চিকিৎসা বিদ্যারসায়নবিদ্যা

ব্যথানাশক অণুর অণুকথা

Share
Share

অতিথি লেখক: রউফুল আলম
লেখক ও গবেষক
ইমেইল: [email protected]

রসায়নবিজ্ঞানীদের অবদান চোখের সামনে দেখেও বুঝতে পারি না আমরা। তেমনই এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান ব্যথানাশক রাসায়নিক উদ্ভাবন। উইলোগাছের নির্যাস থেকে এ ব্যথানাশক তৈরিকে রাসায়নিক বিপ্লবও বলা চলে। সেই বিপ্লবের অগ্রপথিকদের কথা ও ইতিহাস…

ইউরোপের মানুষেরা একসময় জ্বর, সর্দি-কাশি হলে উইলোগাছের (Willow Tree) ছাল খেত। কিংবা ছাল থেকে সংগৃহীত নির্যাস পান করত। কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই উইলোগাছের ঔষধি গুণের কথা জানা ছিল মানুষের। ইউরোপ ছাড়াও মেসোপটেমিয়া, আসিরিয়া ইত্যাদি সভ্যতাতেও উইলোগাছের ভেষজগুণের কথা প্রচলিত ছিল। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস উইলোগাছের ঔষধি গুণের কথা লিখেছেন তাঁর বইয়ে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ গাছের পাতা ও ছাল ব্যবহার করেছে।

কিন্তু উইলোগাছের বাকলে কোন কোন রাসায়নিক যৌগ আছে, সেসব যৌগের গঠনই–বা কেমন, এ সম্পর্কে মানুষের জানা ছিল না। উনিশ শতকে ইউরোপিয়ান কেমিস্টদের মধ্যে একটা নবজাগরণের সূচনা হয়। বিভিন্ন উদ্ভিদের নির্যাস থেকে তাঁরা রাসায়নিক যৌগ আলাদা করার চেষ্টা শুরু করেন। একটা গাছের নির্যাসে অনেক রাসায়নিক যৌগ থাকে। সেসব যৌগের মধ্যে নির্দিষ্ট একটা যৌগ মানুষের রোগ প্রশমনে সাহায্য করে। নির্দিষ্ট সেই যৌগকে বলা হয় অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (API)। উনিশ শতকে সেসব যৌগের পৃথক্‌করণ (Isolation) ও রাসায়নিক গঠন নির্ণয় করা ছিল খুবই সময়সাপেক্ষ এবং কষ্টসাধ্য। কিন্তু মেধাবী রসায়নবিজ্ঞানীরা তাঁদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন।

জার্মান রসায়নবিদ ইয়োহান আন্দ্রিয়াস বাকনারম

১৮২৮ সালে ইয়োহান আন্দ্রিয়াস বাকনার নামের এক জার্মান রসায়নবিদ উইলোগাছ থেকে একটি রাসায়নিক যৌগ পৃথক করেন। সেটার নাম দেওয়া হয় স্যালিসিন (Salicin)। উইলোগাছের লাতিন নাম স্যালিক্স থেকে দেওয়া হয় এ নাম। স্যালিসিন নিয়ে ইউরোপের অনেক দেশের রসায়নবিজ্ঞানীদের মধ্যে তখন খুব উত্তেজনা। তাঁরা স্যালিসিন নিয়ে আরও গবেষণা করতে লাগলেন। স্যালিসিনকে বিভিন্ন রোগের জন্য ব্যবহার করা শুরু হয় তখন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৮ সালে ইতালিয়ান রসায়নবিদ রাফায়েল পিরিয়া (Raffaele Piria) স্যালিসিন থেকে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড পৃথক করেন। রসায়নবিদেরা বুঝতে পারলেন, স্যালিসাইলিক অ্যাসিডই সেই জাদুকরি যৌগ, যেটা উইলোগাছের নির্যাসে ছিল। ফলে এ নির্যাস জ্বর নিরাময়ে সাহায্য করত।

