সাক্ষাৎকার

ন্যানোপ্রযুক্তিতে দেশোন্নয়নের স্বপ্ন দেখেন ড. এ টি এম মিজানুর রহমান

Share
Share

ছবিগুলো ড. মিজানুর রহমানের ল্যাবে তোলা

বাংলাদেশের একজন মেধাবী বিজ্ঞানী ড. এ টি এম মিজানুর রহমান – ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার অ্যাপ্লায়েড নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক। নিজের স্বপ্ন আর দেশপ্রেম বুকে নিয়ে তিনি বহুদূর পাড়ি দিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন এবং দেশে ফিরে উদ্ভাবনের মাধ্যমে জাতির সেবা করার ব্রত গ্রহণ করেছেন। তার ব্যক্তিগত যাত্রা যেমন সংগ্রামময়, তেমনি তার গবেষণা কাজ দেশের কৃষি ও জনস্বাস্থ্যে সম্ভাবনার নতুন আলো দেখাচ্ছে। ন্যানোপ্রযুক্তি, জৈব কীটনাশক, ফাংশনাল ফুড (কার্যকরী খাদ্য) থেকে শুরু করে খাদ্যে ভেজাল ও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের মতো জটিল সমস্যার সহজ ব্যাখ্যা এবং সমাধানের উদ্যোগ – সবকিছুই উঠে আসে ড. মিজানুর রহমানের কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে। তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য এটি এক অনুপ্রেরণার গল্প, যেখানে কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং দেশের প্রতি ভালোবাসা মিলিয়ে বিজ্ঞানচর্চাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে।

শৈশব থেকে উচ্চশিক্ষা: বিদেশে সংগ্রাম ও সাফল্য

ড. মিজানুর রহমানের শিক্ষাজীবন শুরু হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে তিনি বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজিতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। দেশে পিএইচডি করার চেষ্টায় কিছু প্রশাসনিক ও সেশন জটের জটিলতার মুখে পড়লেও শেষ পর্যন্ত তিনি বিদেশের পথে পা বাড়ান উচ্চতর গবেষণার জন্য। শুরুতে জাপানে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল এবং সেই চেষ্টায় অনেকবার আবেদন করেও সফল হননি।

পরিশেষে পিএইচডি করতে তিনি পাড়ি জমান দক্ষিণ কোরিয়ায় – যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষণার পরিবেশ অত্যন্ত কঠিন হিসেবে পরিচিত; তার নিজের কথায়, অনেক অধ্যাপক সেখানে ছাত্রদের উপর বেশ চাপ সৃষ্টি করেন, যা একপ্রকার মানসিক পরীক্ষার মতো। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের সেই দিনগুলো তাকে নতুন ভাবে গড়ে তোলে। তিনি বলেন, পিএইচডিটা আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে সংগ্রাম করতে হয়, কিভাবে বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকতে হয়। পিএইচডি করে আসার পর মনে হয় আমি আর একটা নতুন মানুষ” সত্যিই, বিদেশের ল্যাবে দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর পরিশ্রম ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তিনি একজন আত্মবিশ্বাসী বিজ্ঞানীতে পরিণত হন, যিনি এখন যেকোনো পরিবেশে কাজ করার মানসিক দৃঢ়তা অর্জন করেছেন।

এই বিদেশে অধ্যয়নের অভিজ্ঞতা শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়; এটি ছিল তার দ্বিতীয় জীবনের শুরু। প্রাথমিক ভাবে কঠোর তত্ত্বাবধানের অধীনে থেকে গবেষণা করা কষ্টকর ছিল, তবে তিনি অনুভব করেন যে সেই কঠিন পরিবেশই তাকে ভবিষ্যতের গবেষক হওয়ার জন্য শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। ড. মিজানুর রহমান উপলব্ধি করেন যে জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জনের জন্য শৃঙ্খলা ও দৃঢ় সংকল্প কতটা গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ কোরিয়ায় অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন – নিরাপদ ও সুবিধাজনক বিদেশের ক্যারিয়ার ছেড়ে নিজের দেশে বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম গড়ে তোলার সাহস দেখান। অনেকেই উচ্চশিক্ষার পর বিদেশেই থেকে যাওয়ার পথ বেছে নিলেও, ড. মিজানুর রহমান ফিরলেন স্বদেশে, কারণ “দেশকে ভালোবাসা” – দেশের জন্য কিছু করার স্বপ্ন তাকে তাড়িত করেছিল।

ন্যানোটেকনোলজির পথে গবেষণা: অর্থসংকট থেকে উদ্ভাবনে

বিদেশে গবেষণা শুরুর সময়েই ড. মিজানুর রহমান বাস্তবতার মুখোমুখি হন – উন্নত গবেষণা করতে অর্থের প্রয়োজন, আর সেই তহবিলের অভাব ছিল তীব্র। প্রাথমিকভাবে বেশি খরচের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এড়িয়ে তিনি সহজলভ্য ও কম ব্যয়সাপেক্ষ বিষয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি বেছে নেন ভেষজ উদ্ভিদের ওপর প্রাথমিক গবেষণা – বিভিন্ন ঔষধি গাছের ফাইটোকেমিক্যাল (উদ্ভিদের রাসায়নিক যৌগ) নিয়ে বিশ্লেষণ, যা তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী। কিন্তু বেশ কিছুদিন এই ধরণের মৌলিক (বেসিক) কাজ করার পরে তিনি অনুভব করলেন যে শুধুমাত্র প্রচলিত পথ ধরে এগিয়ে গেলে চলবে না; দরকার আরও আধুনিক ও উন্নত স্তরের গবেষণা, যাতে দেশের জন্য নতুন কিছু আনা যায়। অথচ উন্নত গবেষণার জন্য যে উচ্চমূল্যের যন্ত্রপাতি ও বড় বাজেট দরকার, তা তাঁর হাতে তখনও নেই। তাই তিনি খুঁজতে লাগলেন এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে ব্যয়ও কম, আবার বৈশ্বিকভাবে গবেষণার অগ্রগামী ধারা।

