জয়নুল আবেদীন সাগর
এমবিবিএস ৪র্থ বর্ষ (সেশন: ২০২১-২২)
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ
মলিকিউলার অনকোলজি ও স্বাস্থ্যসেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী
প্রযুক্তির পালাবদল আর মানুষের চিন্তার দ্বিধা
“চিকিৎসা কি আর কেবল মানুষের হাতে থাকবে?” এই প্রশ্ন আজকাল চিকিৎসকদের করিডোরে, কনফারেন্সে, এমনকি সাধারণ মানুষের মাঝেও শোনা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা Artificial Intelligence (AI) চিকিৎসাবিজ্ঞানের অঙ্গনে প্রবেশ করে ফেলেছে। একদিকে ডাক্তাররা ভাবছেন, এই প্রযুক্তি তাদের চাকরি কেড়ে নেবে না তো? অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, AI চিকিৎসাকে করবে আরও নিখুঁত, দ্রুত ও সাশ্রয়ী।
তাহলে প্রশ্ন উঠছে — এই AI আসলে ডাক্তারদের প্রতিদ্বন্দ্বী, না কি সহযোদ্ধা?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কী এবং এটি চিকিৎসায় কীভাবে কাজ করে?
Artificial Intelligence (AI) হল এমন এক প্রযুক্তি যা মানুষের মতো চিন্তা করতে, শেখার ক্ষমতা অর্জন করতে ও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। চিকিৎসাক্ষেত্রে AI মূলত কাজ করে মেডিকেল ডেটা বিশ্লেষণ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা পরিকল্পনা, রোগীর মনিটরিং, এমনকি সার্জিক্যাল সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে।
AI-এর অন্যতম প্রধান শক্তি হল এর “machine learning” ক্ষমতা — মানে এটি অভিজ্ঞতা থেকে শিখে ভবিষ্যতে আরও নিখুঁত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন AI-চালিত মেডিকেল প্রযুক্তি: কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ
IBM Watson for Oncology:
মেশিন লার্নিং ও ক্লিনিকাল গবেষণা ডেটার উপর ভিত্তি করে এটি ক্যান্সার রোগীদের জন্য পার্সোনালাইজড ট্রিটমেন্ট সাজেস্ট করে।
এক গবেষণায় দেখা যায়, IBM Watson-এর চিকিৎসা পরিকল্পনা ৯৩% ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ অনকোলজিস্টদের মতের সঙ্গে মিলেছিল (JCO Clinical Cancer Informatics, 2019)।
SkinVision (App):
মোবাইল ক্যামেরায় তোলা ত্বকের ছবি বিশ্লেষণ করে মেলানোমাসহ ত্বকে ক্যান্সারের সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত করে।
PathAI:
এটি মূলত হিস্টোপ্যাথলজি স্লাইড বিশ্লেষণে ব্যবহার হয়। AI সঠিকভাবে ম্যালিগন্যান্সি ডিটেক্ট করতে পারে, এমনকি অনেক সময় মানুষের চেয়েও নিখুঁতভাবে।
Google’s DeepMind – AlphaFold:
প্রোটিন ফোল্ডিংয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করে চিকিৎসা গবেষণায় বিপ্লব এনেছে। ২০২১ সালে Nature জার্নালে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, এটি ৯০% নির্ভুলতার সাথে কাজ করেছে।
AI কি ডাক্তারদের স্থান দখল করবে? না কি তাদের হাত আরও শক্তিশালী করবে?
অনেক চিকিৎসক উদ্বিগ্ন — “রোবট যদি রোগী দেখতে পারে, তাহলে আমাদের দরকার কী?”
আসলে, বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
👉 AI হল decision support system, not a decision-maker.
