কলামচিকিৎসা বিদ্যা

কলাম: আমাদের চিন্তার সীমার বাইরে এক বিশাল জগৎ

Share
Share

মানুষ ভাবতে ভালোবাসে। চিন্তাই মানুষের সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু কখনও কখনও মানুষ এমন এক প্রবল ভ্রমে পড়ে যায় যে সে-ই নাকি সব ভাবতে পারে, সব পরিকল্পনা করতে পারে, আর চিন্তা মানেই বাস্তবতার সীমা। অথচ সত্যি হলো, চিন্তা ও পরিকল্পনার গণ্ডির বাইরে এক বিশাল জগৎ আছে, যেখানে জন্ম নেয় সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা, সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার, আর সবচেয়ে গভীর সত্য। সেই জগৎ হয়তো আমাদের অবচেতনের, হয়তো প্রকৃতির, হয়তো সময়ের স্তরগুলোর মধ্যে কোথাও লুকিয়ে আছে, যেখানে মানুষের সচেতন চিন্তা পৌঁছায় না, কিন্তু জীবন সেখানে প্রতিনিয়ত প্রবাহিত হয়।

আমরা প্রায়ই ভাবি, যা কিছু আবিষ্কার হয়েছে, সবই কোনো সচেতন পরিকল্পনার ফল। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মানবজাতির অনেক বড় বড় আবিষ্কার বা সৃজনশীল প্রেরণা এসেছে হঠাৎ করেই যেন কেউ ভেতর থেকে ফিসফিস করে দিয়েছে। নিউটন আপেলের পতনে যে মহাকর্ষের সূত্র পেলেন, সেটি তিনি পরিকল্পনা করেননি। আর্কিমিডিস গোসলের টবে বসে ‘ইউরেকা!’ বলে উঠে পড়েছিলেন সেই মুহূর্তটি তাঁর কল্পনারও বাইরে ছিল। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি রহস্য লুকিয়ে আছে, চিন্তা সবসময় মনের ভেতরের শব্দ নয়; অনেক সময় চিন্তার বাইরের কোনো জগৎ আমাদের চিন্তাকে অনুপ্রাণিত করে।

মস্তিষ্কবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে, আমাদের কনশাস মাইন্ড বা সচেতন মন হলো বরফখণ্ডের উপরের ছোট্ট অংশ, আর অবচেতন মন হলো বিশাল সাগরের নিচে ডুবে থাকা অংশ। মানুষ যতই ভাবুক, তার চিন্তার বেশিরভাগই তৈরি হয় এমন জায়গা থেকে, যেখানে সে সরাসরি প্রবেশ করতে পারে না। অনেক সময় আমরা যেসব সিদ্ধান্ত নেই, সেগুলোর কারণও আমরা পুরোপুরি জানি না। পরে গিয়ে তাকে যুক্তি দিয়ে সাজাই, যেন মনে হয় সবটাই পরিকল্পিত। অথচ মূল সিদ্ধান্তটি এসেছে আমাদের অবচেতন বা এমন কোনো ‘আন্তর্জগৎ’ থেকে, যা আমাদের চিন্তার সীমা ছাড়িয়ে কাজ করে।

এই কারণেই, “আমাদের চিন্তা বা পরিকল্পনার বাইরেও এক বিশাল জগৎ আছে” -এই বাক্যটি কেবল কবিতা নয়, এটি নিউরোসায়েন্স ও কগনিটিভ সাইকোলজির সত্য। মানবমস্তিষ্ক প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬০,০০০ চিন্তা উৎপন্ন করে, যার বেশিরভাগই পুনরাবৃত্ত বা অবচেতনভাবে গঠিত। এর মানে দাঁড়ায় আমাদের অনেক সিদ্ধান্ত, আবেগ, এমনকি সৃষ্টিশীল ধারণাও আসে এমন জায়গা থেকে, যেখানে আমাদের সচেতন পরিকল্পনা যায় না।