এই খোঁজ তাকে নিয়ে আসে ন্যানোটেকনোলজির জগতে। ড. মিজানুর রহমান জানতে পারেন যে উদ্ভিদের সাহায্যে ন্যানোমেটেরিয়াল তৈরি – অর্থাৎ প্ল্যান্ট-মেডিয়েটেড ন্যানো-বায়োসিন্থেসিস – সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের আগ্রহের শীর্ষে থাকা একটি ক্ষেত্র, এবং এটি তুলনামূলকভাবে কম খরচে করা সম্ভব। ন্যানোটেকনোলজি বা ন্যানোপ্রযুক্তি মূলত অতি ক্ষুদ্র কণার প্রযুক্তি; ন্যানো মানে এক বিলিয়নের এক ভাগ, অর্থাৎ এক মিটারের একশ’ কোটি ভাগের এক ভাগ মাপের কিছু – কতটা ক্ষুদ্র ভাবা যায়! সাধারণত ১ থেকে ১০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে ব্যাসের কণাকে ন্যানোপার্টিকেল বলা হয়। এত ক্ষুদ্র কণার বিশেষত্ব হল, আকার ছোট হলে তাদের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম (properties) বদলে যায় এবং কার্যক্ষমতা বহুগুণে বেড়ে যায়। এই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে তিনি উদ্ভিদের নির্যাস দিয়ে রূপার ন্যানো-কণা তৈরি করতে শুরু করেন। অদম্য পরিশ্রমের মাধ্যমে অবশেষে তিনি ১০ ন্যানোমিটারের চেয়েও ছোট আকারের ন্যানোপার্টিকেল সফলভাবে সংশ্লেষণ (সিন্থেসিস) করতে সক্ষম হন এবং অসাধারণ ফলাফল পেতে থাকেন। তার গবেষণার ফলাফল ইতোমধ্যে একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য বড় গর্বের বিষয়।

ন্যানোপার্টিকেল তৈরি করেই তিনি থেমে থাকেননি; এগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়েও কাজ শুরু করেন। কীভাবে ন্যানোপ্রযুক্তি বাস্তব সমস্যার সমাধানে লাগানো যায় – এ চিন্তা তাকে নতুন প্রকল্পের দিকে নিয়ে যায়। এসময় বাংলাদেশ ধানের এমন দুইটি রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর সমাধান খুঁজছিল যা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে: রাইস ব্লাস্ট (একটি ছত্রাকজনিত রোগ) এবং ব্যাকটেরিয়াল নেক্রোসিস। ড. মিজানুরের ন্যানো-গবেষণার কথা জানতে পেরে বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) তার সাথে যোগাযোগ করে। তাদের সঙ্গে মিলে তিনি বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি গবেষণা প্রকল্প শুরু করেন, উদ্দেশ্য – ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব নতুন ধরনের কীটনাশক তৈরি করা।

জৈব ন্যানো-কীটনাশক: ধানে আশার আলো

বাংলাদেশে প্রচলিত অধিকাংশ কীটনাশক রাসায়নিক ভিত্তিক এবং স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ। এসব রাসায়নিক কীটনাশক ফসলের ক্ষতিকর পোকা দমন করলেও জমির পরিবেশ দূষিত করে, এবং অবশিষ্টাংশ খাদ্য ও পানির মাধ্যমে মানুষের দেহে ঢুকে নানা রোগের কারণ হয়। ড. মিজানুর রহমানের লক্ষ্য ছিল এমন একটি বায়ো-পেস্টিসাইড বা জৈব কীটনাশক তৈরি করা, যা উদ্ভিদের উপাদান ও ন্যানোপ্রযুক্তি দিয়ে বানানো হবে; ফলে এটি হবে পরিবেশবান্ধব, টক্সিক রাসায়নিক মুক্ত একটি সমাধান। তাঁর উদ্ভাবিত ন্যানো-কণা ভিত্তিক জৈব কীটনাশকটি ধানের রোগ প্রতিরোধে চমৎকার কার্যকারিতা দেখায়। গবেষণার মাঠপর্যায়ের পরীক্ষায় দেখা গেছে, যে ধানের ক্ষেতে মারাত্মক রোগের কারণে গাছগুলো প্রায় মারা যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, সেখানে এই বিশেষ ন্যানো-কণাযুক্ত দ্রবণ স্প্রে করার পর অনেক গাছ বেঁচে উঠে এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ফলন দেয়। এক কৃষক তো রোগাক্রান্ত ধানগাছগুলো উপড়ে ফেলতে চাচ্ছিলেন, তখন গবেষকদল তাকে অনুরোধ করে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে এবং তাদের তৈরি দ্রবণটি স্প্রে করে দেখতে। আশ্চর্যজনকভাবে সেই ধান গাছগুলো পুনরুজ্জীবিত হয় এবং ভালো ফসল উৎপাদন করে।

