✍️ নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
📧 যোগাযোগ: biggani.org
বিশ্ব এখন এমন এক সময়ে প্রবেশ করেছে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে মানুষের মুখ, কণ্ঠস্বর, এমনকি শরীরের ভঙ্গিমাও নকল করে বানানো যাচ্ছে। যাকে আমরা বলি ডিপফেইক (deepfake) — এই প্রযুক্তির মাধ্যমে এমন ভিডিও তৈরি হচ্ছে, যেগুলো এতটাই বাস্তব মনে হয় যে তা আসল ভিডিও থেকে আলাদা করা অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই প্রযুক্তি যেমন মজার জন্য ব্যবহার হচ্ছে, তেমনি ব্যবহৃত হচ্ছে প্রতারণা, মানহানি ও ভুয়া প্রচারণার উদ্দেশ্যে।
এই প্রেক্ষাপটে ডেনমার্ক ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে এমন একটি আইন প্রণয়নের পথে এগোচ্ছে, যার মাধ্যমে প্রতিটি নাগরিকের নিজের মুখ, কণ্ঠস্বর ও শরীরের ডিজিটাল উপস্থাপনার ওপর স্বত্বাধিকার (কপিরাইট) স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ, কেউ যদি আপনার ডিজিটাল রূপ ব্যবহার করে কিছু তৈরি করে — আপনার অনুমতি ছাড়া — তা হবে আইনত অপরাধ।
চলুন বিস্তারিতভাবে জানি এই প্রস্তাবিত আইনের দিকগুলো।
✅ ব্যক্তিগত চেহারা, কণ্ঠ ও শরীরের স্বত্বাধিকার
ডেনমার্কের এই আইন অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের মুখ, কণ্ঠস্বর ও শরীরের ডিজিটাল উপস্থাপনা তাদের নিজস্ব কপিরাইট সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। কেউ যদি এই বৈশিষ্ট্যগুলো কৃত্রিম উপায়ে পুনরুৎপাদন বা ব্যবহার করতে চায়, তবে তাকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্মতি নিতে হবে।
এটি শুধু কোনো নামী ব্যক্তিত্ব নয়, সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এমনকি যদি AI ব্যবহার করে কারো মুখ বসিয়ে অন্য একটি ভিডিও বানানো হয়, সেটিও অপরাধের মধ্যে পড়বে যদি অনুমতি না থাকে।
🤖 ডিপফেইক প্রযুক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপ
এই আইন মূলত AI দ্বারা তৈরি ডিপফেইক ভিডিও ও অডিও’র অপব্যবহার ঠেকাতেই গ্রহণ করা হচ্ছে। আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে—
- রাজনীতিবিদদের মুখ বসিয়ে ভুয়া বিবৃতি প্রচার
- অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নকল ভিডিও তৈরি
- সাধারণ মানুষের নামে ভুয়া ভিডিও তৈরি করে ব্ল্যাকমেইল করা
এই ধরনের ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যক্তি নিজে আইনত পদক্ষেপ নিতে পারবে এবং ভিডিও বা কনটেন্ট সরিয়ে ফেলার দাবি জানাতে পারবে।
ডেনমার্ক সরকার মনে করছে, ডিপফেইক এখন শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত বিষয় নয় — এটি ব্যক্তিগত অধিকার ও নিরাপত্তার বিষয়।
🎭 কাদের জন্য প্রযোজ্য?
