদে পদে রয়েছে সংশয়, তর্ক, প্রতিবাদ এবং অজানার প্রতি এক অন্তহীন আকর্ষণ। এই পথে হাঁটতেই বিজ্ঞানীর জন্ম। আর যারা সত্যিকারের বিজ্ঞানী হতে চায়, তাদের উচিত নিজেকে মাঝে মাঝে বিদ্রোহী ভাবা—ভাবা, যদি আমি ভিন্নভাবে চিন্তা করি, তবে কী ঘটতে পারে?
বিজ্ঞানকে যদি আমরা নিছক প্রযুক্তিগত অর্জনের পদ্ধতি হিসেবে দেখি, তবে আমরা তার আত্মাকে হারিয়ে ফেলি। ডাইসনের লেখা আমাদের সেই আত্মার খোঁজে ফেরত পাঠায়—সেই বিদ্রোহী আত্মা, যা নিঃশব্দে বলে ওঠে, “তুমি যা জানো, তা-ই শেষ কথা নয়।” এভাবেই বিজ্ঞান সত্যিকার অর্থে মানবিক হয়ে ওঠে।
Leave a comment