এই সাফল্যের পর বিশ্বব্যাংক প্রযুক্তিটিকে বাংলাদেশের বাজারে আনার জন্য নীতিগত অনুমোদন দেয়। বলা হয়েছিল যে এটাই হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম জৈব-ন্যানো কীটনাশক উদ্ভাবন যা মাঠপর্যায়ে কার্যকর প্রমাণিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সমন্বয়ের অভাবে প্রকল্পটি তখন থমকে যায়। যেহেতু এটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগ ছিল, তাই ড. মিজানুর রহমান এককভাবে এর অগ্রগতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। পেটেন্ট করার পরিকল্পনা থাকলেও পরিশেষে করা হয়নি। তাঁর আফসোস ছিল যে এমন সম্ভাবনাময় উদ্ভাবন আলোর মুখ দেখার আগেই আটকে গেল। পরবর্তীতে তার এক সাবেক ছাত্র যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয় নিয়ে একটি বেসরকারি কোম্পানির সাথে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে তিনি জানেন, যা কিছুটা আশার কথা। তবু ড. মিজানুর রহমান নিজে এই কাজটি আর এগিয়ে নিতে পারেননি অর্থ ও প্রতিষ্ঠানগত জটিলতার কারণে।

ড. মিজানুরের মতে এই জৈব ন্যানো-কীটনাশকটি সত্যিই মাঠে প্রয়োগ করা গেলে বাংলাদেশের কৃষিতে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। এটি পরিবেশের ক্ষতি না করেই ধানের উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম, ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকের আয় দুটিই বাড়বে, জিডিপিতেও ইতিবাচক অবদান পড়বে বলে তিনি মনে করেন। তাছাড়া, এমন নতুন প্রযুক্তি বাজারে এলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও বিতরণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। নতুন এই উদ্ভাবন যে সত্যিকার অর্থেই পরিবেশবান্ধব হবে তা নিশ্চিত করতে কিছু অতিরিক্ত গবেষণার দরকার ছিল – বিশেষত ন্যানোকণার কোন দূরবর্তী ক্ষতিকর প্রভাব আছে কিনা তা জানার জন্য প্রাণিদেহে বিষক্রিয়া পরীক্ষা (টক্সিসিটি টেস্ট) করা জরুরি। ড. মিজানুরের দল ক্ষেত্রপর্যায়ে খুবই কম মাত্রার (সেইফটি লেভেলের অনেক নিচে) ন্যানোপার্টিকেল ব্যবহার করেছিল এবং ধারণা ছিল যে এতে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। তা সত্ত্বেও তারা ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে শতভাগ নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে, অতিরিক্ত ফান্ডিং না পাওয়ায় সেই প্রাণীর ওপর টেস্ট এবং পরবর্তী ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল আর করা হয়নি। ড. মিজানুর রহমান বলেন, যথাযথ অর্থায়ন পেলে তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি অবশ্যই আবার শুরু করতে চান এবং মানুষের কাছে নিরাপদ একটি প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে চান।

ফাংশনাল ফুড ও খাদ্য নিরাপত্তার নতুন পথ

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা কেবল ফলন বাড়ানোর চ্যালেঞ্জেই সীমাবদ্ধ নয়; ভেজাল ও পুষ্টিহীনতা এখানকার বড় সমস্যা।
ড. মিজানুর রহমান নিজেও লক্ষ করেছেন যে আমাদের দৈনন্দিন খাবারের অনেকটাই বিভিন্নভাবে অ্যাডাল্টারেটেড বা ভেজালযুক্ত। বাজারের খাবারে রং, ক্ষতিকর রাসায়নিক, ভারী ধাতু (যেমন সীসা, পারদ) ইত্যাদি মেশানো কোন বিরল বিষয় নয়। এর ফলস্বরূপ ধীরে ধীরে জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে – ক্যান্সারের মতো কঠিন রোগও এই ভেজালের কারণে বাড়তে পারে। খাদ্যে ভেজাল বলতে মূলত খাবারের সাথে এমন কিছু অপদ্রব্য মেশানোকে বোঝায় যা খাবারের মান নষ্ট করে এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, অথচ তা মুনাফা বাড়ানোর জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা করে থাকে। ড. মিজানুর রহমান একজন খাদ্য প্রযুক্তিবিদ হিসেবে এই সমস্যা মোকাবিলায় ভীষণ আগ্রহী এবং অনুভব করেন যে বাজারে উপলব্ধ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে কী কী ভেজাল আছে তা খুঁজে বের করা ও প্রতিরোধ করা তাঁদের মতো বিজ্ঞানীদেরই দায়িত্ব। তিনি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও বিশুদ্ধতা নিয়ে গবেষণাকে নিজের কাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়েছেন।