এই রহস্যময় জায়গাটিই হলো “অজানা জগৎ” যেখানে প্রকৃতি, সময়, অবচেতন এবং আকস্মিক ঘটনার মেলবন্ধন ঘটে। জীবনের অনেক বড় শিক্ষা আমরা এখান থেকেই পাই, যদিও বুঝতে পারি না। আপনি হয়তো ভাবছেন কিছুই ঠিক মতো হচ্ছে না, কিন্তু ঠিক তখনই কোনো অপ্রত্যাশিত মানুষ, কোনো ঘটনা বা একটা বই এসে আপনার জীবন ঘুরিয়ে দেয়। আপনি সেটা পরিকল্পনা করেননি, কিন্তু সেই অনিয়ন্ত্রিত ঘটনার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে আপনার অগ্রযাত্রার বীজ।

মানুষ যতই বুদ্ধিমান হোক, তার চিন্তার পরিসর সীমিত। আমরা সময়কে সরলরেখায় দেখি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। কিন্তু বাস্তবতার পরিধি অনেক বড়। অনেক বিজ্ঞানীই এখন মনে করেন, বাস্তবতা হয়তো একাধিক স্তরে বিদ্যমান, যেখানে সময় ও ঘটনার প্রবাহ আমাদের ধারণার মতো নয়। আমাদের মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা সেই বৃহৎ বাস্তবের সামান্য অংশই উপলব্ধি করতে পারি। তাই হয়তো অনেক ঘটনা “অপ্রত্যাশিত” মনে হয়, অথচ সেই ঘটনাগুলো একটি বৃহত্তর গাণিতিক বা জৈবিক বিন্যাসের অংশ, যা আমাদের বোধগম্যের বাইরে।

এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে আশ্চর্যজনক, মানুষ ভাবে সে বলবে, পরিকল্পনা করবে, তারপর কাজ করবে; কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় মানুষ কাজ করে ফেলে, তারপর সেটাকে যুক্তির মাধ্যমে “পরিকল্পিত” হিসেবে ব্যাখ্যা করে। কেউ বক্তৃতা দিতে উঠে যায়, অথচ মাথায় কোনো চিন্তা স্পষ্ট নেই। কথা বলতে বলতে, সেই অচিন্তিত শব্দগুলো গড়ে তোলে এমন একটি বার্তা, যা নিজেই শ্রোতাকে ও বক্তাকে অবাক করে দেয়। যেন সেই মুহূর্তে তার ভেতর দিয়ে কথা বলছে অন্য এক শক্তি, যেটি চিন্তা নয়, বরং অনুভবের, অভিজ্ঞতার ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির জগৎ থেকে উঠে এসেছে।

সেই জগৎকে কেউ বলে “intuition”, কেউ বলে “inner voice”, কেউ বলে “divine inspiration”—কিন্তু নাম যাই হোক না কেন, সেটা মানুষের একার নয়। সেখানে প্রবেশ করতে গেলে মানুষকে নিজের অহংকার ও পরিকল্পনার দেয়াল ভাঙতে হয়। কারণ, যতক্ষণ মানুষ মনে করে, “আমি-ই ভাবছি, আমি-ই জানি” ততক্ষণ সে এই বৃহত্তর জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। কিন্তু যখন সে নিজেকে উন্মুক্ত করে দেয়, তখন অজানার সঙ্গে সংযোগ তৈরি হয়। তখন চিন্তার বাইরের জগৎ তার মস্তিষ্কের ভেতরে স্রোতের মতো প্রবেশ করে, আর মানুষ হঠাৎ এমন কিছু বলতে বা করতে পারে, যা সে নিজেও বোঝে না কীভাবে সম্ভব হলো।

আমাদের সমাজে এই ব্যাপারটি প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। আমরা শেখানো হই প্রত্যেক কথার আগে চিন্তা করো, পরিকল্পনা করো, যুক্তি দাও। যুক্তি অবশ্যই দরকার, কিন্তু জীবনের সবকিছু যুক্তির ছাঁচে ফেলা যায় না। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সিদ্ধান্তগুলো আসে অনুভব থেকে যেখানে মন, মস্তিষ্ক, সময়, আর বাস্তবতার সীমানা একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়। একটা শিশু হাঁটতে শেখে না কোনো চিন্তা করে; সে পড়ে, আবার উঠে, আবার চেষ্টা করে। সেটি চিন্তার জগৎ নয়, সেটি জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ।