জার্মান রসায়নবিদ ফেলিক্স হফম্যান

জার্মানির বিখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি বেয়ার (Bayer) তখন স্যালিসাইলিক অ্যাসিডকে কাজে লাগানোর কথা ভাবতে লাগল। বেয়ার কোম্পানিতে তখন জার্মানির মেধাবী বেশ কজন রসায়নবিজ্ঞানী কাজ করতেন। তাঁদের একজনের নাম আর্থার আইকেনগ্রুন। আইকেনগ্রুনের অধীনে কাজ করতেন ফেলিক্স হফম্যান নামের এক তরুণ রসায়নবিদ। আইকেনগ্রুন তাঁকে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড থেকে অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক অ্যাসিড (ASA) তৈরির নির্দেশ দেন। ফেলিক্স হফম্যান সেই যৌগ তৈরি করেন। একটা যৌগকে রাসায়নিকভাবে অন্য যৌগে রূপান্তর করাকে রাসায়নিক রূপান্তর (Chemical transformation) বলা হয়। অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক অ্যাসিডের নাম দেওয়া হলো অ্যাসপিরিন (Aspirin)। ১৮৯৭ সালের ঘটনা সেটা।

মজার বিষয় হলো, বেয়ারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা শুরুতে অ্যাসপিরিনকে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁদের ধারণা ছিল, অ্যাসপিরিন তেমন কোনো পরিবর্তন আনবে না। সেটা স্যালিসাইলিক অ্যাসিডের মতোই কাজ করবে। আইকেনগ্রুন খুবই বিস্মিত হন। তিনি বিষয়টা মেনে নিতে পারেননি। ফলে তিনি গোপনে নিজের পরিচিত চিকিৎসকদের অ্যাসপিরিন জোগান দেন এবং রোগীদের অ্যাসপিরিন দিতে অনুরোধ করেন। চিকিৎসকেরা তাঁদের রোগীদের অ্যাসপিরিন দেন। পরে আইকেনগ্রুনকে রিপোর্ট করেন যে অ্যাসপিরিন ব্যথানাশক (Analgesic) হিসেবেও দারুণ কাজ করছে। স্যালিসাইলিক অ্যাসিড ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করে না, কিন্তু স্যালিসাইলিক অ্যাসিড থেকে তৈরি অ্যাসপিরিন ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করছে। আইকেনগ্রুন এই ফলাফলে খুবই বিস্মিত হন এবং সিনিয়র সহকর্মীদের জানান। দুই বছরের মাথায়, ১৮৯৯ সালে বেয়ার কোম্পানি অ্যাসপিরিন রেজিস্টার্ড করে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে অ্যাসপিরিন। বিশ শতকের শুরুতে মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে এ ওষুধ। অ্যাসপিরিন ছিল গবেষণাগারে তৈরি প্রথম ওষুধ, যেটা সারা দুনিয়ায় বিক্রি করা হয়। প্রচুর লাভবান হয় বেয়ার কোম্পানি। আজকের দিনেও অ্যাসপিরিন পৃথিবীর অন্যতম বহুল ব্যবহৃত এবং বিক্রীত এক ওষুধ।

সহস্র বছর ধরে যে উইলোগাছের বাকল খেয়ে মানুষ জ্বর-সর্দি থেকে সেরে উঠেছে, সেই বাকল থেকে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড আলাদা করে, শনাক্ত করে সেটাকে রাসায়নিক রূপান্তরের মাধ্যমে আরও উপযোগী ওষুধে পরিণত করেছেন রসায়নবিজ্ঞানীরা। গাছের ওপর নির্ভরশীল না থেকে ল্যাবরেটরিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড তৈরি করে সেটা থেকে অ্যাসপিরিন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। মানবসভ্যতায় মেধাবীদের অবদান এমনই। মেধাবীরা আমাদের চারপাশ থেকে অনেক কিছু উদ্‌ঘাটন করেন। সেটাকে নতুন রূপ দেন। সংজ্ঞায়িত করেন নতুন করে। তারপর সেটা ব্যবহার করেন মানুষের কল্যাণে। অ্যাসপিরিন তেমনই এক গল্প। সারা পৃথিবীর অসংখ্য মানুষকে সুস্থ‍ রাখছে এ ওষুধ।

ছবি ২: স্যালিসাইলিক অ্যাসিড (বাঁয়ে) ও অ্যাসপিরিনের (ডানে) পার্থক্য হলো স্যালিসাইলিক অ্যাসিডের কার্যকর গ্রুপ অ্যালকোহলকে (OH) রূপান্তরিত করা হয়েছে এস্টার (Ester) গ্রুপে।


