সূর্যালোক ছাড়া জীবন কল্পনা করা কঠিন। উদ্ভিদ এবং শৈবালের মতো ফটোসিনথেসিসকারী জীবগুলি সূর্যালোক শোষণ করে এবং এটি ব্যবহার করে রাসায়নিক শক্তি উৎপন্ন করে। তবে যদি এমন এক স্থান থাকে, যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না? বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, এমন পরিস্থিতিতে ফটোসিনথেসিসকারী জীবগুলো একপ্রকার নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কিন্তু সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, আর্কটিক মহাসাগরের বরফাচ্ছন্ন গভীর অঞ্চলে এমন শৈবাল রয়েছে, যারা প্রায় শূন্য আলোতেও বেঁচে থাকে এবং বৃদ্ধিও করে।
অন্ধকারের রাজ্যে ফটোসিনথেসিস
আর্কটিক (Arctic) এর বাংলা নাম – সুমেরু অঞ্চল যা পৃথিবীর সর্ব উত্তরের অঞ্চলটির নাম। শীতকালে এই আর্কটিকে সূর্যের আলো সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। বরফের নিচে থাকা মহাসাগরের পানি ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। এতদিন বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, এই সময়ে শৈবাল ও অন্যান্য ফটোসিনথেসিসকারী জীব নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং বসন্তে আলো ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু জার্মানির আলফ্রেড ভ্যাগেনার ইনস্টিটিউটের জীবরসায়নবিদ ক্লারা হপের গবেষণা আমাদের এই ধারণাটি ভুল প্রমাণ করছে ।
২০২০ সালের শীতকালে তিনি এবং তার দল একটি গবেষণা জাহাজে অবস্থান করে পরীক্ষা করেন যে কতটা কম আলোতে ফটোসিনথেসিস চালানো সম্ভব। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, আর্কটিক মহাসাগরের গভীরে এমন শৈবাল রয়েছে, যারা সূর্যের সামান্যতম আলোর উপস্থিতিতেও জীবনের চক্র চালিয়ে যেতে পারে।
আলো ছাড়াই শক্তি সংগ্রহ
প্রথমদিকে, গবেষকরা মনে করেছিলেন, বরফের নিচে থাকা এই শৈবাল গ্রীষ্মে সক্রিয় হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু ২০১৫ সালে একটি গবেষণায় দেখা যায়, শীতকালেও এই জীবগুলো সক্রিয় রয়েছে। হপের দল সমুদ্রের পানি এবং বরফের নমুনা সংগ্রহ করে দেখতে পান, সেখানে উচ্চ পরিমাণে ক্লোরোফিল রয়েছে, যা ফটোসিনথেসিসের মূল উপাদান। অর্থাৎ, এই শৈবাল শীতকালেও তাদের জীবনচক্র অব্যাহত রাখছে।
কীভাবে সম্ভব?
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এই শৈবাল কয়েকটি সম্ভাব্য উপায়ে জীবনের ধারা বজায় রাখছে:
- সঞ্চিত শক্তি ব্যবহার: কিছু শৈবাল পূর্বে সংগৃহীত জৈব পদার্থ ব্যবহার করে বেঁচে থাকতে পারে।
- সামান্য আলোতে ফটোসিনথেসিস: গবেষণায় দেখা গেছে, ০.০৪ মাইক্রোমোল ফোটনের মতো ক্ষুদ্র পরিমাণ আলোতেও এই শৈবাল সক্রিয় থাকে, যা তাত্ত্বিকভাবে ফটোসিনথেসিসের সর্বনিম্ন সীমা।
- জৈব পদার্থ গ্রহণ: কিছু শৈবাল পানির মধ্যে দ্রবীভূত জৈব পদার্থ গ্রহণ করতে পারে, যা তাদের শীতকালে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।
নতুন ধারণা, নতুন সম্ভাবনা
এই আবিষ্কার শুধু আর্কটিকের জীবনচক্রই নয়, বরং গভীর সমুদ্রের প্রাণীজগত সম্পর্কেও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারে। হপের মতে, যদি আর্কটিকের শৈবাল এই প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তবে গভীর সমুদ্রের শৈবালও একইভাবে টিকে থাকতে পারে।
এই গবেষণা আমাদের শিখিয়েছে, জীবন সব সময় প্রতিকূলতার মধ্যে নতুন পথ খুঁজে নেয়। সামান্যতম আলোও যদি প্রাণের বিকাশে সাহায্য করতে পারে, তবে হয়তো মহাবিশ্বের অন্য কোথাও, যেখানে আলো খুবই কম, সেখানেও জীবন খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এটি শুধু একটি গবেষণা নয়, এটি প্রকৃতির শক্তি ও অভিযোজন ক্ষমতার এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত।
তথ্যসূ্ত্র: https://www.wired.com/story/how-does-life-happen-when-theres-barely-any-light/
Leave a comment