ঠিক তেমনই, একজন শিল্পী কোনো ছবি আঁকার আগে অনেক পরিকল্পনা করতে পারেন, কিন্তু আসল শিল্পের মুহূর্ত আসে তখনই, যখন তুলি নিজে চলতে শুরু করে। একজন বিজ্ঞানী হয়তো বহু বছর গবেষণা করেন, কিন্তু যেদিন হঠাৎ করেই ফলাফল পেয়ে যান, সেদিন সেটা কেবল তাঁর “চিন্তার” ফসল নয় বরং সেই অজানা জগৎ তাঁকে এক মুহূর্তের জন্য ছুঁয়ে যায়।

আমরা যদি একটু খেয়াল করি, আমাদের প্রতিদিনের জীবনেও এমন মুহূর্ত আসে। আপনি হয়তো কাউকে একটা কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ এমন কিছু বলেন যা আপনার নিজের কাছেও নতুন মনে হয়, অথচ সেটি হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে জরুরি পরামর্শ হয়ে দাঁড়ায়। আপনি সেটা ভাবেননি, তবু সেটা ঘটেছে। এই “অভাবনা”র মুহূর্তগুলোই প্রমাণ যে জীবনের অনেক অংশই পরিকল্পনার বাইরে ঘটে।

তবু মানুষ ভয় পায় অজানাকে। আমরা নিরাপত্তা চাই, নিয়ন্ত্রণ চাই, তাই সবকিছু আগেভাগে ভেবে নিতে ভালোবাসি। কিন্তু প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের নিয়মে চলে না, ভারসাম্যের নিয়মে চলে। যে মানুষ একটু অচিন্তিত হওয়ার সাহস রাখে, সে-ই হয়তো জীবনের গভীর সত্য খুঁজে পায়।

এই অজানা জগৎ আমাদের চিন্তার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং আমাদের চিন্তার পরিপূরক। পরিকল্পনা আমাদেরকে পথ দেখায়, কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ঘটনা আমাদের পথের বাঁক তৈরি করে। পরিকল্পনা ছাড়া জীবন বিশৃঙ্খল, কিন্তু কেবল পরিকল্পনাতেই জীবন নিস্তেজ। জীবনের সৌন্দর্য এই দুইয়ের মিশ্রণে যেখানে কিছুটা জানা, কিছুটা অজানা, কিছুটা চিন্তা, কিছুটা অনুভব।

তাই যখন কেউ চিন্তা না করেই এক বক্তৃতা দিতে উঠে যায়, তখন হয়তো সে মস্তিষ্ক নয়, বরং সেই বৃহত্তর জগতের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কথা বলে। তার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় সেই অদৃশ্য স্রোত, যা আমরা নাম দিই “inspiration” অর্থাৎ, শ্বাস নেওয়া, আত্মার ভেতরে কোনো কিছুর ঢুকে পড়া। হয়তো সেই শ্বাসই প্রকৃতির, বা ঈশ্বরের, বা মানবচেতনার কোনো গভীর স্তরের যেখান থেকে সব সৃষ্টির শুরু।

মূলত,  আমাদের চিন্তা ও পরিকল্পনার সীমা বুঝে নেওয়াই প্রথম জ্ঞান। বাকি জ্ঞান আসে সেই সীমা অতিক্রম করার সাহস থেকে। হয়তো আমাদের উচিত নয় সবসময় ভাবা কীভাবে বলা উচিত; বরং কখনও কখনও বলা উচিত মন খুলে, যেন সেই অচিন্তিত জগৎ আমাদের মাধ্যমে কথা বলে। কারণ, মানুষ যতই ভাবুক, জীবনের সবচেয়ে গভীর সত্যগুলো চিন্তা করে নয়, অনুভব করে আবিষ্কৃত হয়।


মো. ইফতেখার হোসেন
এমবিবিএস ১ম বর্ষ , কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ |
আগ্রহের ক্ষেত্র মূলত আচরণবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান ও অভ্যাসবিজ্ঞান।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

Copyright 2024 biggani.org