বিজ্ঞান বিষয়ক খবরমহাকাশ

ভিনগ্রহের সূর্যজগতের জন্ম প্রত্যক্ষ করলেন জ্যোতির্বিদরা: আমাদের সৌরজগতের অতীত বোঝার এক নতুন জানালা খুলে গেল

Share
Share

নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
১৪০০ আলোকবর্ষ দূরের এক তরুণ নক্ষত্রকে ঘিরে গ্রহ গঠনের প্রাথমিক ধাপ সরাসরি দেখতে সক্ষম হয়েছেন জ্যোতির্বিদরা। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো তারকা ও তার চারপাশে জন্ম নিতে থাকা সৌরজগতের এমন স্পষ্ট ছবি আমরা পেলাম—যা আমাদের নিজের সৌরজগতের ইতিহাস সম্পর্কে বহু অজানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।

এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটি এসেছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) ও চিলির আতাকামা বড় রেডিও টেলিস্কোপ (ALMA)-এর যৌথ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। তারা যে তরুণ তারকাটিকে কেন্দ্র করে গবেষণা করেছেন, তার নাম HOPS-315, এটি অবস্থান করছে ওরিয়ন নক্ষত্রপুঞ্জে, একটি বিশাল নক্ষত্র জন্মদানের অঞ্চলে।

তরুণ তারকা, ভবিষ্যতের সূর্য

HOPS-315 নামের এই তারকাটি বর্তমানে ০.৬ সৌরভরের সমান ভর বিশিষ্ট। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এটি ভবিষ্যতে আমাদের সূর্যের মতোই একটি নক্ষত্রে পরিণত হবে। আর তাই, এর আশপাশে যা ঘটছে, তা সরাসরি আমাদের সৌরজগতের জন্মকালের প্রতিচ্ছবি হিসেবে কাজ করতে পারে।

এই তরুণ নক্ষত্রটি এখনো ঘন ধূলিকণায় আবৃত, যাকে বলা হয় protostellar envelope—যেখানে তারকাটি নিজেকে তৈরি করার জন্য গ্যাস ও ধূলিকণা টেনে নিচ্ছে। সাধারণভাবে, এই ধূলিকণার আবরণ এতটাই ঘন যে ভেতরের কিছু দেখা যায় না। কিন্তু JWST-এর ইনফ্রারেড ও ALMA-এর রেডিও তরঙ্গ মিলিয়ে এমনভাবে পর্যবেক্ষণ চালানো হয়েছে, যার মাধ্যমে এই ঘন আবরণ ভেদ করে দেখা সম্ভব হয়েছে।

প্রথম ধাপ: প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কে খনিজ গঠনের আভাস

জ্যোতির্বিদরা দেখতে পেয়েছেন একটি ঘূর্ণায়মান গ্যাস ও ধূলিকণায় পূর্ণ ডিস্ক, যাকে বলা হয় প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক—গ্রহ জন্মের গর্ভ। এই ডিস্কের মধ্যেই ছোট ছোট খনিজ কণাগুলো একত্রিত হয়ে প্রথমে প্ল্যানেটেসিমাল গঠন করে, যেগুলো পরে ধাপে ধাপে গ্রহে রূপ নেয়।

তবে এরও আগে প্রয়োজন হয় গ্যাস ঠান্ডা হয়ে প্রথম খনিজ কণাগুলোর ঘনীভবন, অর্থাৎ কঠিন হওয়ার। এই প্রক্রিয়ার প্রমাণ এতদিন খুবই দুর্লভ ছিল, কারণ ধূলিকণার মোটা আস্তরণ সবকিছু আড়াল করে রাখে। আমাদের সৌরজগতের ক্ষেত্রেও ৪.৫ বিলিয়ন বছরের ব্যবধানের কারণে এই বিষয়গুলো প্রায় অজানাই ছিল।

সৌরজগতের “সময় শূন্য”: CAI এবং ইতিহাসের গোঁড়ার কথা

আমাদের সৌরজগতের জন্মমুহূর্ত চিহ্নিত করতে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন একটি বিশেষ ধরনের খনিজ, যাকে বলে Calcium-Aluminum-rich Inclusions বা CAI। এটি পাওয়া যায় প্রাচীন উল্কাপিণ্ডে, এবং একে ধরা হয় সৌরজগতের প্রথম কঠিন বস্তু। বিজ্ঞানীরা একে সৌর ইতিহাসের “টাইম জিরো” বা শুরুর মুহূর্ত হিসেবে গণ্য করেন।

বিজ্ঞানীদের অনুমান, এই CAI গুলো তৈরি হয়েছিল গরম গ্যাসের ডিস্ক ঠান্ডা হয়ে খনিজ বর্ষণের মাধ্যমে। কিন্তু এগুলো কিভাবে, কোথায় এবং কখন গঠিত হয়েছিল, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ধোঁয়াশা ছিল।

HOPS-315: এক অনন্য “ইউনিকর্ন” তারকা

লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ মেলিসা ম্যাকক্লুরের নেতৃত্বে গবেষক দল HOPS-315-এর অভ্যন্তরে গ্যাসের রাসায়নিক চিহ্ন শনাক্ত করেন, যেমন: silicon monoxide এবং crystalline silicates—যা স্পষ্টভাবে খনিজ গঠনের প্রমাণ দেয়। পরবর্তী পর্যবেক্ষণে ALMA দেখায় যে এই খনিজ কণাগুলো কোনো বহিঃপ্রবাহ (jet)-এর অংশ নয়, বরং ডিস্কের এমন একটি অঞ্চলে রয়েছে যা সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্বের দ্বিগুণ বিস্তৃত।