👉 এটি বিশ্লেষণ করতে পারে, কিন্তু রোগীর চোখের ভাষা, পরিবারিক প্রেক্ষাপট, দুশ্চিন্তা — এসব বুঝতে পারে না।
তাই, Clinical Judgment, Empathy এবং Ethical Decision Making – এই তিনটি ক্ষেত্রে AI কখনই চিকিৎসকের বিকল্প হতে পারবে না।
চিকিৎসা কখনোই শুধুমাত্র রোগ সারানোর বিষয় নয় — এটি মানুষকে সাহস দেওয়া, আশা দেওয়া, ভালোবাসা দেওয়ার কাজও।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: সম্ভাবনার জানালা ও বাস্তব বাধা
বাংলাদেশে এখনো AI পুরোপুরি গৃহীত হয়নি, কিন্তু ধীরে ধীরে পরিবর্তনের ছাপ পড়ছে।
Doctor Koi নামে একটি হেলথ টেক স্টার্টআপ AI ভিত্তিক রোগ-লক্ষণ বিশ্লেষণকারী চ্যাটবট চালু করেছে।
Praava Health ও CMED ব্যবহার করছে ডিজিটাল মেডিকেল রেকর্ড ও রোগীর হেলথ রিপোর্ট বিশ্লেষণের জন্য সফটওয়্যার।
ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ নিয়ে কাজ করা বেশ কিছু ইনিশিয়েটিভে AI ডেটা এনালাইসিস ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকি নির্ণয়ে।
কিন্তু সমস্যা রয়েছে:
১. প্রয়োজনীয় ডেটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার নেই।
২. চিকিৎসকদের মধ্যে AI নিয়ে সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ কম।
৩. গ্রামীণ চিকিৎসায় AI এখনো অপ্রতুল।
যদি সরকার ও প্রাইভেট সেক্টর মিলে AI টুলসের প্রশিক্ষণ, ডেটা সুরক্ষা ও নীতিমালা গঠন করে — তাহলে AI আমাদের দেশের জন্য স্বাস্থ্য বৈষম্য কমাতে পারে।
চিকিৎসায় AI-এর সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা: তুলনামূলক চিত্র
সুবিধা | সীমাবদ্ধতা |
দ্রুত রোগ নির্ণয় | পর্যাপ্ত ডেটা ছাড়া ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে |
খরচ কমায় | মানবিক দৃষ্টিকোণ অনুপস্থিত |
২৪/৭ কাজ করতে পারে | নৈতিক দিকনির্দেশনার অভাব |
দূরবর্তী এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে সাহায্য করে | চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ না থাকলে ব্যবহার কঠিন |
ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যসেবা: মানুষের হৃদয় আর মেশিনের মস্তিষ্কের যুগলবন্দি
কল্পনা করুন: আপনি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই একটি অ্যাপে আপনার মুখ স্ক্যান করালেন। অ্যাপটি বলল — “আপনার চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ, ঘুম কম হয়েছে, রক্তচাপ বাড়তে পারে। পানি পান করুন ও বিশ্রাম নিন।”
এটাই Preventive AI Healthcare — যা রোগ হবার আগেই চিকিৎসা দিয়ে দেয়।
2024 সালে Lancet Digital Health-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়,
“AI-driven predictive care could reduce preventable hospital admissions by 26%.”
সুতরাং, ভবিষ্যতের চিকিৎসা হবে —
“মানুষের হৃদয় + কৃত্রিম মস্তিষ্ক” = পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা
প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, সহযোগিতাই আগামীর ভবিষ্যৎ
আমরা এখন এক সংবেদনশীল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি — যেখানে প্রযুক্তি প্রতিদিন মানুষের সীমা ছুঁয়ে ফেলছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে AI-এর আগমন নতুন দরজা খুলছে, কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের মানবিকতা, সহানুভূতি আর অভিজ্ঞতাকে মেলাতে হবে।
AI চিকিৎসকের বিকল্প নয় — বরং একটি বুদ্ধিমান সহকারী, একটি দ্রুত বিশ্লেষক, একটি দ্বিতীয় মতামত।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে AI-এর ভূমিকা হল, “Doctor’s brain enhancer, not his replacement.”
AI আর চিকিৎসক — এই দুইয়ের সমন্বয়েই গড়ে উঠবে আগামী দিনের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা।
তাই, আমাদের চিন্তাভাবনা বদলাতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতার বদলে চাই সহযোগিতা। ভয় নয়, দরকার জ্ঞান ও অভিযোজন।
কারণ, প্রযুক্তি কখনোই হৃদয় হতে পারে না — আর হৃদয়হীন চিকিৎসা, চিকিৎসা নয়।
🔍 তথ্যসূত্র:
Evaluation of Watson for Oncology, JCO Clinical Cancer Informatics, 2019
PathAI and Histopathology, American Journal of Surgical Pathology
SkinVision App Research, Journal of the European Academy of Dermatology and Venereology
AlphaFold and Protein Structure Prediction, Nature, 2021
Predictive AI in Healthcare, The Lancet Digital Health, 2024
AI in Clinical Decision Making, New England Journal of Medicine, 2016
Digital Health in Bangladesh, LightCastle Partners, 2023
CMED Health & Doctor Koi – Official websites
Leave a comment