সিঙ্গাপুরের ডিজিটাল অর্থনীতি সাম্প্রতিক দশকে এক বিস্ময়কর বিকাশের মধ্য দিয়ে গেছে। আজ এটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ১৭.৭ শতাংশ অবদান রাখছে এবং প্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান ২০২৩ সালে প্রায় দুই লক্ষে পৌঁছেছে। এটি শুধু সংখ্যায় নয়, আকারে ও প্রভাবেও একটি বিশাল খাত। উচ্চ বেতনের এই প্রযুক্তি ক্ষেত্র সিঙ্গাপুরকে এশিয়ার অন্যতম আকর্ষণীয় কর্মবাজারে পরিণত করেছে। তবে এই প্রবৃদ্ধি পুরোপুরি দেশীয় মেধার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠেনি; বরং বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও প্রযুক্তিপেশাজীবীরা এর অন্যতম চালিকা শক্তি। উদাহরণস্বরূপ, দেশটির সফটওয়্যার ডেভেলপারদের মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশই বিদেশি নাগরিক। দ্রুত প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং দক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর প্রযুক্তিকর্মীদের জন্য নতুন দরজা খুলে দিয়েছে।
একসময় সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের শ্রমিক মানেই বোঝানো হতো নির্মাণশিল্প বা জাহাজঘাটার কর্মী। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই চিত্র বদলাচ্ছে। এখন তরুণ বাংলাদেশী সফটওয়্যার প্রকৌশলীরা ক্রমবর্ধমান হারে সিঙ্গাপুরকে বেছে নিচ্ছেন তাঁদের ক্যারিয়ারের প্রারম্ভিক বা মধ্য পর্যায়ের জন্য। ২০২১ সালে প্রায় দুই লক্ষাধিক বাংলাদেশী সিঙ্গাপুরে বসবাস করছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই শ্রমিক হলেও উচ্চশিক্ষিত ও প্রযুক্তি-দক্ষ একটি নতুন প্রজন্ম ধীরে ধীরে দেশটির “টেক বুম”-এর অংশ হয়ে উঠছে। ভৌগোলিক নৈকট্য, সাংস্কৃতিক মিল ও একটি সহায়ক প্রবাসী সমাজের উপস্থিতি সিঙ্গাপুরকে বাংলাদেশের আইটি মেধার জন্য একটি স্বাভাবিক গন্তব্যে পরিণত করেছে। এটি একটি বৃহৎ শ্রমবাহিনীর অভিবাসন নয়, বরং একটি “প্রতিভা করিডর”—যেখানে দু’দেশই পারস্পরিকভাবে লাভবান হতে পারে।
বাংলাদেশী আইটি প্রকৌশলীদের সিঙ্গাপুরমুখী হওয়ার অন্যতম কারণ হলো দুই দেশের ভৌগোলিক নৈকট্য ও সংস্কৃতিগত সাদৃশ্য। ঢাকা থেকে চাঙ্গি বিমানবন্দর পর্যন্ত সরাসরি ফ্লাইটে সময় লাগে মাত্র চার ঘণ্টা। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, প্রয়োজনে দেশে ফিরে আসা—সবই সহজ। আবহাওয়া ও খাদ্যাভ্যাসের মিলও অভ্যস্ত হতে সহায়তা করে। পশ্চিমা দেশের কঠোর ভিসা প্রক্রিয়া ও সাংস্কৃতিক ব্যবধানের তুলনায় সিঙ্গাপুরে কাজ করা তুলনামূলকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যময়। মুসলিম বাংলাদেশীদের জন্য এখানে হালাল খাবার ও ধর্মীয় চর্চার স্বাধীনতাও রয়েছে। এ কারণে অনেকে সিঙ্গাপুরকে “এশিয়া-বন্ধুসুলভ” আন্তর্জাতিক কর্মক্ষেত্র হিসেবে দেখেন, যেখানে আধুনিকতা ও নিজস্ব সংস্কৃতি দুটোই বজায় রাখা যায়।
আরেকটি বড় কারণ হলো দেশটির বিকশিত প্রযুক্তিখাত। সিঙ্গাপুর সরকার তথ্যপ্রযুক্তিকে জাতীয় উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে এবং এর ফলে সফটওয়্যার ও ডেটা-সম্পর্কিত কর্মসংস্থান ক্রমাগত বাড়ছে। ফিনটেক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার সিকিউরিটি, হেলথটেক—সবক্ষেত্রেই দক্ষ জনবল প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বেতন ও কর্মসংস্কৃতি বাংলাদেশের তরুণ প্রকৌশলীদের আকৃষ্ট করছে। তারা জানেন, এখানে তাদের যোগ্যতাকে মর্যাদা দেওয়া হবে এবং তারা কোনো উপশাখার নয়, মূল পণ্য উন্নয়ন দলের অংশ হতে পারবেন। সিঙ্গাপুরের কর্মপরিবেশ মেধাভিত্তিক, যেখানে কর্মীর দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও পেশাগত দায়িত্ববোধকেই সবচেয়ে বেশি মূল্য দেওয়া হয়।
