ঢাকার সকালবেলা আজকাল আর কেবল যানজটের জন্য কুখ্যাত নয়, গুনগুন শব্দের অদৃশ্য আতঙ্কও এই শহরের এক অদ্ভুত অংশ হয়ে উঠেছে। মশার এই নিরব আক্রমণ শুধু রাতের ঘুম নষ্ট করে না, মানুষের শরীরেও এক নতুন দুর্ভোগের জন্ম দিয়েছে—চিকুনগুনিয়া। নামটা শুনলেই অনেকে ভয় পেয়ে যান, আবার কেউ কেউ হালকাভাবে নেন, ভাবেন স্রেফ আরেকটা ডেঙ্গুর মতো জ্বর। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাসজনিত রোগটি কেবল একটি মৌসুমি অসুখ নয়; এটি আমাদের নগর পরিকল্পনা, জনস্বাস্থ্য অবকাঠামো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের হুঁশিয়ারি বহন করছে।
চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের মূল বাহক এডিস মশা, যে একইসঙ্গে ডেঙ্গু এবং জিকার মতো ভাইরাসও ছড়ায়। ১৯৫২ সালে তানজানিয়ায় প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এই ভাইরাস আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে এর প্রথম বড় আকারের প্রাদুর্ভাব ঘটে ২০১৭ সালে। সে বছর রাজধানী ঢাকায় হাজার হাজার মানুষ উচ্চ জ্বর, তীব্র জয়েন্টের ব্যথা আর দুর্বলতায় কাতর হয়েছিলেন। অনেকেই মাসের পর মাস পর্যন্ত হাড়ের ব্যথা থেকে মুক্তি পাননি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সংক্রমণের হার এবং উপসর্গের তীব্রতা ডেঙ্গুর মতোই উদ্বেগজনক, যদিও মৃত্যুহার তুলনামূলক কম।
তবে এই পরিসংখ্যানের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বড় শিক্ষা। চিকুনগুনিয়ার দ্রুত বিস্তার প্রমাণ করেছে যে, আমাদের শহুরে জীবনযাপন ও অবকাঠামো মশাবাহিত রোগের জন্য কতটা অনুকূল হয়ে উঠেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপ্রতুল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জমে থাকা নোংরা পানি এডিস মশার জন্মের আদর্শ পরিবেশ তৈরি করছে। অল্প বৃষ্টিতেই শহরের গলিপথে জমে থাকা পানি, ছাদের টব বা পরিত্যক্ত বোতলে জমে থাকা পানি মশার প্রজননের জন্য যথেষ্ট। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মৌসুমের ওঠানামা, অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার পরিবর্তন এই পরিস্থিতিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলছে।
চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ সাধারণত হঠাৎ করে শুরু হয়—উচ্চ জ্বর, তীব্র গাঁটে গাঁটে ব্যথা, মাথা ব্যথা এবং কখনো কখনো চুলকানিযুক্ত র্যাশ। এ রোগের সবচেয়ে কষ্টকর দিক হলো সেই জয়েন্টের ব্যথা, যা অনেক সময় কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। যদিও মৃত্যুর ঝুঁকি কম, দীর্ঘস্থায়ী অস্বস্তি মানুষের কর্মক্ষমতা ও জীবনের মানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই অসুখের কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ বা প্রতিষেধক টিকা নেই; তাই প্রতিরোধই একমাত্র কার্যকর অস্ত্র।
প্রতিরোধ মানে শুধু ঘরের ভেতর মশারির ব্যবহার বা স্প্রে নয়। এটি একটি সম্মিলিত সামাজিক ও নীতিগত উদ্যোগের নাম। শহর পরিকল্পনায় জলাবদ্ধতা রোধ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা, নালা-নর্দমার সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা—এসব সরকারি উদ্যোগ ছাড়া ব্যক্তিগত সচেতনতা যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে বাসাবাড়ি ও অফিস এলাকায় জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার, ফুলের টবের নিচের প্লেটে পানি জমতে না দেওয়া, পানির ট্যাংক ঢেকে রাখা—এসব ছোট ছোট পদক্ষেপও বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
চিকুনগুনিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের আরও একটি দিক শিখিয়েছে—জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রস্তুতির গুরুত্ব। ২০১৭ সালের প্রাদুর্ভাবে দেখা গেছে, রোগ নির্ণয়, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং রোগীর দীর্ঘমেয়াদি সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অবকাঠামো কতটা দুর্বল। আজকের দিনে যখন বিশ্বব্যাপী মহামারির ঝুঁকি সবসময় লুকিয়ে আছে, তখন স্থানীয় স্তরে এমন ভাইরাসের বিস্তার আমাদের স্বাস্থ্যনীতিতে নতুন করে ভাবনার দাবি রাখে। শুধু চিকুনগুনিয়া নয়, ভবিষ্যতের যেকোনো মশাবাহিত বা ভাইরাসজনিত মহামারি মোকাবিলার জন্য আমাদের ল্যাবরেটরি সক্ষমতা, জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং জনসচেতনতা কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করা অপরিহার্য।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন ও নগরায়ণের প্রভাবে মশাবাহিত রোগ বৃদ্ধির প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, গড় তাপমাত্রা বাড়লে মশার জীবনচক্র আরও দ্রুত সম্পন্ন হবে, ফলে রোগ ছড়ানোর হার বাড়বে। বাংলাদেশের মতো উষ্ণ ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এটি ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই দীর্ঘমেয়াদি নীতি গ্রহণ—যেমন সবুজ নগরায়ণ, উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল—শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্য নয়, জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
সবশেষে,
চিকুনগুনিয়া আমাদের জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়: স্বাস্থ্য সংকট কোনো একক রোগের গল্প নয়, এটি আমাদের পরিবেশ, সামাজিক অবকাঠামো এবং জীবনধারার প্রতিচ্ছবি। আমরা যদি সময়মতো সতর্ক না হই, তাহলে আগামী দিনগুলোতে এই ধরনের ভাইরাসই শুধু নয়, আরও অজানা সংক্রমণ আমাদের নগর জীবনে বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই ব্যক্তিগত সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োজন একযোগে নীতিগত পরিবর্তন—যাতে ভবিষ্যতের ঢাকায় গুনগুন শব্দ কেবল একখানা গানেই সীমাবদ্ধ থাকে, কোনো অদৃশ্য ভাইরাসের বার্তা হয়ে নয়।
Leave a comment