ভেজাল রোধের পাশাপাশি ড. মিজানুরের আরেকটি আগ্রহের ক্ষেত্র হল ফাংশনাল ফুড বা কার্যকরী খাদ্য তৈরি, যা সাধারণ খাদ্য হলেও তা খাওয়ার মাধ্যমে নির্দিষ্ট রোগ প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। উদাহরণ হিসেবে তিনি একটি বিশেষ দই (ইয়োগার্ট) তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী হবে। সাধারণ দইয়ে চিনি মেশানো হয়, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সমস্যাজনক। ড. মিজানুর এমন এক প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে চেয়েছেন যেখানে চিনি না দিয়েও দই বানানো যাবে এবং তাতে এমন উপাদান থাকবে যা রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। এই অ্যান্টি-ডায়াবেটিক বা ডায়াবেটিস প্রতিরোধী দই এর পরীক্ষামূলক উৎপাদন তিনি করেছেন এবং ল্যাবরেটরিতে (in vitro) চমৎকার ফল পেয়েছেন – অর্থাৎ, টেস্টটিউবে বা পেট্রি ডিশে এ দইয়ের উপাদানগুলো রক্তে চিনি নিয়ন্ত্রণের লক্ষণীয় সক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী ধাপে প্রাণীর দেহে (in vivo) পরীক্ষা চালানোর আগেই অর্থের অভাবে প্রকল্পটি বন্ধ করতে হয়, যা তাকে গভীরভাবে হতাশ করেছে। প্রয়োজনীয় ফান্ড পেলে ইঁদুরের উপর এই বিশেষ দই খাইয়ে দেখা যেত, তাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কেমন পরিবর্তন হয় এবং অর্গানগুলোর উপর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা। এই পরীক্ষা সফল হলে মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করে নিশ্চিত হওয়া যেত যে দইটি সত্যিই ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক কি না। দুঃখজনক হলেও, সেই গবেষণার জন্য তহবিল তিনি জোগাড় করতে পারেননি বলে কাজটি অসমাপ্ত অবস্থায় বন্ধ করতে বাধ্য হন। তবে হাল ছেড়ে দেননি; এই অভিনব ধারণার বৈজ্ঞানিক ফলাফলগুলি তিনি এখন একটি গবেষণা প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ করছেন যাতে ভবিষ্যতে কেউ তা কাজে লাগাতে পারে। ড. মিজানুরের কথায় স্পষ্ট, ফাংশনাল ফুড ও ন্যানোপ্রযুক্তি – এই দুই দিকেই তার গবেষণা আগ্রহ প্রবল, কারণ তিনি খাদ্যকে ওষুধের মতো ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্যোন্নয়ন দেখতে চান।

বাংলাদেশের মতো দেশে অপুষ্টি এক বড় সমস্যা, পাশাপাশি খাদ্যে ভেজালজনিত রোগব্যাধি বাড়ছে। ড. মিজানুর রহমান মনে করেন, যদি তার মতো বিজ্ঞানের মানুষরা এগিয়ে আসেন তবে পুষ্টিহীনতা ও ভেজালের এই সমস্যা অনেকটাই সমাধান করা সম্ভব। নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়। উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে সমাধান বের করলে একই সাথে জাতির স্বাস্থ্য রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন – দুইই হতে পারে। তার গবেষণা কার্যক্রমে আমরা সেই লক্ষ্যই প্রত্যক্ষ করি।

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স মোকাবিলায় ন্যানোপ্রযুক্তির সম্ভাবনা

ড. মিজানুর রহমানের গবেষণার পরিধি শুধু কৃষি ও খাদ্যেই সীমিত নয়; জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ এক বিপজ্জনক সমস্যা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধেও তিনি আগ্রহী। অ্যান্টিবায়োটিক হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণ নিরাময়ের ওষুধ; কিন্তু বিশ্বব্যাপী এখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে বহু জীবাণু বর্তমানের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধকে পরাস্ত করার ক্ষমতা অর্জন করছে। একেই বলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, অর্থাৎ জীবাণুর ওষুধ-সহিষ্ণুতা বা প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া। এর ফলে অনেক সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করতে চায় না, ফলে সাধারণ চিকিৎসায় রোগ সারে না এবং মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। এক প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) জনিত কারণে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হতে পারে, যদি এখনই ব্যবস্থা না নেয়া হয়। দুর্ভাগ্য যে, ২০১৯ সালেই সারা বিশ্বে প্রায় ১২ লাখ মানুষ সরাসরি অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের শিকার হয়ে মারা গেছে এবং ভবিষ্যতে এই সংখ্যা বহুগুণে বাড়তে পারে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন।

