ছোট্ট সাবিহা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “আব্বু, ওই তারা গুলো কি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে?” সাবিহার বাবা হাসিমুখে বলে ওঠেন, “তারা আমাদের দিকে না, আমরা তাদের খোঁজে তাকিয়ে আছি।”
এই এক জিজ্ঞাসা—আকাশের রহস্য জানার আকাঙ্ক্ষা—যে যুগে যুগে মানুষকে টেনে এনেছে মহাবিশ্বের অজানার পথে। কিন্তু এক বিস্ময়কর সত্য হলো, আমরা যতটুকু দেখি—তারা, গ্রহ, গ্যালাক্সি—সব মিলিয়ে এই ‘দেখা পৃথিবী’ আসলে মাত্র ৫ শতাংশ!
অন্য ৯৫ শতাংশ কোথায়?
বিজ্ঞানীদের মতে, বাকি ৯৫ শতাংশ মহাবিশ্ব গঠিত হয়েছে এমন কিছু উপাদানে যা আমরা দেখতে পাই না, স্পর্শ করতে পারি না, কিন্তু তাদের অস্তিত্ব অনুভব করি। এর একটি অংশ হলো ডার্ক ম্যাটার (অন্ধকার বস্তু) আর অন্যটি ডার্ক এনার্জি (অন্ধকার শক্তি)।
এই নামগুলো শুনে যেন ভৌতিক কোনও গল্পের কথা মনে হয়, কিন্তু এরা মহাবিশ্বের ভারসাম্য বজায় রাখে, সম্প্রসারণ ঘটায়, এমনকি গ্যালাক্সিকে ছিন্নভিন্ন হওয়া থেকে বাঁচায়।
মহাবিশ্বের এমন রহস্যময় গঠন আমাদের বুঝিয়ে দেয়, আমরা এখনো অনেক কিছু জানি না। ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি হচ্ছে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ডার্ক ম্যাটার: ছায়া যার ভর আছে
ডার্ক ম্যাটার দেখতে না পাওয়া গেলেও, এটি তার আকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এটি এমন এক ধরনের বস্তু যা আলো শোষণ বা প্রতিফলন করে না। অথচ, গ্যালাক্সির ঘূর্ণনের প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বুঝেছেন—এখানে এমন কিছু রয়েছে, যা প্রচলিত পদার্থ নয়, কিন্তু যার ভর আছে।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভেরা রুবিন (যিনি গ্যালাক্সির ঘূর্ণনের গতিশীলতা নিয়ে কাজ করেছিলেন) বলেছিলেন, “আমরা যা দেখি, তা আসলে পুরো ছবির সামান্য এক টুকরো। বাকি অংশ লুকিয়ে আছে অন্ধকারে।”
ডার্ক এনার্জি: বিস্তৃতির রহস্য
১৯৯৮ সালে এক দল জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশ করেন—মহাবিশ্ব কেবল সম্প্রসারিতই হচ্ছে না, বরং সেই সম্প্রসারণ দ্রুততর হচ্ছে। এই বিস্তৃতিকে চালিত করে ডার্ক এনার্জি নামক এক শক্তি, যা মহাবিশ্বের ৬৮% অংশ গঠন করে।
আজ অবধি আমরা এই শক্তির উৎস জানি না, কিন্তু এর অস্তিত্ব অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
জনমত ও আগ্রহ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাবিহা মাহমুদ বলেন, “আমরা ছোটবেলা থেকেই তারা দেখি, কিন্তু জানতাম না যে ওই দৃশ্যমান আকাশটাই সব নয়। এই ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জির বিষয়গুলো শুনে একধরনের ভয়, আবার কৌতূহল দুটোই কাজ করে।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নবীন গবেষক রাফি আদনান বলেন, “নতুন প্রজন্ম এখন মহাবিশ্ব নিয়ে আগ্রহী। আমরা চেষ্টা করি বিজ্ঞানকে সহজ ভাষায় বোঝাতে, যেন সবাই অনুধাবন করতে পারে—কতটা অজানা এখনো রয়ে গেছে।”
এগিয়ে চলার আহ্বান
মহাবিশ্বের এই রহস্য উদঘাটনে চলছে গবেষণা, তৈরি হচ্ছে টেলিস্কোপের নতুন প্রজন্ম। নাসার জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ, ইউরোপের ডার্ক এনার্জি সার্ভে, এবং CERN-এর লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার—সবই যুক্ত এই বৃহৎ অনুসন্ধানে।
বিজ্ঞানী ড. মশিউর রহমান বলেন, “এই গবেষণাগুলোর ফলাফল শুধু মহাকাশের জন্য নয়, বরং পদার্থবিদ্যার নতুন দিগন্ত উন্মোচনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি নবীন প্রজন্মকে মহাকাশ বিজ্ঞানে আরো গবেষনার জন্য উৎসাহিত করেন।
শেষ কথা:
আমরা যা দেখি, তা-ই যদি সত্য হতো, তাহলে বিজ্ঞানের দরকারই ছিল না। মানুষের কৌতূহলই তাকে সামনে নিয়ে চলে, অন্ধকারের ভিতর আলো খোঁজার সেই চিরন্তন অভিযানে।
আজও সেই অভিযাত্রা চলছে—মহাবিশ্বের ৯৫% অজানাকে জানতে, ছুঁতে, ও একদিন বোঝার আশায়।
সূত্র: NASA, ESA, Dark Energy Survey, Nature Journal, Interviews with Local Experts and Enthusiasts.
Leave a comment