ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাফি এক বিকেলে টিএসসির চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিল বন্ধুদের সঙ্গে। হাতে গরম চা, মাথায় হাজারো ভাবনা—আগামী সেমিস্টারের পরীক্ষার চাপ, টিউশনি থেকে পাওয়া অল্প আয়, আর পরিবারের আশা-ভরসার বোঝা। কথা ঘুরতে ঘুরতে এক বন্ধু বলল, “ভাই, জানিস, আমার চাচা এখনো বলে, বিয়ে করিস না, আগে প্রচুর টাকা জমা কর।” রাফি হেসে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু জীবনের আনন্দটা কখন নেব? পঁচাত্তরে গিয়ে?” এই হাসিঠাট্টার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক গভীর প্রশ্ন—আমরা কি জীবনের আনন্দ ক্রমশ পিছিয়ে দিচ্ছি, যতক্ষণ না হয়তো সময়ই ফুরিয়ে যায়?
বিল পারকিন্সের Die With Zero বইটি সেই প্রশ্নেরই জোরালো উত্তর খোঁজে। লেখকের মূল বক্তব্য সরল অথচ সাহসী—জীবন কেবল টাকা জমিয়ে রাখার জন্য নয়; বরং সেই অর্থ, সময়, ও শক্তি এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে, যাতে জীবনের শেষে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে শূন্য টাকা থাকলেও স্মৃতির ভাণ্ডার ভরা থাকে। অর্থাৎ, লক্ষ্য শুধু সঞ্চয় নয়, বরং অভিজ্ঞতার পূর্ণতা।
বইটির প্রথম অধ্যায়ে পারকিন্স পাঠককে একটা ধাক্কা দেন—আমরা ছোটবেলা থেকে শিখেছি ‘সঞ্চয় করো’, ‘ভবিষ্যতের জন্য রাখো’, কিন্তু কেউ শেখায় না কখন সেই সঞ্চয় ভাঙতে হবে। লেখক বলেন, “মানুষ বেঁচে থাকার সময় অর্থ ব্যয় না করে এমনভাবে সঞ্চয় করে যেন তারা মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকবে।” বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে স্নাতক শিক্ষার্থীদের জন্য, এই দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে নতুন। আমাদের সমাজে বাবা-মা ও আত্মীয়রা প্রায়শই বলেন, “এখন মেহনত করো, ভবিষ্যতে উপভোগ করবে।” কিন্তু পারকিন্স বলছেন—ভবিষ্যৎ তো অনিশ্চিত; স্বাস্থ্য, সময়, এবং সুযোগ একসাথে খুব কমই মেলে।
বইটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা এসেছে—টাইম বাকেটিং। জীবনের প্রতিটি পর্যায়কে (যেমন ২০-৩০, ৩০-৪০ বছর) একটি ‘টাইম বাকেট’ হিসেবে কল্পনা করে, প্রতিটি পর্যায়ে কী অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চান তার তালিকা বানান। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এটি ব্যবহার করে দেখতে পারে—বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হয়তো তারা চায় বন্ধুদের সঙ্গে সেন্ট মার্টিনে যাওয়া, স্বেচ্ছাসেবী প্রকল্পে অংশ নেওয়া, বা কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়া। পারকিন্স বলছেন, এই অভিজ্ঞতাগুলো পরে নকল করা সম্ভব নয়, কারণ বয়স বাড়লে সময় ও শারীরিক সক্ষমতা বদলে যায়।
লেখক আরেকটি শব্দ ব্যবহার করেছেন—মেমোরি ডিভিডেন্ড। এর মানে, একটি ভালো অভিজ্ঞতা শুধু একবার আনন্দ দেয় না, বরং সারাজীবন সেই স্মৃতি থেকে সুখ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, একবার বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজারে ভ্রমণের স্মৃতি হয়তো আপনার শেষ বয়স পর্যন্ত মনে রঙ ছড়িয়ে দেবে। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফলের সেই ক্ষণস্থায়ী আনন্দ কি এত দীর্ঘস্থায়ী? বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য এই ধারণা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক—কারণ আমাদের সমাজে অভিজ্ঞতার চেয়ে গ্রেড, ডিগ্রি, এবং চাকরির নিরাপত্তাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