কেন অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এমন মারাত্মক আকার ধারণ করছে? ড. মিজানুর রহমান ব্যাখ্যা করেন যে সমস্যার শিকড় লুকিয়ে আছে অ্যান্টিবায়োটিকের স্বভাব ও জীবাণুর অভিযোজন ক্ষমতায়। নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করতে বহু বছর সময় ও বিপুল গবেষণা বিনিয়োগ করতে হয়, অথচ বাজারে আসার পর অল্পদিনেই সেই ওষুধের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়া নিজেদের রক্ষা করার পদ্ধতি রপ্ত করে ফেলে। জীবাণুরা বাঁচতে চায়, তাই তারা দ্রুত জেনেটিক পরিবর্তন ঘটিয়ে ওষুধকে নিষ্ক্রিয় করার উপায় বের করে নেয়। এর ফল হলো, যত নতুন ওষুধই আসুক, কিছুদিন পর সেগুলো অনেক জীবাণুর কাছে অকার্যকর হয়ে পড়ে – অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা ক্রমশ কমতে থাকে এবং সুপারবাগ বলে পরিচিত শক্তিশালী জীবাণুর উদ্ভব হয়। তবে আশার কথা হল, গবেষণায় দেখা গেছে যে ন্যানোপার্টিকেলের ক্ষেত্রে জীবাণুর এই প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে না। অতিক্ষুদ্র ন্যানো-কণা জীবাণুর কোষে ভিন্নভাবে আক্রমণ করে এবং ব্যাকটেরিয়ার পক্ষে সহজে এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। ফলে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সমস্যা মোকাবিলায় ন্যানোপ্রযুক্তি একটি সম্ভাবনাময় হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ড. মিজানুর রহমান ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক গবেষণা সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত হয়ে এ বিষয়ে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি যে সহযোগী গবেষণা দলে আছেন তারা অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দমনে ন্যানোমেটেরিয়াল ব্যবহারের উপায় নিয়ে গবেষণা প্রস্তাব তৈরি করছেন। ইউরোপ বা বাংলাদেশ – যেখানেই সম্ভব হোক, এই অতি জরুরি সমস্যার সমাধানে তিনি অবদান রাখতে চান। তার কথা থেকে বোঝা যায়, বিজ্ঞানীদের আন্তঃদেশীয় সহযোগিতা ও সমন্বিত প্রচেষ্টাই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের মতো বৈশ্বিক সমস্যার মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।

দেশের মাটিতে ফেরার সিদ্ধান্ত: স্বপ্ন, চ্যালেঞ্জ ও সংকল্প

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুবর্ণ সুযোগ থাকলেও, ড. মিজানুর রহমান বিদেশে থেকে যাওয়ার বদলে দেশে ফেরার পথই বেছে নেন। এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে তার অসীম দেশপ্রেম এবং কিছু মহৎ স্বপ্ন। তিনি বিশ্বাস করেন যে দেশের মাটিতে থেকে কাজ করেই সমাজে বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব। বিদেশে থাকলে ব্যক্তিগত জীবনে হয়তো আরও সুবিধা ও নিশ্চয়তা থাকত, কিন্তু দেশের জন্য সরাসরি কাজ করার সুযোগ কমে যেত। তিনি স্পষ্ট বলেন, “আমার কিছু স্বপ্ন আছে। আমি বাংলাদেশে একটা ফার্মাসিউটিক্যালস, একটা ফুড ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করতে চাই”। দেশে গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন করে তিনি জনসাধারণের উপকার এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি – দুটিই করতে চান। ড. মিজানুর রহমানের লক্ষ্য শুধু ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার গড়া নয়, নিজের জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে জাতির সেবা করা। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন যে যদি অত্যন্ত বাধ্য না হতে হয়, তবে তিনি বিদেশে স্থায়ী হবেন না; দেশের পরিবেশে থাকতে যত কঠিনই হোক না কেন, তিনি চেষ্টা করবেন স্বপ্নগুলো নিজের মাতৃভূমিতেই বাস্তবায়ন করতে।

তবে দেশে ফিরেই তাকে বাস্তবতার সাথেও লড়াই করতে হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের গবেষণা পরিকাঠামো উন্নত বিশ্বের মতো নয়, এখানে বাজেট সীমিত, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব প্রকট। ড. মিজানুর রহমান গভীরভাবে উপলব্ধি করেন যে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা দিয়ে সবকিছু করা সম্ভব নয়, দরকার প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের সমর্থন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিন গবেষণাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি এবং সরকারী বাজেটে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ কম ছিল। ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষক-গবেষকও গবেষণা থেকে বিমুখ ছিলেন, কারণ সুবিধা ও তহবিলের অভাবে উন্নত গবেষণা করা কঠিন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে – সরকার ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণার জন্য বেশি বাজেট ও ফান্ডিং প্রদান করছে। এটি আশা জাগানিয়া খবর, কারণ অর্থায়ন বাড়লে শিক্ষকরা গবেষণায় অধিক মনোযোগ দেবেন এবং নিজস্ব উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের চেষ্টায় এগিয়ে আসবেন বলে তিনি মনে করেন। যোগ্যতার অভাব আমাদের দেশে নেই, শুধু সুযোগ আর সহযোগিতার অভাব। ড. মিজানুর রহমান বলেন, যখন শিক্ষকেরা উৎসাহী হবেন গবেষণায়, তখন তাদের ছাত্ররাও স্বভাবতই গবেষণায় আগ্রহী হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকে গবেষণার বীজ রোপণ হলে সেই ছাত্রছাত্রীরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সাফল্য পাবে – ভালো গবেষণা প্রকাশনা ও বিদ্যাচর্চার ভিত্তিতে বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ লাভ করবে সহজেই।