ছবি ২-এর বাঁয়ের অণুটি হলো স্যালিসাইলিক অ্যাসিড। ডানেরটি অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক অ্যাসিড বা অ্যাসপিরিন। পার্থক্যটা হলো, স্যালিসাইলিক অ্যাসিডের কার্যকর গ্রুপ অ্যালকোহলকে (OH) রূপান্তরিত করা হয়েছে এস্টার (Ester) গ্রুপে। আর এ সামান্য পরিবর্তনই যৌগটির মধ্যে নতুন ঔষধি গুণের জন্ম দিয়েছে। সারা পৃথিবীতে বহু রসায়নবিজ্ঞানী এভাবে অসংখ্য রাসায়নিক যৌগ তৈরি করেন এবং রাসায়নিক রূপান্তর করে থাকেন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণার মাধ্যমে খুঁজে বেড়ান কাঙ্ক্ষিত যৌগ, যেটি হয়তো ভিন্ন রোগের জন্য ওষুধ হয়ে ওঠে।

রসায়নবিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক, চেতনানাশক, ম্যালেরিয়া নিরামকসহ বহু ওষুধ। তাহলে রসায়নবিজ্ঞানীরা ছাড়া পৃথিবীটা কেমন হতো—যন্ত্রণাময় কাতরানো এক মৃত্যুপুরী!

নোট: ১. উইলোগাছ সাধারণত শীতপ্রধান অঞ্চলে জন্মায়।

২. ফেলিক্স হফম্যানকে অ্যাসপিরিন তৈরির কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তবে সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেক লেখক দাবি করেছেন, আইকেনগ্রুনের অধীনে হফম্যান কাজ করতেন। ফলে আইকেনগ্রুনের নির্দেশনাতেই হফম্যান অ্যাসপিরিন তৈরি করেছিলেন।

৩. ১৮৫৩ সালে একজন ফরাসি রসায়নবিজ্ঞানী অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক অ্যাসিড তৈরি করেন। কিন্তু সে যৌগ বিশুদ্ধ ছিল না। রসায়নে বিশুদ্ধ যৌগ পৃথক্‌করণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সে যৌগের ঔষধি গুণাবলি আছে কি না, সেটা তখন পরীক্ষাও করা হয়নি।


তথ্যসূত্র:
এই লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিনের প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে সংগৃহীত।
লেখক: ড. রউফুল আলম, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

Related Articles
এসো শিখিরসায়নবিদ্যা

জৈব যৌগের গঠনের গভীর

জৈব যৌগের আধুনিক গঠন এবং অঙ্কন পদ্ধতি সম্পর্কে বাংলায় জানুন। অ্যালকোহল এবং...

কলামচিকিৎসা বিদ্যা

কলাম: গাট-ব্রেইনঅ্যাক্সিস: অন্ত্রেরব্যাকটেরিয়াকীভাবেআমাদেরমস্তিষ্কনিয়ন্ত্রণকরে?

আপনার অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া কীভাবে আপনার মেজাজ, স্মৃতিশক্তি এবং মানসিক স্বচ্ছতাকে প্রভাবিত করে...

এসো শিখিরসায়নবিদ্যা

জৈব যৌগের গঠন, পর্ব ২

জৈব যৌগ গঠনের মূল বিষয়গুলি বাংলায় শিখুন, যার মধ্যে রয়েছে স্যাচুরেটেড এবং...

এসো শিখিরসায়নবিদ্যা

জৈব যৌগের গঠন কীভাবে আঁকবে

বাংলায় জৈব যৌগ কাঠামো আঁকার মূল বিষয়গুলো শিখুন। মিথেন থেকে সাইক্লোহেক্সেন পর্যন্ত...

রসায়নবিদ্যাসাধারণ বিজ্ঞান

অণু, গন্ধ ও জীবন

গন্ধের অদৃশ্য জগৎ এবং কীভাবে রাসায়নিক অণু স্মৃতি এবং আকর্ষণ থেকে শুরু...

Three Columns Layout

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact

biggani.org❤️gmail.com

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

বিজ্ঞানী অর্গ (biggani.org) বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গবেষণা ও বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় তথ্য ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে – নবীনদের গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় প্রেরণা দেয়া হয়।

যোগাযোগ:

biggani.org@জিমেইল.com

biggani.org, a community of Bangladeshi scientists, shares interviews and information about researchers and scientists in Bengali to inspire young people in research and higher education.