প্রায় দুই দশক আগে একদল স্বপ্নবাজ বাংলাদেশি গবেষক একটি অনন্য উদ্যোগের সূচনা করেছিলেন। ২০০৬ সালের ৬ই মার্চ যাত্রা শুরু করা সেই প্ল্যাটফর্মের নাম বিজ্ঞানী.অর্গ – যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষায় গবেষণা-সংক্রান্ত তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকার শেয়ার করে নতুন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করা। বিজ্ঞানকে মাতৃভাষায় এনে সাধারণের কাছে পৌঁছানোই তাদের লক্ষ্য, যাতে জ্ঞানচর্চা কেবল পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে জীবনঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। উদ্যোক্তাদের বিশ্বাস ছিল, ডিজিটাল বিভাজন দূর করতে নিজ ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উপর सामग्री তৈরি ও ছড়িয়ে দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বৈজ্ঞানিক চিন্তার ভিত্তি মজবুত করা সম্ভব – বিজ্ঞানী.অর্গের জন্ম এই প্রত্যয় থেকেই।
শুরুটা ছোট পরিসরে হলেও ভাবনাটা ছিল মহৎ। বাংলাদেশে তখন বিজ্ঞান বিষয়ে সহজবোধ্য বাংলায় লেখা খুব কমই পাওয়া যেত। শিক্ষার্থী ও নবীন গবেষকদের কাছে বিজ্ঞানীদের জীবনের গল্পগুলো দূরের আলোর মতো ছিল, যা তারা কেবল ইংরেজি ম্যাগাজিন বা বিদেশি উৎস থেকে টুকরো টুকরো জানতেন। বিজ্ঞানী.অর্গ সেই দূরত্বটা ঘোচানোর আবেগ নিয়ে পথ চলতে থাকে। দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা মেধাবী বিজ্ঞানী ও গবেষকদের খোঁজ করে তাদের অভিজ্ঞতার কথা মাতৃভাষায় তুলে ধরার উদ্যোগ নিতে থাকে প্ল্যাটফর্মটি। দেশের সীমান্তের বাইরে পাড়ি জমানো গবেষকদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যাতে দেশের তরুণদের কাছে পৌঁছায়, সেই সেতুবন্ধন তৈরি করতে চেয়েছিল বিজ্ঞানী.অর্গ। কারণ বিজ্ঞান শুধু পরীক্ষাগার আর পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো বিষয় নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবনকাহিনি, অভিজ্ঞতা আর দর্শনও – আর এই গল্পগুলো তুলে ধরতে পারলেই বিজ্ঞান হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক সম্পদ, আমাদের সামষ্টিক পরিচয়ের অংশ।
দুই শত সাক্ষাৎকারের মাইলফলক
বিজ্ঞানী.অর্গ সম্প্রতি দুই শততম বিজ্ঞানী সাক্ষাৎকার প্রকাশের মাইলফলকে পৌঁছেছে, যা শুধু সংখ্যায় নয় বরং এর গভীরতা ও ব্যাপকতায় আমাদের ভাবায়। প্রতিটি সাক্ষাৎকার একটি জীবনগাথা, আর দুই শত সাক্ষাৎকার মিলিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রার এক সম্মিলিত ইতিহাস। এখানে আছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা গবেষকদের কথা – কেউ ন্যানোটেকনোলজির গবেষণায় সাফল্য দেখাচ্ছেন, কেউবা কৃষিবিজ্ঞানে নতুন সমাধান খুঁজছেন; কেউ আছেন মহাকাশ গবেষণায়, তো কেউ মেডিসিন বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় অবদান রাখছেন। দেশের মাটিতে কাজ করা বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশি গবেষকদের গল্পগুলো একই প্ল্যাটফর্মে স্থান পেয়েছে। এই বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার কেবল আমাদের Collective identity বা সমষ্টিগত পরিচয়ের একটি প্রতিচ্ছবি নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি মূল্যবান ঐতিহাসিক নথিও বটে। গত পনেরো-বিশ বছরে বিজ্ঞানী.