আরেকটি বিষয়ে তিনি জোর দেন: মেধা পাচার রোধ করতে হলে এবং গবেষণার সুফল দেশকে পেতে হলে, বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে ফেরত আসা মেধাবীদের জন্য দেশে একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। গবেষকদের জন্য সম্মানজনক চাকরির অবস্থান, কাজের সুযোগ এবং আর্থিক নিরাপত্তা দিতে হবে, যাতে করে যারা নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে দেশের টানে ফিরে আসে তারা এখানে থেকেও স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারেন। রাষ্ট্রের উচিত এই দায়িত্বটি নেওয়া – যারা নিঃস্বার্থভাবে দেশের জন্য কাজ করতে চায়, তাদের প্রাপ্য সম্মান ও সুবিধা নিশ্চিত করা। ড. মিজানুর রহমান নিজে কিছু নিবেদিতপ্রাণ গবেষককে চেনেন যারা প্রায় পাগলের মতো ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি প্রশ্ন করেন, এমন ত্যাগী মানুষ বর্তমান সমাজে কতজন মিলবে? যদি যথাযোগ্য স্বীকৃতি ও সহায়তা না দেওয়া হয়, তবে বেশি মানুষ গবেষণাকে পেশা হিসেবে নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে উৎসাহী হবে না। তাই রাষ্ট্র এবং সমাজকেই মেধার মূল্যায়ন করতে হবে, উদ্ভাবকদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

ল্যাব গড়ার লড়াই: স্বল্প সম্পদে উচ্চ লক্ষ্য

দেশে ফিরে ড. মিজানুর রহমান তার স্বপ্নের গবেষণাগার (ল্যাব) গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। উন্নত দেশে কাজ করার সময়ই তিনি মনস্থির করেছিলেন যে দেশে ফিরে একটা অত্যাধুনিক ল্যাব প্রতিষ্ঠা করবেন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে, যাতে তরুণরা গবেষণার সুযোগ পায় এবং আন্তর্জাতিক মানের কাজ করা যায়। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন ছিল ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি ও সুবিধা, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্প বাজেটে পাওয়া দুষ্কর। তাই তিনি বেছে নিলেন ধাপে ধাপে এগোনোর কৌশল – ছোট ছোট প্রোজেক্টের তহবিল বাঁচিয়ে একে একে যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা। উদাহরণস্বরূপ, পিএইচডি শেষে দেশে ফেরার পর তিনি একটি গবেষণা প্রকল্পে মাত্র ২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা গ্রান্ট পান। তিনি ঠিক করেছিলেন এই টাকায় সর্বপ্রথম একটি বিশেষ যন্ত্র কিনবেন যার নাম হোমোজেনাইজার। এই যন্ত্রটি দ্রবণে মিশ্রণ ও ইমালশন তৈরির কাজে অত্যন্ত দরকারী, বিশেষ করে খাদ্যশিল্পে এবং ওষুধ তৈরিতে। প্রতিশ্রুতি মতো তিনি প্রাপ্ত অর্থের প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ করে হোমোজেনাইজারটি কিনে ফেললেন, কারণ এটি তার গবেষণার এক নম্বর চাহিদা ছিল।

কিন্তু একটি যন্ত্র দিয়ে তো গবেষণার কাজ সম্পূর্ণ হয় না। ধীরে ধীরে তাকে আরও কিছু আনুষঙ্গিক যন্ত্র সংগ্রহ করতে হবে – এই বাস্তবতা মাথায় রেখে তিনি পরের প্রোজেক্ট/অনুদানের দিকে তাকালেন। ধানের রোগ প্রতিরোধে ব্রি’র সাথে চলমান প্রকল্পের সময় তিনি যাতায়াত ও অন্যান্য বরাদ্দ খরচ বাঁচিয়ে কিছু অর্থ জমাতে থাকেন। সেই সঞ্চয় দিয়ে তিনি একটি মাইক্রোটম যন্ত্র নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করেন। মাইক্রোটম মূলত অতিসূক্ষ্ম ব্লেডযুক্ত একটি যন্ত্র, যার মাধ্যমে গবেষণাগারে ইঁদুরের মতো পরীক্ষণ পশুর অঙ্গ-উৎপাটিত টিস্যুকে খুব পাতলা স্লাইসে কাটা যায়। কেন এই যন্ত্রটি দরকার? ড. মিজানুর রহমানের পরিকল্পনা ছিল তার ডায়াবেটিক বিরোধী দই ইঁদুরের ওপর খাইয়ে পরীক্ষা করবেন। পরীক্ষা শেষে ইঁদুরের দেহের অঙ্গ (যেমন অগ্ন্যাশয়) সংগ্রহ করে মাইক্রোস্কোপে পর্যবেক্ষণ করতে হবে – দেখতে হবে দই খাওয়ানোর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত বিটা সেল পুনর্জন্ম হয়েছে কিনা, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ইঙ্গিত দেয়। এই পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন ইঁদুরের অঙ্গকে কেটে স্লাইড তৈরির পুরো ব্যবস্থাটি, যাকে বলে হিস্টোপ্যাথলজি ল্যাব। মাইক্রোটম সেই ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিজের জোগাড় করা সীমিত অর্থে ড. মিজানুর রহমান মাইক্রোটমটি যুক্ত করেন ল্যাবে, সঙ্গে একটি টিস্যু এমবেডার যন্ত্রও কেনেন যাতে টিস্যু স্লাইস করার আগে সেগুলোকে ব্লক আকারে কঠিন করে রাখা যায়। এভাবে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র তিনি সংগ্রহ করেন। বাকি ধাপগুলো – যেমন টিস্যু প্রসেসিং ও স্টেইনিং (দাগ দেয়া) – ম্যানুয়ালি করার ব্যবস্থা রেখে সাময়িকভাবে কাজ চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, কারণ সেই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রগুলোর দাম প্রচণ্ড বেশি।

