তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক খবর

সাইবর্গ তেলাপোকা: বিজ্ঞানের নতুন বিস্ময় নাকি বিপদের পূর্বাভাস?

Share
Share

রাতের শহর, এক অনিবার্য অতিথি

রাতের আধো-অন্ধকার ঘরে হঠাৎ আলোর সুইচ চাপতেই দেয়ালের ফাঁক দিয়ে নিঃশব্দে সরে গেল এক ছায়ামূর্তি। কৌতূহলী হয়ে তাকাতেই দেখা গেল—একটি তেলাপোকা! আমাদের অনেকেরই অপছন্দের এই প্রাণী প্রকৃতপক্ষে এক অবিশ্বাস্য টিকে থাকার যোদ্ধা। কিন্তু কেমন হবে যদি এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যেত? যদি আমরা তাদের গতি-বিধি নির্দেশনা দিতে পারতাম?

বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এখন সেটাই সম্ভব! জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্দোনেশিয়ার দিপোনেগোরো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তেলাপোকাকে সাইবর্গে রূপান্তরিত করেছেন। বিশেষ ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস যুক্ত করে তারা তেলাপোকাকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে নজরদারির মতো ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারে।

বিজ্ঞান ও প্রকৃতির মেলবন্ধন: কীভাবে কাজ করে এই সাইবর্গ তেলাপোকা?

গবেষকরা মাদাগাস্কার হিসিং ককরোচ (Gromphadorhina portentosa) নামে পরিচিত বড় আকারের তেলাপোকাগুলোর ওপর পরীক্ষা চালিয়েছেন। বিশেষ ধরনের ইলেকট্রনিক ব্যাকপ্যাকসেন্সর সংযুক্ত করে তারা তেলাপোকার চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

এই গবেষণার প্রধান মোচাম্মাদ আরিয়ানতো, যিনি দিপোনেগোরো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন যান্ত্রিক প্রকৌশলী, জানান:

“ক্ষুদ্রাকৃতির রোবট তৈরিতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ থাকে। কিন্তু আমরা সহজ সমাধান খুঁজেছি – প্রাকৃতিকভাবে অভিযোজিত জীবকেই প্রযুক্তির সঙ্গে একীভূত করা।”

গবেষকরা তেলাপোকার শুড়ের স্নায়ুতে ইলেকট্রোড সংযুক্ত করেছেন, যা বিদ্যুৎ সংকেতের মাধ্যমে তাদের গতিপথ নির্দেশ করতে পারে। এর ফলে তেলাপোকাগুলোকে সংকীর্ণ ও বিপদজনক জায়গায় পাঠিয়ে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব।

তেলাপোকার পিঠে সংযুক্ত মাইক্রো-ইলেকট্রনিক্সের মাধ্যমে তার চলাচলের নির্দেশনা দেওয়া যায়। শুড়ের স্নায়ুতে সংযুক্ত ইলেকট্রোডের মাধ্যমে হালকা বৈদ্যুতিক সংকেত প্রেরণ করলেই তেলাপোকা নির্দিষ্ট পথে চলে যায়।

উদ্ভাবন বনাম নৈতিকতা: এই প্রযুক্তি কি শুধুই বিজ্ঞান নাকি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার?

এই নতুন প্রযুক্তি বিপর্যস্ত এলাকা ও উদ্ধারকাজে ব্যবহারের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষদের শনাক্ত করতে অথবা রেডিও-সক্রিয় পরিবেশে অনুসন্ধান চালাতে এই সাইবর্গ তেলাপোকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কেইসুকে মোরিশিমা বলেন:

“রোবটের প্রধান সমস্যা হলো ভারসাম্য ও স্বায়ত্তশাসিত চলাচল। কিন্তু আমাদের এই বায়োহাইব্রিড প্রযুক্তি সহজেই সেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারে।”

তবে এই প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকও রয়েছে। নজরদারি, গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম বা এমনকি সামরিক কাজে এর অপব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—এই প্রযুক্তি কি শুধু বিজ্ঞানীদের হাতে থাকবে নাকি এটি নিয়ন্ত্রণের নতুন অস্ত্র হয়ে উঠবে?

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ইতিমধ্যেই অনুরূপ প্রযুক্তির পরীক্ষা চালাচ্ছে ড্রোনের বিকল্প হিসেবে, যা নজরদারির জন্য ব্যবহার করা হতে পারে।

প্রযুক্তি বিশ্লেষক ড. আহসানুল করিম বলেন:

“প্রযুক্তির দুইটি দিক থাকে—একটি উন্নয়নের, অন্যটি নিয়ন্ত্রণের। এটি যদি নজরদারির হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তবে সাধারণ মানুষের গোপনীয়তা ঝুঁকির মুখে পড়বে।”

ভবিষ্যতের পথ: বিজ্ঞান কতদূর এগোবে?

এই গবেষণাটি Soft Robotics জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এখনো এই সাইবর্গ তেলাপোকাদের আরও নিখুঁতভাবে পরিচালিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদি এটি সফল হয়, তবে ভবিষ্যতে আরও অনেক জীবকেও এমন প্রযুক্তির সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

যদি জীবজগতের ছোট্ট সদস্যদের এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়, তবে ভবিষ্যতে কি মানুষের ওপরও অনুরূপ প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হবে? এটি কি এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত, নাকি মানব নিয়ন্ত্রণের আরও একটি দৃষ্টান্ত? বিজ্ঞান এগিয়ে চলেছে, কিন্তু সেই সাথে বাড়ছে আমাদের দায়িত্বও।

আপনার মতামত কী? প্রযুক্তির এই অগ্রযাত্রা কি মানবকল্যাণে কাজে লাগবে, নাকি এটি আরও বড় বিপদের কারণ হবে?

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org