এই কপিরাইট আইন শুধু সাধারণ মানুষ নয়, পরিচিত শিল্পী ও পারফর্মারদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অনেক সময় কোনো শিল্পীর কণ্ঠস্বর, মুখাবয়ব, নাচ বা অভিনয় নকল করে ডিজিটাল পরিবেশে ব্যবহার করা হয়। এই আইনের ফলে সেইসব ক্ষেত্রেও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
তবে আইনটি কিছু ব্যতিক্রমও রাখছে।
😂 ব্যতিক্রম: ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপে ছাড়
আইনটি প্যারোডি (ব্যঙ্গচিত্র), স্যাটায়ার (বিদ্রূপ) বা কৌতুকপূর্ণ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ছাড় দিচ্ছে। অর্থাৎ, কেউ যদি ব্যঙ্গাত্মকভাবে কোনো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের চরিত্র উপস্থাপন করে ভিডিও বানায়, এবং তা স্পষ্টভাবে রসিকতার জন্য হয়, তাহলে তা আইনের আওতায় পড়বে না।
এখানে লক্ষ্য রাখা হয়েছে, যেন সৃজনশীলতা ও শিল্পের স্বাধীনতা ব্যাহত না হয়, আবার ব্যক্তিগত স্বত্বাধিকারও সুরক্ষিত থাকে।
💰 প্রয়োগ ও জরিমানা
যেসব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম (যেমন: ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক) ব্যবহারকারীর অভিযোগ পাওয়ার পরেও ডিপফেইক কনটেন্ট সরিয়ে ফেলতে ব্যর্থ হবে, তাদেরকে বড় অংকের জরিমানা করা হতে পারে। এটি সেইসব প্ল্যাটফর্মের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে যাতে তারা আরও সক্রিয়ভাবে ডিজিটাল অধিকার রক্ষা করে।
ডেনমার্ক জানিয়েছে, তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (EU) সভাপতিত্বের সময় এ ধরণের আইন ইউরোপজুড়ে প্রচলনের জন্য উদ্যোগ নেবে।
🌍 কেন এই আইন এখন এত গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্বে যখন প্রযুক্তি দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, তখন আইনি কাঠামো প্রায়ই পেছনে পড়ে যায়। ডিপফেইক প্রযুক্তির মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে বিভ্রান্তি, প্রতারণা, এমনকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপপ্রচার। অনেক সময় সাধারণ মানুষ না জেনেই বিশ্বাস করে নিচ্ছে ভুয়া কনটেন্ট।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৩ সালেই বিশ্বজুড়ে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ডিপফেইক ভিডিও অনলাইনে ছিল। এর মধ্যে শতকরা ৯৬ ভাগ ছিল পর্নগ্রাফিক এবং সেগুলোর অধিকাংশই নারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে।
এই আইনের ফলে মানুষ যেমন নিজের ডিজিটাল পরিচয় রক্ষা করতে পারবে, তেমনি মানবিক সম্মান, গোপনীয়তা ও স্বাধীনতাও সুরক্ষিত থাকবে।
📢 আমাদের মতামত: ভবিষ্যতের জন্য একটি সাহসী পদক্ষেপ
ডেনমার্কের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সাহসী এবং সময়োপযোগী। এই আইনের মাধ্যমে প্রযুক্তির উন্নয়নের পেছনে লুকিয়ে থাকা মানবিক বিপদের দিকটি গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়েছে। এটি একটি মাইলফলক হতে পারে, যা অন্যান্য দেশকে অনুপ্রাণিত করবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই আইনটি চিন্তার খোরাক যোগায়। কারণ আমাদের দেশেও এখন ডিজিটাল কনটেন্টের ব্যবহার বাড়ছে, এবং এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ঘটনা।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ যদি নাগরিকদের ডিজিটাল স্বত্বাধিকার নিয়ে আইন করে, তবে সেটি হবে একটি বড় পদক্ষেপ ডিজিটাল মানবাধিকারের পথে।
📌 উপসংহার
মুখ, কণ্ঠ, শরীর — এগুলো কেবল বায়োলজিক্যাল পরিচয় নয়, বরং এখন ডিজিটাল যুগে এগুলোর রয়েছে ব্যক্তিগত ও আইনগত মূল্য। ডেনমার্কের এই পদক্ষেপ আমাদের বুঝিয়ে দেয়, ভবিষ্যতের প্রযুক্তি যদি আমাদের অগ্রসর করে, তবে আইনও সে অনুযায়ী অগ্রসর হওয়া জরুরি।
আপনি কী চান, আপনার মুখের ওপর আপনারই অধিকার থাকুক?
তাহলে এমন আইনের কথা এখন থেকেই ভাবা দরকার — কারণ AI কিন্তু আমাদের অপেক্ষা করছে না।
📢 আপনি কী ভাবছেন এই বিষয়ে?
মন্তব্য করুন biggani.org ফেসবুক পেজে বা লিখুন [email protected] ঠিকানায়।
আপনার মতামতই আমাদের আগামী প্রতিবেদন গঠনে সহায়ক হবে।
🗞 বিজ্ঞানী অর্গ – বিজ্ঞানের কথা সবার জন্য।
Leave a comment