তবে বইটি কেবল খরচ করার আহ্বান নয়। পারকিন্স বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বলেন, অভিজ্ঞতার জন্য খরচ মানে আর্থিক অবিবেচনা নয়। বরং তিনি পরামর্শ দেন জীবনের মোট আয়ের হিসাব করে একটি বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনা করতে, যেখানে নির্দিষ্ট অংশ অভিজ্ঞতার জন্য বরাদ্দ থাকবে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ছোট বাজেটেও এটি প্রয়োগ করতে পারে—যেমন মাসে এক-দুইবার নতুন কোনো রেস্টুরেন্টে খাওয়ার পরিকল্পনা, স্বল্প খরচের ভ্রমণ, বা বিনামূল্যে সাংস্কৃতিক ইভেন্টে অংশগ্রহণ।
বইটির বড় একটি শক্তি হলো, এটি পাঠককে সঞ্চয়ের মানসিকতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। বাংলাদেশে অনেক তরুণ নিজেদের আগ্রহ ও শখ পিছিয়ে দেন ‘সঞ্চয় করে পরে করব’ ভেবে। পারকিন্সের বক্তব্য হলো—পরে হয়তো আপনার সেই আগ্রহ বা করার সক্ষমতা থাকবে না। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের ইচ্ছে থাকলেও চাকরির পর ব্যস্ততা, পরিবার, স্বাস্থ্য ইত্যাদির কারণে তা আর সম্ভব নাও হতে পারে।
তবে বইটির একটি সীমাবদ্ধতা আছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। লেখকের পরামর্শ মূলত উন্নত দেশের নিরাপত্তা ও সুযোগের প্রেক্ষিতে দেওয়া। বাংলাদেশে আর্থিক অনিশ্চয়তা, চাকরির বাজারের প্রতিযোগিতা, এবং পারিবারিক দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। তাই “ডাই উইথ জিরো” ধারণা পুরোপুরি অনুসরণ করলে কিছু ঝুঁকি থাকতে পারে—যেমন জরুরি প্রয়োজনে অর্থের অভাব বা হঠাৎ কোনো পারিবারিক সংকটে সহায়তা করতে না পারা। এজন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের উচিত এই দর্শনকে হুবহু নয়, বরং সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গ্রহণ করা।
এই ভারসাম্য কেমন হতে পারে? উদাহরণস্বরূপ, মাসিক আয় বা হাতখরচের একটি ছোট অংশ অভিজ্ঞতায় খরচ করা, আর বাকিটা সঞ্চয় রাখা। এতে যেমন ভবিষ্যতের নিরাপত্তা থাকবে, তেমনি জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে অর্থবহ স্মৃতি তৈরি হবে। শিক্ষার্থীরা হয়তো পরিবারকে ছোটখাটো উপহার দিতে পারে, বন্ধুদের নিয়ে একটি আউটডোর প্রজেক্ট করতে পারে, বা নিজের প্যাশন প্রজেক্টে সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে।
বইটি পড়তে গিয়ে মনে হয়, পারকিন্স যেন তরুণদের কানে ফিসফিস করে বলছেন—“জীবন একবারই, তাই এখনই বাঁচো।” এই বার্তাটি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ সময়টিই জীবনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময়, উন্মুক্ত, এবং স্বাধীন অধ্যায়। এই সময়ে গড়া অভিজ্ঞতাগুলোই পরবর্তীতে জীবনের গল্প হয়ে ওঠে।
রিভিউয়ের শেষ প্রান্তে এসে, বাংলাদেশের একজন স্নাতক শিক্ষার্থীকে আমি বলব—Die With Zero পড়া মানে কেবল টাকা খরচের অনুপ্রেরণা নেওয়া নয়। বরং এটি জীবনের অগ্রাধিকার নিয়ে ভাবার আহ্বান। আমরা কি শুধু নিরাপত্তার খাতিরে জীবন কাটাব, নাকি অভিজ্ঞতার রঙে ভরিয়ে তুলব আমাদের দিনগুলো? হয়তো আমাদের উচিত এমন এক পথ খোঁজা, যেখানে ভবিষ্যৎ নিরাপদ থাকবে, কিন্তু বর্তমানও শূন্য থাকবে না।
বিল পারকিন্সের বইটি এই দোটানার মাঝখানে আলো জ্বালিয়ে দেয়—বলতে শেখায়, জীবনের সমীকরণে শূন্য মানে অপচয় নয়, বরং পূর্ণতা।

Leave a comment