এরপর তিনি তার ল্যাবের পরিসর অনুযায়ী আরও কিছু দরকারি সরঞ্জাম সংগ্রহ করেন। জায়গা সঙ্কটের কারণে প্রাণী পালন কক্ষ না থাকায় টিস্যু কালচার ইনকিউবেটরসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি তিনি ল্যাবেই চতুর্দিকে রাখেন। একে একে তিনি একটি ওভেন, একটি সনিকেটর (যা আলট্রাসাউন্ড কম্পনের মাধ্যমে দ্রবণে অপদ্রব্য দ্রবীভূত করে মিশ্রণ তৈরি করে), একটি ওয়াটার বাথ (পানির মাধ্যমে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নমুনা গরম রাখার যন্ত্র), এবং কেণ্দ্রিভূতকরণ যন্ত্র বা সেন্ট্রিফিউজ মেশিন কিনেছেন। সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা হল, তার গবেষণার আগ্রহ দেখে এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বন্ধুর সহায়তায় তিনি দুটি অত্যাধুনিক পিসিআর মেশিন (একটি রিয়েল-টাইম পিসিআর ও একটি সাধারণ পিসিআর) বিনামূল্যে পেয়ে যান – সেই বন্ধুর পারিবারিক ফাউন্ডেশনের নামে মেশিনগুলোর রেজিস্ট্রি করার শর্তে। এই মেশিনগুলোর মূল্য অনেক, কিন্তু নিছক বন্ধুত্ত্ব ও গবেষণার প্রতি সম্মান থেকে ওই বন্ধু তাকে যন্ত্র দুটি উপহার দেন।

ধাপে ধাপে এভাবে যন্ত্রপাতির তালিকা দীর্ঘ হয়েছে তার ল্যাবে: হোমোজেনাইজার, সেন্ট্রিফিউজ, সনিকেটর, ইনকিউবেটর, পিসিআর, মাইক্রোটম, টিস্যু এমবেডার – আরও অসংখ্য ছোট বড় যন্ত্র। পরিশেষে হিস্টোপ্যাথলজি পূর্ণাঙ্গ করতে দরকার টিস্যু প্রসেসর ও অটো স্টেইনার। টিস্যু প্রসেসরটি তিনি সংগ্রহ করেছেন, যা দিয়ে টিস্যুর স্লাইসগুলিকে বিশেষ রাসায়নিক মাধ্যমে প্রসেস করে রং ধরানোর উপযোগী করা হয়। শুধুমাত্র অটো-স্টেইনার যন্ত্রটি অর্থাভাবে এখনও কেনা সম্ভব হয়নি – এর দাম ত্রিশ লক্ষ টাকার মতো। ফলে সেই স্টেইনিং ধাপটি এখন ম্যানুয়ালি করা হয়, যা সময়সাপেক্ষ হলেও কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়।

আজ ড. মিজানুর রহমানের ল্যাবে প্রায় এক কোটি টাকার যন্ত্রপাতি রয়েছে বলে ধারণা। বিজ্ঞান গবেষণার যন্ত্রগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল – কোন কোনটির দাম কয়েক কোটি টাকা পর্যন্ত হয়। সেই তুলনায় এক কোটি টাকার সরঞ্জাম বিশাল কিছু নয়, কিন্তু একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের চেষ্টায় এতগুলো অত্যাধুনিক যন্ত্র জোগাড় করা নিঃসন্দেহে অসাধারণ সাফল্য। তিনি বলেছেন, যে কাজটি হাতে নিয়েছেন তা শেষ না করে ছাড়েন না – ল্যাব গড়ার ব্যাপারে তার সংকল্প ছিল অটল। “আমার স্বপ্ন ছিল আমি একটা ল্যাব দাঁড় করাবো… আমি যখন যা ধরি, শেষ না করে ছাড়ি না”, এই মনোভাব নিয়ে তিনি একে একে স্বপ্নের ল্যাবটি দাঁড় করিয়েছেন। বাহ্যিক সহায়তা ও বড় বাজেট ছাড়াই, শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তি, ব্যক্তিগত সঞ্চয় এবং আন্তরিক সহযোগিতা দিয়ে যে গবেষণার ভিত গড়ে তোলা যায় – ড. মিজানুর রহমান তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

প্রেরণা এবং উপসংহার: দেশের জন্য বিজ্ঞানের আলো

ড. এ টি এম মিজানুর রহমানের গল্পটি আমাদের শেখায় যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যদি লক্ষ্য স্থির রাখা যায়, তবে সাফল্য আসবেই। একজন মানুষ হিসেবে তার জীবনসংগ্রাম এবং একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তার উদ্ভাবনী চিন্তা মিলেমিশে একটি অনুপম উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে দেশের সাধারণ সমস্যা – কৃষিতে রোগবালাই, খাদ্যে ভেজাল, জনস্বাস্থ্যে প্রাণঘাতী সংক্রমণ – এসবের সমাধানে বিজ্ঞানকে কাজে লাগানো যায়। আবার একই সাথে দেখিয়েছেন, অবকাঠামোগত ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম দিয়ে গবেষণার উৎকর্ষ অর্জন সম্ভব। বিদেশের মাটিতে কঠোর শ্রমে অর্জিত জ্ঞান তিনি ফিরিয়ে এনেছেন নিজের দেশে, শুধুমাত্র জাতির কল্যাণের স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে। তার মত কিছু নিঃস্বার্থ গবেষকের চেষ্টায় হয়তো একদিন আমাদের অপুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তার সমস্যাগুলো দূর হবে, দেশীয় প্রযুক্তিতে উৎপাদিত হবে বিষমুক্ত খাদ্য ও ফসলরক্ষা উপকরণ, এবং কঠিন রোগের ওষুধও আমাদের নিজেদের হাতেই বের হবে।