এই অঞ্চলটি আমাদের সৌরজগতের main asteroid belt–এর সমতুল্য। সম্ভবত ডিস্কের ঘূর্ণন বা নবীন তারকার তীব্র সৌর বাতাস এসব খনিজ কণাকে সেখানে জড়ো হতে সাহায্য করছে।

CAI পাওয়া না গেলেও, সম্ভাবনার ইঙ্গিত স্পষ্ট

যদিও সরাসরি CAI শনাক্ত হয়নি, তথাপি খনিজ কণার অনুপাত ও অবস্থান বলছে, এখানেই CAI গঠনের অনুকূল পরিবেশ ছিল। নিউইয়র্কের ফ্ল্যাটআইরন ইনস্টিটিউটের থিওরিস্ট ফিল আর্মিটেজ বলছেন, HOPS-315-এ CAI গঠনের মতো পরিবেশ তারকা জন্মের প্রথম কয়েক লাখ বছরের মধ্যেই গঠিত হয়।

অ্যারিজোনার অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট ইলারিয়া পাস্কুচ্চি বলেন, “CAI শনাক্ত করা গেলে আমরা আমাদের সৌরজগতের ইতিহাসের সঙ্গে অন্য গ্রহ গঠনের প্রক্রিয়ার তুলনা করতে পারব।” যদিও এ গবেষণায় সরাসরি CAI শনাক্ত হয়নি, তবে পরিবেশ যে অনুরূপ ছিল, তা উল্লেখযোগ্য বিষয়।

প্রযুক্তির জয়গান: JWST ও ALMA-র অসাধারণ ক্ষমতা

NASA-এর স্পিটজার টেলিস্কোপ অনেক আগেই HOPS-315-কে সম্ভাবনাময় লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, কিন্তু যথেষ্ট বিশ্লেষণ সম্ভব হয়নি। JWST-এর অতুলনীয় স্পেকট্রাল রেজোলিউশন এবং সংবেদনশীলতা এই বিশ্লেষণ সম্ভব করেছে।

ম্যাকক্লুরের দল ২০২৩ সালের মার্চ ও সেপ্টেম্বর মাসে JWST দিয়ে HOPS-315 পর্যবেক্ষণ করেন এবং নভেম্বর মাসে ALMA দিয়ে তা নিশ্চিত করেন। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সিলিকন—যা গ্রহ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—তারকার বহিঃপ্রবাহে অনুপস্থিত। এতে সন্দেহ জেগেছে, সম্ভবত সিলিকন ডিস্কের গভীরে ধূলি বা বড় পাথুরে বস্তুতে রূপ নিয়েছে—যেমনটি আমাদের সৌরজগতে হয়েছিল।

ভবিষ্যতের পথ: আরও গভীর অনুসন্ধানের সম্ভাবনা

এই আবিষ্কার HOPS-315-কে বিজ্ঞানীদের জন্য এক “জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক সময় মেশিন”-এ রূপান্তর করেছে। এটি আমাদের দেখাচ্ছে গ্রহ গঠনের একেবারে প্রাথমিক ধাপ, যা এতদিন ধোঁয়াশায় ঢাকা ছিল। আরও তরুণ তারকা—যেমন HOPS-68—নিয়ে নতুন করে গবেষণা করারও আহ্বান জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

এই পর্যবেক্ষণ আমাদের শেখাচ্ছে, সৌরজগত গঠনের ইতিহাস শুধু পুরনো উল্কাপিণ্ডে লেখা নেই, বরং তা ছড়িয়ে রয়েছে আকাশগঙ্গার কোণে কোণে নতুন তারকা ও গ্রহের জন্মে।

উপসংহার: আকাশে চোখ রাখলেই অতীতকে দেখা যায়

HOPS-315-এর মতো তরুণ নক্ষত্র আমাদের শেখাচ্ছে যে, আজকের আধুনিক প্রযুক্তি ও দূরবীক্ষণ আমাদের মহাবিশ্বের গভীরে সময় ভেদ করে অতীতকে বোঝার সুযোগ দিচ্ছে। ঠিক যেমন কোনো পুরনো ছবির মাধ্যমে আমরা আমাদের শৈশবকে মনে করি, তেমনি এই তারকাটি আমাদের সৌরজগতের জন্মঘণ্টার ছবি আঁকতে সাহায্য করছে। ভবিষ্যতের গবেষণা হয়তো একদিন আমাদের বলে দেবে, গ্রহ গঠনের রহস্য ঠিক কোথা থেকে শুরু হয়েছিল।

আর এই জ্যোতির্বিদ্যার অভিযান—তা শুধু মহাকাশের নয়, আমাদের নিজস্ব পরিচয়ের খোঁজও বটে।


📩 বিজ্ঞানের আরও আকর্ষণীয় খবর পেতে biggani.org এর সাথে থাকুন।

✍️ লেখক: নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ
📧 যোগাযোগ: [email protected]

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org