অর্গের আর্কাইভে জমা পড়া দুই শত গল্পে লিপিবদ্ধ হয়েছে কীভাবে একটি জাতির কৌতূহল ও সৃজনশীলতা বিকশিত হয়েছে বিশ্বমঞ্চে। বিজ্ঞানীর এসব কথা পড়তে গিয়ে বাংলাদেশের তরুণরা দেখছে যে, স্বপ্ন দেখার সাহস ও অধ্যবসায় থাকলে আমরাও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় অবদান রাখতে পারি। দুই শত সাক্ষাৎকার মানে দুই শত আলোকশিখা – প্রতিটি আলাদা আলো, কিন্তু মিলিয়ে যা উদ্ভাসিত করছে আমাদের सामूहিক বিজ্ঞানমনস্ক আত্মা।
এই দীর্ঘ পথচলায় সবচেয়ে যে জিনিসটি হৃদয়ছোঁয়া, তা হল প্রতিটি সাক্ষাৎকারের নেপথ্যে থাকা আন্তরিকতা ও কমিউনিটির আবেগ। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিজ্ঞানীরা সময় বের করে নিজেদের গল্প বলেছেন, আর বিজ্ঞানী.অর্গের স্বেচ্ছাসেবীরা সেই গল্পগুলোকে বাংলা ভাষায় লিপিবদ্ধ করে সবার জন্য উন্মুক্ত করেছেন। কখনো রাত জেগে ভিন্ন টাইম-জোনে স্কাইপে বা জুম কলে প্রশ্নোত্তর, কখনো ইমেইলে দীর্ঘ আলাপ – এভাবেই জমা হয়েছে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। এই কমিউনিটি-নির্ভর প্রচেষ্টার ফলেই বিজ্ঞানী.অর্গ দুই শত সাক্ষাৎকারের মাইলফলক ছুঁতে পেরেছে। এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় রয়েছে স্বপ্নের স্পন্দন, গুরুজনদের জ্ঞান, আর নবীনদের জন্য অফুরন্ত প্রেরণা। অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের এসব সাক্ষাৎকার তরুণদের কৌতূহল জাগিয়ে তাদের সামনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, যদিও অনুপ্রেরণা কখনো একা যথেষ্ট নয়—সঙ্গে প্রয়োজন কার্যকর দিকনির্দেশনারও। তাই প্রতিটি সাক্ষাৎকারের মাঝে শুধু সাফল্যের গল্প নয়, বিজ্ঞানীদের ব্যর্থতা থেকে শেখা, কঠিন সময়ে হার না মানার মানসিকতা, আর পথচলার পাঠও উঠে আসে। এসব গল্প বলে দেয় যে গবেষণার জগতে সাফল্য হঠাৎ করে আসে না; এর পেছনে থাকে বছরের পর বছর অধ্যবসায় আর অন্তহীন কৌতূহল।
বিজ্ঞানী.অর্গের সাক্ষাৎকারগুলোর এক একটি উক্তি তরুণ পাঠকদের মনে গভীর ছাপ ফেলতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন নবীন গবেষক যখন অধ্যাপক আহমেদুল্লাহ আজিজের মতো বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার পড়েন, তখন তিনি জানতে পারেন অধ্যাপক আজিজের মতো ব্যক্তিত্ব তরুণদের উদ্দেশে কী বার্তা দেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন: “বিজ্ঞান শুধু বইয়ের বিষয় নয়—এটি প্রশ্ন করার, চিন্তা করার এবং নতুন কিছু আবিষ্কার করার এক দারুণ সুযোগ।” এই কথাটি নতুন প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয় যে বিজ্ঞান মানে মুখস্থ করা তথ্য নয়, বরং