প্রযুক্তি ও জীববিজ্ঞানের জগতে প্রতিদিন নতুন নতুন আবিষ্কার আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। নতুন প্রজাতি চিহ্নিত করা, পাখি ও প্রাণীর আচরণ বোঝা কিংবা পরিবেশ পর্যবেক্ষণের মতো কাজের জন্য প্রয়োজন গবেষণা। এই গবেষণা কাজকে কেবল বড় বড় ল্যাবরেটরিতেই সীমাবদ্ধ ভেবে নেওয়া সহজ, কিন্তু একজন তরুণ বাংলাদেশি—মোঃ ফাহাদ হুসাইন—প্রমাণ করেছেন ভিন্ন কিছু। তিনি দেখিয়েছেন, সীমিত সুযোগ নিয়েও কৌতূহল, অধ্যবসায় এবং স্বশিক্ষার মাধ্যমে একজন নাগরিক বিজ্ঞানী বা Citizen Scientist হয়ে ওঠা সম্ভব, এবং সেই কাজ আন্তর্জাতিক গবেষক মহলেও মূল্যায়িত হতে পারে।
ফাহাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা পাবনায়। তিনি পড়াশোনা করছেন শহীদ বুলবুল সরকারি কলেজে, যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধরণের কলেজে উন্নতমানের গবেষণাগারের সুবিধা পাওয়া যায় না, এক্সপেরিমেন্টাল রিসার্চের সুযোগ তো প্রায় নেই-ই। কিন্তু এখানেই ফাহাদের গল্প আলাদা হয়ে যায়। তিনি হাল ছাড়েননি। বরং প্রকৃতিকে বানিয়েছেন নিজের ল্যাবরেটরি। মাঠে গিয়ে পাখি ও মাছের আচরণ পর্যবেক্ষণ করেছেন, তথ্য সংগ্রহ করেছেন, আর সেগুলো ভাগ করেছেন Citizen Science প্ল্যাটফর্মে। ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন নিজের গবেষণার ভুবন।
তার গবেষণার মূল ক্ষেত্র প্রজাতি শনাক্তকরণ ও পরিবেশগত আচরণ। পাবনার জলাশয়ে তিনি বৈজ্ঞানিকভাবে নথিভুক্ত করেছেন Mirror Carp নামের এক প্রজাতির উপস্থিতি। এটি কেবল স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক গবেষণার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র। পাশাপাশি তিনি “Feeding Behavior of Garden Birds in Pabna City: A Preliminary Study” শীর্ষক গবেষণায় শহুরে বাগান-পাখির খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ করেছেন। এই কাজ নগর জীববৈচিত্র্য বোঝার ক্ষেত্রে নতুন আলোকপাত করেছে, বিশেষ করে কিভাবে পাখিরা শহরের পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে তা বিশ্লেষণে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ফাহাদের কাজ এখনো কোনো পিয়ার-রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। বরং তিনি এগুলো উন্মুক্তভাবে ResearchGate–এ শেয়ার করেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে, এই গবেষণাগুলো পড়া হয়েছে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি (যুক্তরাষ্ট্র), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের দ্বারা। অর্থাৎ একজন স্বাধীন গবেষক, যার কাছে কোনো উন্নতমানের ল্যাবরেটরি নেই, তার কাজও বৈশ্বিক গবেষকদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। গুগলে যদি “Species Documentation of Mirror Carp” বা “Feeding Behavior of Garden Birds in Pabna City” লেখা হয়, প্রথমেই উঠে আসে ফাহাদের কাজ। এটি প্রমাণ করে, বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য সবসময় বিদেশি ডিগ্রি বা সুসজ্জিত ল্যাবরেটরির প্রয়োজন নেই—প্রয়োজন অদম্য কৌতূহল আর সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি।
শুরুর দিকে ফাহাদের কাজ ছিল তাত্ত্বিক বা ডকুমেন্টেশন-ভিত্তিক। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি পর্যবেক্ষণমূলক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। তার নিজের ভাষায়, “গবেষণার জন্য আধুনিক ল্যাব দরকার—এটা আংশিক সত্য। কিন্তু প্রকৃতি নিজেই আমাদের সবচেয়ে বড় ল্যাবরেটরি।” এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে।
একজন স্বাধীন গবেষকের জন্য কোন গুণাবলী সবচেয়ে প্রয়োজনীয়? ফাহাদ মনে করেন, কৌতূহল সবচেয়ে বড় শক্তি। নতুন কিছু জানার অদম্য ইচ্ছাই গবেষণার চালিকা শক্তি। এর পাশাপাশি ধৈর্য দরকার, কারণ সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অধ্যবসায় ছাড়া কোনো কাজ সফল হয় না। সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের ক্ষমতা, অর্থাৎ পর্যবেক্ষণকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এছাড়া বৈজ্ঞানিক সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ দক্ষতা ও সততা—ডেটা ও গবেষণায় নৈতিকতা বজায় রাখার মানসিকতা—গবেষণাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।
বাংলাদেশের তরুণদের উদ্দেশে ফাহাদের বার্তা স্পষ্ট—Citizen Science এমন এক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে সীমিত সুযোগেও বৈজ্ঞানিক অবদান রাখা যায়। একাডেমিক সুযোগ-সুবিধার অভাব থাকলেও গবেষণা থেমে থাকে না, যদি থাকে কৌতূহল ও অধ্যবসায়। তিনি তরুণদের উদ্দেশে বলেন, “বিজ্ঞান শুধু বইয়ের পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি জানার, আবিষ্কারের, আর সমস্যার সমাধান খোঁজার একটি রাস্তা। যে কেউ চাইলে গবেষক হতে পারে—যদি তার ভেতরে কৌতূহল আর অধ্যবসায় থাকে।”
ফাহাদের গল্প আমাদের দেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার অবকাঠামো এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। অথচ আমাদের চারপাশের প্রকৃতি, জলাশয়, গ্রামীণ ও শহুরে পরিবেশের ভেতরেই লুকিয়ে আছে গবেষণার অগণিত ক্ষেত্র। ফাহাদ দেখিয়েছেন, সামান্য উদ্যোগেও সেখানে তৈরি হতে পারে বৈজ্ঞানিক অবদান, যা বিশ্বমানের গবেষকরা গুরুত্ব সহকারে পড়বেন।
মোঃ ফাহাদ হুসাইন প্রমাণ করেছেন, গবেষণা কেবল প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এক ধরনের যাত্রা—যেখানে প্রকৃতি, কৌতূহল আর অধ্যবসায় হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যায়। তার সাফল্যের গল্প বাংলাদেশের তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণা, যারা হয়তো স্বপ্ন দেখে বিজ্ঞানী হওয়ার, কিন্তু সুযোগের অভাবে দমে যায়। ফাহাদ আমাদের মনে করিয়ে দেন—প্রকৃত বিজ্ঞানী সেই, যে কেবল আবিষ্কার করে না, বরং সীমাবদ্ধতার ভেতর থেকেও আবিষ্কারের আলো ছড়িয়ে দেয়।
মোঃ ফাহাদ হুসাইন
শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ
শহীদ বুলবুল সরকারি কলেজ, পাবনা।
(অধিভুক্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ)
Leave a comment