বাংলাদেশের বিজ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসে যে ক’জন মানুষ আলোকবর্তিকার মতো পথ দেখিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ড. কুদরত-ই-খুদা নামটি উচ্চারিত হয় সর্বাগ্রে। শুধু একজন বিশিষ্ট রসায়নবিদই নন, তিনি ছিলেন শিক্ষানীতির স্থপতি, বিজ্ঞানপ্রচারের অগ্রদূত এবং দেশস্বপ্নের এক নিরলস যোদ্ধা। তাঁর প্রয়াসে স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশে গড়ে ওঠে আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষার দৃঢ় ভিত; রচিত হয় এমন এক শিক্ষানীতি, যা শুধু পাঠ্যপুস্তকের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশকে আত্মনির্ভরতার পথে এগিয়ে নেয়।
১৯০০ সালের ৮ মে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মারগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কুদরত-ই-খুদা। তাঁর পারিবারিক পরিবেশ ছিল গভীরভাবে সংস্কৃতিমনা। পিতা খোন্দকার আলী আহমদ ছিলেন স্থানীয় সমাজে প্রভাবশালী ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি; মাতা মেহেরুন্নিসার স্নেহের স্পর্শে শৈশব থেকেই কুদরত-ই-খুদা পান শিক্ষার প্রতি এক অদম্য আকর্ষণ। গ্রামের পাঠশালার সীমানা পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন স্থানীয় বিদ্যালয়ে। অতি অল্প বয়সেই গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর অনুরাগ চারপাশের সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে অনার্স নিয়ে উচ্চশিক্ষার পর পিএইচডি করার জন্য তিনি পাড়ি জমান ইংল্যান্ডের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি গবেষণা করেন কলোয়েড রসায়নে—যা সে সময়ে ছিল অত্যন্ত অগ্রসর একটি ক্ষেত্র। তাঁর গবেষণার মান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় এবং প্রকাশিত প্রবন্ধ সমূহ তাঁকে বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দেয়। কিন্তু তিনি শুধুমাত্র গবেষণাগারে আবদ্ধ থাকেননি; দেশের জন্য কিছু করার তাগিদই তাঁকে আবার মাতৃভূমির পথে ফিরিয়ে আনে।
দেশে ফিরে ব্রিটিশ ভারত, পরবর্তীতে পাকিস্তানের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ঘাটতি তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন—একটি দেশের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয় যদি সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি না হয়। তাই তিনি নেমে পড়েন পাঠ্যপুস্তক রচনা ও বিজ্ঞানপ্রচারের কাজে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানগ্রন্থ রচনার অগ্রণী কারিগর হিসেবে কুদরত-ই-খুদা রচনা করেন একাধিক জনপ্রিয় বিজ্ঞানবই। সহজ, রসময় অথচ নির্ভুল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তাঁর বইগুলোকে করে তোলে ছাত্র-শিক্ষকের প্রিয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গঠিত হয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য জাতীয় শিক্ষা কমিশন, যার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি নিজেই। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত সেই ‘কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট’ বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা নির্ধারণ করে। রিপোর্টে তিনি জোর দেন প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের চর্চা বাড়ানোর উপর, প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার, নারীশিক্ষার উন্নতি এবং স্থানীয় বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কারিগরি শিক্ষার উপর। আজকের বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ও বিজ্ঞানের যে বিস্তৃত পরিধি, তার বীজ বপন হয়েছিল এই ঐতিহাসিক প্রতিবেদনে।
তাঁর অবদান কেবল নীতিনির্ধারণে সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞানচর্চাকে জনপ্রিয় করার জন্য তিনি নিয়মিত লিখতেন দৈনিক পত্রিকায়, দিতেন রেডিও ও টেলিভিশনে বক্তৃতা। গ্রামবাংলার শিশু-কিশোরের কাছে বিজ্ঞানকে সহজ ভাষায় তুলে ধরার যে প্রচেষ্টা তিনি চালিয়েছিলেন, তা আজও বাংলাদেশে বিজ্ঞানপাঠের ভিত্তি হিসেবে গৃহীত। ড. কুদরত-ই-খুদা বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান কেবল ল্যাবরেটরির জটিল সমীকরণ নয়; এটি কৃষক-শ্রমিকের জীবনযাত্রা বদলে দেওয়ার হাতিয়ার।
১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকায় তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারিয়েছিল এক জননন্দিত বিজ্ঞানী, দূরদর্শী নীতি-প্রণেতা এবং নিরহংকার শিক্ষককে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত পথ আজও আমাদের সামনে উজ্জ্বল দিশারী হয়ে রয়েছে।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার মতোই কুদরত-ই-খুদার জীবন যেন এক নিরন্তর জাগরণের আহ্বান। তিনি প্রমাণ করে গেছেন—একজন বিজ্ঞানীর দায়িত্ব শুধু গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ নয়; সমাজকে বদলে দেওয়ার, শিক্ষার আলোয় প্রজন্মকে উজ্জীবিত করার কাজও বিজ্ঞানীরই। বাংলাদেশের শিক্ষা ও বিজ্ঞান আন্দোলনের প্রতিটি পৃষ্ঠায় তাই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাঁর নাম।

Leave a comment