অজানাকে জানার দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা। একই সঙ্গে অধ্যাপক আজিজ তরুণদের আরেকটি মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন – “মনে রেখো: কলম, কাগজ আর মস্তিষ্ক—এই তিনটি মিলেই উদ্ভাবনের জন্য যথেষ্ট।” অর্থাৎ, বিপুল সম্পদের অভাব থাকলেও সৃজনশীল চিন্তা আর মেধাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এমন অনুপ্রেরণামূলক বাক্য শুধু বিজ্ঞান নয়, যেকোনো ক্ষেত্রেই তরুণদের আত্মবিশ্বাস জোগাতে সক্ষম। তাঁদের মনে হয়, “আমারও তো কলম, কাগজ আর মস্তিষ্ক আছে – আমিও পারি!” বিজ্ঞানীর সঙ্গে পাঠকের এই আত্মিক সংযোগই বিজ্ঞানী.অর্গের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
তবে বিজ্ঞানী.অর্গ জানে যে শুধু স্বপ্ন দেখানোর মাঝে দায়বদ্ধতা থেমে থাকতে পারে না; স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা এবং অধ্যবসায়ের শিক্ষা। এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছিল: “একজন প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার হয়তো তরুণদের চোখে স্বপ্ন জাগাবে, কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে যে মানসিক দৃঢ়তা ও অধ্যবসায় প্রয়োজন, সেই বার্তাও পৌঁছে দিতে হবে… সাফল্যের শিখরে ওঠার জন্য কোনো লিফট নেই; সিঁড়ি বেয়েই উঠতে হয়।” এই উপলব্ধি থেকে বিজ্ঞানী.অর্গ সাম্প্রতিক সময়ে শুধু সাক্ষাৎকারই নয়, গবেষণা কিভাবে শুরু করবেন, কীভাবে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে, গবেষণার নৈতিকতা ইত্যাদি নানা বিষয়েও বাংলায় গাইডসহ বহু লেখা প্রকাশ করছে। কারণ অনুপ্রেরণা যদি উড়ানের জ্বালানি হয়, দিকনির্দেশনা হলো সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছানোর মানচিত্র। বাংলা ভাষায় উন্নতমানের বৈজ্ঞানিক রিসোর্সের অভাব পূরণে বিজ্ঞানী.অর্গ নিরলস কাজ করে চলেছে। গবেষণার নানাবিধ কন্টেন্ট একটি প্লাটফর্মে এনে নবীনদের সহজবোধ্য তথ্য তুলে দিচ্ছে। এর মধ্যে ‘গবেষণায় হাতেখড়ি’ নতুন বিভাগ যুক্ত হয়েছে, যেখানে একজন ছাত্র নিজের প্রশ্নের উত্তর ও প্রয়োজনীয় রসদ খুঁজে পেতে পারে মাতৃভাষায়। এসব প্রয়াস আমাদের বিজ্ঞানচর্চার সংস্কৃতিকে আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে সাহায্য করছে।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানযোগাযোগের গুরুত্ব এটাই – এটি জ্ঞানকে গণের মাঝে পৌঁছে দিয়ে সত্যিকারের জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের পথ প্রশস্ত করে। বিদেশি ভাষার দেওয়াল টপকাতে না পারায় অসংখ্য মেধাবী ছাত্রবেলা থেকেই বিজ্ঞানকে দুর্বোধ্য বা দূরের জিনিস বলে ভেবে নেয়। কিন্তু যখন কোনো কিশোর নিজের ভাষায় কোনো প্রবাসী বাঙালি বিজ্ঞানীর জীবনকাহিনি পড়তে পারে, সে দেখে তার মতো সাধারণ পরিবেশ থেকেই কেউ বিজ্ঞানজগতে অসাধারণ সফলতা পেয়েছেন। সেই মুহূর্তে বিজ্ঞান তার কাছে আপন হয়ে যায়, স্বপ্নগুলো বাস্তবের মাটি পেতে শুরু করে। বিজ্ঞানী.