সম্পাদকীয়

আমরা কি এক স্বর্ণযুগের বোকামিতে বাস করছি?

Share
Share

ড. মশিউর রহমান

ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (MIT)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ChatGPT-এর মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করলে মানুষের মস্তিষ্কের চিন্তা, মনোযোগ ও সৃজনশীলতা–সংক্রান্ত অংশগুলো কম সক্রিয় হয়ে পড়ে। এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন গবেষক নাতালিয়া কোসমাইনা, যিনি মস্তিষ্কের কার্যক্রম নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন।

কোসমাইনা ও তাঁর সহকর্মীরা এমন একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের তিন দলে ভাগ করেন—এক দল কোনো ডিজিটাল সহায়তা ছাড়াই প্রবন্ধ লেখে, আরেক দল ইন্টারনেট সার্চ ব্যবহার করে, এবং শেষ দল ChatGPT ব্যবহার করে। ফলাফল ছিল চমকে দেওয়ার মতো: যারা ChatGPT-এর সহায়তা নিয়েছিল, তাদের মস্তিষ্কে জ্ঞানীয় কার্যকলাপের মাত্রা সবচেয়ে কম ছিল।

আরও উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, কাজ শেষ করার পর তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তারা কী লিখেছে মনে আছে কি না—অধিকাংশই কিছুই মনে করতে পারেনি। কোসমাইনা বলেন, “তুমি মাত্রই লিখলে, অথচ কিছুই মনে নেই—এটাই সবচেয়ে ভয়ের বিষয়।”

মানুষের মস্তিষ্ক শেখার জন্য কিছুটা ‘ঘর্ষণ’ বা মানসিক পরিশ্রমের প্রয়োজন। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে সেই মস্তিষ্কের পরিশ্রমটি কমিয়ে দিচ্ছে। গণনা করার জন্য আমরা ফোনের ক্যালকুলেটর ব্যবহার করি, ঠিকানা খুঁজতে ম্যাপ অ্যাপ, তথ্য খুঁজতে সার্চ ইঞ্জিন। ফলে ধীরে ধীরে আমরা নিজেরা চিন্তা করা, মনে রাখা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া কমিয়ে ফেলছি। কোসমাইনা বলেন, “আমাদের মস্তিষ্ক শর্টকাট ভালোবাসে, কিন্তু শেখার জন্য শর্টকাট নয়, চ্যালেঞ্জ দরকার।”

অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (OECD) দেশগুলোর ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের পড়া, গণিত ও বিজ্ঞানের স্কোর ২০১২ সালের পর থেকে কমছে। বিশ শতকে বিশ্বজুড়ে IQ স্কোর বৃদ্ধি পেলেও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক উন্নত দেশে তা হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও ডিজিটাল ডিভাইসের অতিনির্ভরতা আমাদের মস্তিষ্ককে ক্রমে অলস করে তুলছে।

টেক বিশেষজ্ঞ লিন্ডা স্টোন একে বলেছেন “Continuous Partial Attention”—অর্থাৎ একসঙ্গে অনেক কিছু করার চেষ্টা, কিন্তু কোনোটাতেই সম্পূর্ণ মনোযোগ না দেয়া। ইমেইল, মেসেজ, ভিডিও—সব একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে মস্তিষ্কের সতর্কতা বা “fight or flight” সিস্টেম সবসময় সক্রিয় থাকে, যা মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দেয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইমেইল পড়ার সময় প্রায় ৮০% মানুষ অজান্তেই শ্বাস আটকে রাখে—একটি অবস্থাকে বলা হয় “screen apnea”।

ইন্টারনেট যুগে আমরা তথ্য সংরক্ষণ ও মনে রাখার দায় প্রযুক্তিকে দিয়েছিলাম। কিন্তু AI যুগে আমরা চিন্তার কাজটিও প্রযুক্তির হাতে তুলে দিচ্ছি। আজ ChatGPT আমাদের হয়ে রিপোর্ট লিখছে, ইমেইল বানাচ্ছে, এমনকি সিদ্ধান্তও নিচ্ছে। এই প্রবণতা বাড়লে মানুষ সমস্যাকে বিশ্লেষণ না করে সরাসরি তৈরি সমাধান গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।

সুইজারল্যান্ডের মাইকেল গার্লিখ বলেন, “AI তোমাকে মোমবাতিকে নিখুঁত করতে সাহায্য করবে—এটি আরও উজ্জ্বল, টেকসই ও সুন্দর হবে। কিন্তু এটি কখনো লাইটবাল্ব বানাতে পারবে না।” লাইটবাল্ব বানাতে লাগে সৃজনশীল, অগোছালো ও সমালোচনামূলক চিন্তা করা মানুষ।

যুক্তরাজ্যের এক জরিপে দেখা গেছে, ৯২% বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী AI ব্যবহার করছে, এবং প্রায় ২০% ছাত্রছাত্রী পুরো বা আংশিক অ্যাসাইনমেন্ট ChatGPT দিয়ে লিখাচ্ছে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে—ছাত্ররা কি আসলেই শিখছে, নাকি কেবল যান্ত্রিকভাবে লিখিত কাজ তৈরি করছে? যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষক ম্যাট মাইলস বলেন, “যদি দেখেন কোনো ছাত্র ফোনে ব্যস্ত, ধরে নিতে পারেন তার কাজের উৎপাদনশীলতা শূন্য।”

সক্রেটিস একসময় লিখিত ভাষা নিয়েও একই রকম ভয় প্রকাশ করেছিলেন—ভাবতেন মানুষ লেখার ওপর নির্ভর করলে স্মৃতিশক্তি নষ্ট হবে। কিন্তু বাস্তবে লেখাই মানুষের জ্ঞানবিস্তার ঘটিয়েছিল। তবে আজকের AI যুগে উদ্বেগটা ভিন্ন—এখন শুধু তথ্য নয়, চিন্তাশক্তিও যন্ত্রের হাতে চলে যাচ্ছে।

প্রযুক্তি মানুষকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে, যদি আমরা সেটিকে সঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করি—প্রতিস্থাপন হিসেবে নয়। কারণ বুদ্ধিমান মেশিন তৈরি করা যতটা সহজ, বুদ্ধিমান মানুষ ধরে রাখা তার চেয়ে অনেক কঠিন।আমরা কি এক স্বর্ণযুগের বোকামিতে বাস করছি?

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org