প্রবাসী নেটওয়ার্কও বাংলাদেশের প্রযুক্তি পেশাজীবীদের জন্য এক সহায়ক কাঠামো তৈরি করেছে। সিঙ্গাপুরে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা বাংলাদেশী কমিউনিটি নতুন আগতদের সহায়তা করে থাকে—আবাসনের ব্যবস্থা, চাকরির তথ্য বা স্থানীয় নিয়মকানুন বোঝার ক্ষেত্রে এই নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশী প্রযুক্তিপেশাজীবীদের গ্রুপগুলো অভিজ্ঞ ও নবাগতদের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করছে। এর ফলে, একজন নতুন প্রকৌশলী সিঙ্গাপুরে গিয়ে একা পড়ে যান না, বরং একটি পরিচিত পরিবেশে প্রবেশ করেন যা তাঁর মানিয়ে নেওয়াকে সহজ করে তোলে।
বাংলাদেশের নিজস্ব আইটি খাতের বিকাশ এই প্রবাসী মেধা প্রবাহের ভিত্তি মজবুত করছে। দেশে ৪৫০০-এর বেশি সফটওয়্যার ও আইটি সেবা কোম্পানি কাজ করছে এবং প্রায় তিন লাখ পেশাজীবী এই খাতে যুক্ত। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ১০,০০০-এর বেশি নতুন আইটি স্নাতক বেরিয়ে আসছে। ফলে দক্ষ সফটওয়্যার প্রকৌশলীর এক অবিচ্ছিন্ন সরবরাহ বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে। গিটহাবের পরিসংখ্যান দেখায়, মাত্র এক বছরে বাংলাদেশের সক্রিয় ডেভেলপারদের সংখ্যা ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি বিশ্বে অন্যতম দ্রুততম, যা বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের প্রযুক্তি সক্ষমতার প্রমাণ।
সিঙ্গাপুরের উন্নত প্রযুক্তি ক্ষেত্রগুলোতে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশী প্রকৌশলীদের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। ফিনটেক খাতে তাঁদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিকাশের মতো বাংলাদেশের মোবাইল আর্থিক সেবার অভিজ্ঞতা সিঙ্গাপুরের ডিজিটাল ব্যাংকিং ও পেমেন্ট সিস্টেমে তাঁদের কাজে লাগছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো ব্যাংকিং সেবার বাইরে, তাদের কাছে পৌঁছাতে সিঙ্গাপুরের কোম্পানিগুলো যে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, সেখানে বাংলাদেশের অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা কার্যকর ভূমিকা রাখছেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশী মেধার অবদান বাড়ছে। সিঙ্গাপুরে এআই ব্যবহারের হার দ্রুত বেড়েছে, ফলে মেশিন লার্নিং ও ডেটা বিশ্লেষণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞের চাহিদা প্রবল। বাংলাদেশের অনেক তরুণ এআই-ভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও ওপেন-সোর্স প্রকল্পের মাধ্যমে এই দক্ষতা অর্জন করে সিঙ্গাপুরে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হচ্ছেন। এভাবে তাঁরা শুধু নিজের কর্মজীবনই গড়ে তুলছেন না, বরং সিঙ্গাপুরের ডিজিটাল রূপান্তরেও ভূমিকা রাখছেন।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর মতো উচ্চ গবেষণাধর্মী ক্ষেত্রেও কিছু বাংলাদেশী গবেষক এখন সিঙ্গাপুরে কাজ করছেন। দেশটির নামী বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কোয়ান্টাম প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে এবং এসব প্রকল্পে দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ মেধাবীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। বাংলাদেশী গবেষকদের জন্য এটি এক বিরল সুযোগ, যেখানে তাঁরা উন্নত গবেষণাগারে কাজ করতে পারছেন কিন্তু নিজের দেশ থেকে খুব দূরে যেতে হচ্ছে না।
গেম ডেভেলপমেন্ট ও ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের তরুণরা সিঙ্গাপুরের স্টার্টআপ ও গেমিং কোম্পানিগুলোতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করছেন। মোবাইল গেম ও এক্সটেন্ডেড রিয়েলিটি ডিজাইন করার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয় ব্যবহারকারীদের আচরণ সম্পর্কে তাঁদের গভীর ধারণা সিঙ্গাপুরের আন্তর্জাতিক দলগুলোর জন্য বিশেষভাবে উপকারী। এর ফলে বাংলাদেশের তরুণরা শুধু কোড লেখায় নয়, বরং নতুন পণ্য ও অভিজ্ঞতা তৈরির ক্ষেত্রেও সক্রিয়ভাবে অবদান রাখছেন।
এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশী প্রকৌশলীদের উপস্থিতি সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিতে এবং বাংলাদেশের প্রযুক্তি বিকাশে দ্বিমুখী সুফল আনছে। সিঙ্গাপুরের জন্য তারা একটি নির্ভরযোগ্য দক্ষ জনবল সরবরাহ করছে, যা দেশটির ডিজিটাল অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সাহায্য করছে। ফিনটেক, স্বাস্থ্যপ্রযুক্তি বা এআই—যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, বাংলাদেশী প্রকৌশলীরা সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের উপস্থিতি দেশটির উদ্ভাবনী প্রকল্পগুলোকে দ্রুত এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের জন্য এই প্রবাহ বৈদেশিক মুদ্রা ও জ্ঞান উভয় দিক থেকেই লাভজনক। সিঙ্গাপুরে কর্মরত বাংলাদেশী প্রযুক্তিকর্মীরা তুলনামূলকভাবে বেশি আয় করেন এবং তাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একইসঙ্গে, অনেকেই কিছু বছর পরে দেশে ফিরে আসেন বা রিমোট কাজের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংযোগ বজায় রাখেন। এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তা বাংলাদেশের আইটি শিল্পে নতুন মান যোগ করছে। বাংলাদেশের অনেক সফটওয়্যার কোম্পানি ইতিমধ্যেই সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। এর ফলে একদিকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববাজারে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে, অন্যদিকে সিঙ্গাপুরও দক্ষ কিন্তু সাশ্রয়ী মূল্যের সেবা পাচ্ছে।
এই সম্পর্ককে আরও গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি করতে কিছু নীতি-সমন্বয়ের সুযোগ রয়েছে। উভয় দেশের সরকার যদি দক্ষ কর্মী আদান-প্রদানের প্রক্রিয়াকে সহজ করে, কর্মভিসা ও একাডেমিক স্বীকৃতি আরও নমনীয় করে তোলে, তবে প্রতিভা প্রবাহ আরও বাড়বে। পাশাপাশি, শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগ নেওয়া গেলে দুটি দেশই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে এগিয়ে যাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ও সাইবার নিরাপত্তার মতো ক্ষেত্রে যৌথ গবেষণা বা স্টার্টআপ ইনকিউবেশন কর্মসূচি দুই দেশের মেধাকে যুক্ত করতে পারে।
স্টার্টআপের ক্ষেত্রেও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি এবং সিঙ্গাপুরের জেটিসি লঞ্চপ্যাডের মধ্যে অংশীদারিত্ব গড়ে উঠলে উভয় দেশের উদ্যোক্তারা একে অপরের বাজার ও বিনিয়োগের সুযোগ পেতে পারেন। একইভাবে, আইটি অ্যাসোসিয়েশনগুলো যৌথভাবে ক্যারিয়ার ফেয়ার, মেন্টরশিপ ও ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম আয়োজন করতে পারে, যা তরুণদের জন্য সরাসরি কর্মসংস্থানের পথ উন্মুক্ত করবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশী আইটি প্রকৌশলীদের সিঙ্গাপুরে ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এশিয়ার ডিজিটাল অর্থনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে। এটি শুধু মেধা স্থানান্তর নয়, বরং জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও উন্নয়নের বিনিময়। সঠিক পরিকল্পনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে এই “প্রতিভা করিডর” উভয় দেশের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিশাল সুফল বয়ে আনতে পারে। সিঙ্গাপুর তার প্রযুক্তি নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারবে, আর বাংলাদেশ তার তরুণ মেধাকে বৈশ্বিক পরিসরে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পাবে। এই যৌথ অগ্রযাত্রা প্রমাণ করছে, দক্ষতা ও উদ্যম থাকলে ভৌগোলিক সীমারেখা আর কোনো বাধা নয়—বাংলাদেশের প্রযুক্তি মেধা এখন সত্যিই বিশ্বমঞ্চে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে।

Leave a comment