অর্গ শুরু থেকে এই কথাটি মনে রেখেই কাজ করছে – একটি জাতি শুধু অন্যের প্রযুক্তি ভোগ করে মহান হতে পারে না, জ্ঞান সৃষ্টির ক্ষমতা অর্জন করলেই সে স্থায়ী মর্যাদা পায়। আর মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশ না থাকলে সেই জ্ঞানসৃজনের প্রবাহ সীমিত গণ্ডিতে আটকে যাবে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করা মানে হলো তরুণদের মনে বৈজ্ঞানিক চিন্তার বীজ বোনা, তাদের কল্পনাশক্তিকে তাদের নিজের সংস্কৃতির প্রসঙ্গে জাগিয়ে তোলা। বিজ্ঞানী.অর্গের দুই শত সাক্ষাৎকার সেই বীজ বপনের কাজটাই করে চলেছে নিবেদন ও ভালোবাসা নিয়ে।
এই অভূতপূর্ব মাইলফলক উদ্যাপনের পাশাপাশি, আমাদের দৃষ্টি ভবিষ্যতের পথের দিকেও। বিজ্ঞানী.অর্গের গল্প আসলে সবে শুরু – দুই শত সাক্ষাৎকার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা মাত্র। সামনের দিনগুলোতে আরও বহু বিজ্ঞানীর কথা, নতুন নতুন গবেষণার উপাখ্যান এ প্ল্যাটফর্মে সংকলিত হবে। হয়তো কয়েকবছর পর তিন বা পাঁচ শততম সাক্ষাৎকারের কথাও আমরা উদ্যাপন করবো। কিন্তু সংখ্যা যতই বাড়ুক, প্রতিটি আলাপচারিতার মূল লক্ষ্য একই থাকবে: জ্ঞান-বিজ্ঞানকে মানুষের গল্পের মোড়কে তুলে ধরা, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম নিজেদের পথ দেখতে পায়। এই কমিউনিটি-চালিত উদ্যোগটি আশাবাদী যে ভবিষ্যতে এই প্ল্যাটফর্ম থেকেই আরও অনেক নবীন বিজ্ঞান লেখক, স্বেচ্ছাসেবী ও গবেষক এগিয়ে আসবেন, যারা বাংলাদেশের বিজ্ঞানচর্চার আলো পৌঁছে দেবেন বাংলার ঘরে ঘরে। হয়তো এদের মধ্য থেকেই উঠে আসবে আগামীর জামাল নজরুল ইসলাম বা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো মনীষী – যারা বৈশ্বিক স্তরে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করবেন নিজের মাটিতে থেকেই।
দুই শত সাক্ষাৎকার পূর্তির এই মুহূর্তে আমরা আবারও মনে করি, বিজ্ঞানী.অর্গ কেবল একটি ওয়েবসাইট নয়, এটি একটি আন্দোলন। জ্ঞানের আলোকে বাংলাদেশকে আত্মনির্ভরশীল ও সমৃদ্ধ করে তোলার স্বপ্নে একদল বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের নিরন্তর প্রচেষ্টা এটি। পাঠক, লেখক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক – সকলের সম্মিলিত চেষ্টাতেই এগিয়েছে বিজ্ঞানী.অর্গের যাত্রা। আর সেই সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই আমরা একটি জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব—যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হবে গবেষণার এই প্রশস্ত রাজপথে। আজকের এই মাইলফলক তাই কেবল বিজ্ঞানী.অর্গের সাফল্য নয়, এটি বিজ্ঞান-মনস্ক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের আরও এক ধাপ অগ্রগতি। আমাদের কল্পনার আকাশে জ্বলতে থাকা অগণিত তারকার মাঝে বিজ্ঞানী.অর্গের জ্বালানো দুই শত আলোকশিখা এক বিশাল নক্ষত্রমালার মতো আলো ছড়াচ্ছে – দেখিয়ে দিচ্ছে, কমিউনিটির শক্তি দিয়ে জ্ঞানচর্চার ইতিহাস কেমন করে রচনা করা যায়।

Leave a comment