এই অগ্রযাত্রায় অবশ্যই প্রয়োজন সর্বস্তরের সহযোগিতা। ড. মিজানুর রহমানের সাক্ষাৎকারের শেষ অংশে আহ্বান জানানো হয়েছিল যে আমরা সবাই মিলে তার মতো উদ্ভাবককে সহযোগিতা করি এবং দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীরা তার সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করেন। সত্যিই, উন্নয়নের জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার বিকল্প নেই। যারা বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন, তারা যদি ড. মিজানুরের মতো করে দেশে ফিরে আসেন এবং সমমানের উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করেন, তাহলে বাংলাদেশও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে একদিন শীর্ষ স্থান দখল করতে পারে।

ড. মিজানুর রহমান তরুণদের উদ্দেশ্যে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে যে পরামর্শ দেন তা হলো – শিক্ষকদের যদি গবেষণার প্রতি মনোযোগ থাকে, তবে ছাত্রছাত্রীদের মাঝেও গবেষণার আগ্রহ জাগবে। তাই আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, বাজেট ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের উচিৎ এখন থেকেই বিশ্লেষণী মনোভাব গড়ে তোলা, ছোটখাটো গবেষণা প্রকল্পে হাতেখড়ি নেওয়া। দেশে থেকেই যদি তারা ছোট কিছু প্রজেক্ট সম্পন্ন করে বা গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে পারে, তবে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে সুযোগ পাওয়া অনেক সহজ হবে। সর্বোপরি, যে দেশ তাদের শিক্ষায় বিনিয়োগ করেছে, সেই দেশের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে অর্জিত জ্ঞান ফিরিয়ে দেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। ড. মিজানুর রহমানের জীবনের সংগ্রাম ও সাফল্য আমাদের শেখায় যে সংকল্প, কঠোর পরিশ্রম এবং দেশপ্রেম একসাথে থাকলে যেকোনো বাধাই অতিক্রম করা যায়।

দেশের প্রতি ভালবাসা ও বিজ্ঞানচর্চার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে ড. এ টি এম মিজানুর রহমান যেভাবে কাজ করে চলেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয় ও অনুকরণীয়। তার মতো মানুষের স্বপ্ন সফল হোক – উদ্ভাবনী জৈব কীটনাশক হোক বা কার্যকরী খাদ্য, প্রতিটি উদ্যোগেই দেশ সাফল্যের স্বাদ পাক। নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের জন্য ড. মিজানুর রহমান একটি জীবন্ত অনুপ্রেরণা, যারা প্রমাণ করছেন যে বিশ্বমানের গবেষণা বাংলাদেশ থেকেই করা সম্ভব এবং তা সরাসরি মানুষের জীবনে উন্নতি এনে দিতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা, উপযুক্ত সমর্থন পেলে ড. মিজানুর রহমানের চিন্তাগুলো বাস্তবায়িত হবে এবং বাংলাদেশের বিজ্ঞান গবেষণা এক নতুন যুগে পদার্পণ করবে, যেখানে বিজ্ঞানীরা জাতির সমস্যার সমাধানে নেতৃত্ব দেবে এবং তরুণরা উৎসাহ পাবে দেশের জন্য গবেষণা ও উদ্ভাবনে আত্মনিয়োগ করতে।

সত্যিই, জ্ঞানই শক্তি – আর সে শক্তি যখন জাতির কল্যাণে নিয়োজিত হয়, তখন কোন স্বপ্নই আর দূরবর্তী থাকে না।

ড. মিজানুর রহমান এর সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি নিম্নের ইউটিউবের লিংকে দেখুন। 👇👇👇

কৃতজ্ঞতা

  • সাক্ষাৎকারটি ১৪ ডিসেম্বর ড. মিজানুর রহমান এর ল্যাবে অনুষ্ঠিত হয়।
  • বিজ্ঞানী অর্গ এর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নেন তাহসিন আহমেদ সুপ্তি।
  • ভিডিও ধারনে সহায়তা করেন সাদিয়া ও পুষ্পিতা
  • সাক্ষাৎকারটির ভিডিও সম্পাদনা করতে সহায়তা করেন মহিউদ্দিন।
  • সাক্ষাৎকারটির উপর ভিত্তি করে প্রবন্ধটি লিখেন বিজ্ঞানী অর্গ এর সম্পাদক ড. মশিউর রহমান।
  • বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই নুর-ইস-সাবা হুমায়রা ম্যাডামকে ড. মিজানুর রহমান এর সাথে সাক্ষাৎকারটি নেবার জন্য সার্বিক সহায়তা করার জন্য।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org