ঢাকার উত্তরার একটি সাধারণ বাসায় থাকে দশম শ্রেণির ছাত্রী আনিকা রহমান, যার দিন কাটে জীববিজ্ঞান আর জিনতত্ত্ব নিয়ে বই পড়ে। বিজ্ঞান তার নেশা, জিনতত্ত্ব তার প্রিয় অধ্যায়। একদিন তার জীববিজ্ঞান বইতে সে পড়ে বিখ্যাত ডিএনএ-র “ডাবল হেলিক্স” গঠনের কথা—দুটি সুতো পাক খেয়ে জড়িয়ে আছে, যেন একটি সিঁড়ি মোড়ানো আকারে। কিন্তু সম্প্রতি সে যখন একটি বৈজ্ঞানিক সংবাদ পড়ে, তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়—ডিএনএ শুধু ডাবল হেলিক্স নয়, আরও এক নতুন গঠন খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
সেই গঠনের নাম “i-motif”—একটি গাঁঠযুক্ত, চার-সুতোয় গঠিত ডিএনএ স্ট্রাকচার, যা মানব কোষে প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান। এটি এমন এক আবিষ্কার যা ডিএনএ-এর জটিলতা সম্পর্কে আমাদের পূর্বের সব ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
বহুবছরের রহস্যভেদ:
এই রহস্যময় গঠন প্রথম ১৯৯০-এর দশকে শনাক্ত হয়েছিল, তবে তখন কেবল ল্যাবরেটরি পরিবেশেই দেখা গিয়েছিল। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার গারভান ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল রিসার্চ-এর বিজ্ঞানীরা এক বিশেষ অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে মানব কোষে এই গঠনটি বাস্তব সময়ে দেখতে সক্ষম হন।
গবেষক ডঃ ড্যানিয়েল ক্রিস্ট বলেন:
“আমরা দীর্ঘদিন ধরে জানতাম যে ডিএনএ শুধু ডাবল হেলিক্স নয়। কিন্তু এই প্রথমবার আমরা জীবন্ত কোষে i-motif এর অস্তিত্ব দেখতে পেলাম। এটি এক বিপ্লবের সূচনা।”
i-motif আসলে কী?
আমরা জানি, প্রচলিত ডিএনএ-তে সাইটোসিন (C) সাধারণত গ্যানিন (G)-এর সঙ্গে বিপরীত স্ট্র্যান্ডে জোড়া বাঁধে। কিন্তু i-motif গঠনে সাইটোসিন একে অপরের সঙ্গে একই স্ট্র্যান্ডে জোড়া বাঁধে, গঠিত হয় একধরনের গাঁঠযুক্ত চারস্তরবিশিষ্ট রূপ। এই গাঁঠগুলো বেশিরভাগ সময় গঠিত হয় জিন নিয়ন্ত্রণকারী এলাকায় এবং টেলোমিয়ার অঞ্চলে—যা কোষ বার্ধক্যের সাথে সরাসরি যুক্ত।
গবেষণার প্রভাব:
এমন গঠনগুলোর উপস্থিতি বোঝায়, ডিএনএ তার গঠন বদলিয়ে জিনের কার্যকারিতা ও নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। যেমন, কিছু নির্দিষ্ট সময়ে i-motif গঠন তৈরি হয়, আবার ভেঙে যায়, যা ইঙ্গিত করে এটি কোনো সংকেত হিসেবে কাজ করতে পারে।
বিশিষ্ট জিনতত্ত্ববিদ ডঃ মেহেদী হাসান জানান,
“এই ধরনের গঠনগুলো আমাদের জিন এক্সপ্রেশন এবং কোষীয় বয়ঃজনিত পরিবর্তন নিয়ে গবেষণায় নতুন দিক উন্মোচন করতে পারে। হয়তো ভবিষ্যতে এর ভিত্তিতে বার্ধক্য প্রতিরোধ বা ক্যানসারের নির্দিষ্ট চিকিৎসা বের করা সম্ভব হবে।”
নতুন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে:
i-motif ছাড়াও বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে G-quadruplex নামক আরেকটি বিকল্প ডিএনএ গঠন আবিষ্কার করেছেন। এই নতুন গঠনগুলো নিয়ে গবেষণা এখন জোরেশোরে চলছে। এর মাধ্যমে শুধু ডিএনএ নয়, বরং পুরো জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে আরও গভীর জ্ঞান অর্জনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
প্রকাশিত হয়েছে এই গবেষণার পূর্ণ বিবরণ Nature Chemistry নামক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে।
(পড়তে পারেন: https://www.nature.com/articles/s41557-018-0046-3)
শেষ কথা:
বিজ্ঞান যেন সবসময় আমাদের চেনা জগতে নতুন এক জানালার খোঁজ দেয়। ডিএনএ-র এই নতুন গঠন, i-motif, তারই এক নিখুঁত উদাহরণ। হয়তো আগামী দিনে এই গাঁঠযুক্ত রহস্যময় গঠনই খুলে দেবে চিকিৎসা, বার্ধক্য রোধ ও জিন প্রযুক্তির নতুন দিগন্ত।
এই আবিষ্কার শুধু গবেষকদের নয়, নতুন প্রজন্মের কৌতূহলী শিক্ষার্থীদের মনেও আগুন জ্বালাচ্ছে। আনিকার মতো তরুণরাই হয়তো ভবিষ্যতের সেই বিজ্ঞানী, যারা জীবনের গোপন রহস্য উদঘাটনের পথে নতুন পথ খুলে দেবে।
Leave a comment