পরিবেশ ও পৃথিবী

বন্যাত্তোর মৎস্য সেক্টরে করণীয়!মোঃ ইয়ামিন হোসেন!

Share
Share

প্রফেসর ড. মোহা: ইয়ামিন হোসেন

ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

বন্যার পরে মৎস্য খাতের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বন্যা মাছ চাষের পুকুর ও জলাশয়ে ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে। সঠিক পদক্ষেপ না নিলে মাছ চাষে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি জলজ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। নিচে বন্যাত্তোর মৎস্য খাতের ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. পুকুর ও জলাশয়ের পরিস্কার ও মেরামত:

বন্যার ফলে পুকুরের পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং পুকুরে মাটি, আবর্জনা, কাদা ইত্যাদি জমা হতে পারে। প্রথমেই পুকুরের পাড় মেরামত করতে হবে যাতে পরবর্তীতে পানি বের হতে না পারে। পুকুর ও জলাশয় থেকে আবর্জনা এবং কাদা পরিষ্কার করতে হবে এবং পুকুরের তলদেশে জমা বিষাক্ত পদার্থগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে।

২. পুকুরের পানি পরীক্ষা:

বন্যার কারণে পুকুরের পানির মান পরিবর্তিত হতে পারে। পানির পিএইচ মাত্রা, অক্সিজেনের মাত্রা, অ্যামোনিয়া, নাইট্রেট ইত্যাদির উপস্থিতি পরীক্ষার মাধ্যমে পানি চাষ উপযোগী কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। যদি পানির গুণগত মান চাষের জন্য অনুপযুক্ত হয়, তবে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক বা প্রাকৃতিক পদার্থ যোগ করে পানির গুণগত মান উন্নত করতে হবে।

৩. মাছের রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:

বন্যার পরে মাছের রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে পারে। বন্যার পানি থেকে আসা ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস এবং ভাইরাসের কারণে মাছের রোগবালাই দেখা দিতে পারে। মাছের স্বাস্থ্য নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত এবং প্রয়োজন হলে মাছের জন্য এন্টিবায়োটিক বা প্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। রোগ প্রতিরোধে সঠিক পরিমাণে চুন ও লবণ ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪. নতুন করে পোনা সংগ্রহ ও অবমুক্তকরণ:

বন্যার কারণে পুকুরের অনেক মাছ ভেসে যেতে পারে বা মারা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নতুন করে পোনা সংগ্রহ এবং পুকুরে অবমুক্ত করা জরুরি। ভালো মানের এবং দ্রুত বৃদ্ধি প্রাপ্ত পোনা সংগ্রহ করে পুকুরে অবমুক্ত করতে হবে। স্থানীয় মৎস্য অফিস থেকে উন্নত জাতের পোনা সংগ্রহ করা যেতে পারে।

৫. পুকুরে সঠিক পরিমাণে খাবার প্রদান:

বন্যার পরে পুকুরে মাছের খাবারের প্রাপ্যতা কমে যেতে পারে, তাই মাছের চাহিদা অনুযায়ী উপযুক্ত খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। মাছের দ্রুত বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যের জন্য সঠিক মাত্রায় প্রোটিন, ভিটামিন এবং খনিজ উপাদানযুক্ত খাবার সরবরাহ করতে হবে।

৬. জলাশয়ে অক্সিজেন সরবরাহ:

বন্যার পরে পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যেতে পারে। এক্ষেত্রে পুকুরের পানিতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। মেকানিক্যাল এরেটর (যান্ত্রিক অক্সিজেন সরবরাহ যন্ত্র) ব্যবহার করে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ানো যেতে পারে।

৭. সঠিক সেচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা:

যদি পুকুরে অতিরিক্ত পানি থেকে যায়, তবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পুকুর থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে সঠিক সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পানির স্থিরতা বজায় রাখতে এবং পুকুরে তাজা পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নালা বা ড্রেনেজ সিস্টেম তৈরি করা যেতে পারে।

৮. জলজ উদ্ভিদ ও পরিবেশের সুরক্ষা:

বন্যার কারণে পুকুর বা জলাশয়ের ইকোসিস্টেমে পরিবর্তন আসতে পারে। পুকুরে উপকারী জলজ উদ্ভিদ যেমন কচুরি পানার মত উদ্ভিদ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি, যাতে মাছের প্রজনন এবং স্বাস্থ্য ঠিক থাকে। পাশাপাশি পানিতে ভারসাম্যপূর্ণ জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য মাছ ছাড়াও অন্যান্য জলজ প্রাণী সংরক্ষণ করতে হবে।

৯. মাছ চাষের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা:

বন্যার পরে মাছ চাষ পুনরুদ্ধারের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় মৎস্য অফিস বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। এতে চাষিরা আরও ভালো ফলাফল পাবেন এবং মাছের উৎপাদনশীলতা বাড়বে।

১০. সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা:

বন্যা পরবর্তী সময়ে মাছ চাষিদের জন্য সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে থাকে। এই সুবিধাগুলো নিতে স্থানীয় মৎস্য অফিসের সাথে যোগাযোগ রাখা এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা উচিত।

১১. মৎস্য বীমা:

মাছ চাষের বীমা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে, যা চাষিদের বন্যা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি থেকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে।

সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বন্যার পর মাছ চাষ দ্রুত পুনরুদ্ধার করা সম্ভব, যা কৃষকদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা এবং দেশের মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করবে।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
পরিবেশ ও পৃথিবী

নষ্ট হয় না কখনো: মধুর চিরস্থায়ী বিস্ময়!

নীড়ের ছোট্ট প্রকোষ্ঠে মৌমাছিরা দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে তৈরি করে...

জেনেটিকসপরিবেশ ও পৃথিবীবায়োটেকনলজিসাক্ষাৎকার

প্রোফেসর ড. আবিদুর রহমান: উদ্ভিদ বিজ্ঞান এবং পরিবেশবান্ধব গবেষণার পথিকৃৎ

অধ্যাপক আবিদুর রহমান বর্তমানে জাপানের ইওয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের...

কৃষিনতুন প্রযুক্তিপরিবেশ ও পৃথিবী

সৌরকৃষি: কৃষিক্ষেত্রে নতুন বিপ্লব

সৌরকৃষি প্রযুক্তিতে কৃষি ও সৌর শক্তিকে একসাথে ব্যবহার করা হয়। কৃষকের আয়...

GenZপরিবেশ ও পৃথিবীসাক্ষাৎকারস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

ই-বর্জ্য এর গবেষক হৃদয় রায়

ই-বর্জ এর গবেষক হৃদয় রায়। বাংলাদেশের মধ্যে ই-বর্জ নিয়ে কাজ করছে এমন...

কিভাবে কাজ করে?পরিবেশ ও পৃথিবী

সোলার সেল বা সৌরকোষ কীভাবে কাজ করে?

পরিচিতি সোলার সেল বা সৌরকোষের এর অপর একটি নাম হল, ফটোভোলটাইক সেল।...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.