নতুন প্রযুক্তির বাজারে আজকে যে কোম্পানি আকাশে উড়ছে, কাল সে মাটিতে নেমে আসবে—এ কথাটা শুনতে যতটা নাটকীয়, বাস্তবে এখন ততটাই স্বাভাবিক। গত সপ্তাহে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত ভাষা শেখার প্ল্যাটফর্ম ডুয়োলিঙ্গো–এর।
সপ্তাহের শুরুটা ছিল উজ্জ্বল। চমৎকার ত্রৈমাসিক ফলাফল ঘোষণা করে তারা। নতুন সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা বেড়েছে, লাভের পরিমাণ প্রত্যাশার চেয়েও বেশি, আর AI প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে খরচ কমে গেছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা এক লাফে শেয়ারের দাম ৩০% বাড়িয়ে দিল। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল—যতক্ষণ না প্রযুক্তি জগতে আরেকটি বড় ঘটনা ঘটল।
ওপেনএআই উন্মোচন করল তাদের নতুন AI মডেল GPT-5। এটি মাত্র কয়েকটি বাক্য নির্দেশনা থেকে সম্পূর্ণ কার্যকর একটি ভাষা শেখার অ্যাপ বানিয়ে দেখাল। এমনকি এতে ছিল ফ্ল্যাশকার্ড, প্রগ্রেস ট্র্যাকার, আর শব্দ শেখার জন্য চিজ–ইঁদুর খেলার মজাদার সংস্করণও। ফলাফল? কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিনিয়োগকারীরা বুঝে গেলেন—যা ডুয়োলিঙ্গো করতে বছর লেগেছে, সেটি এখন যে কেউ কয়েক মিনিটে বানাতে পারবে। শেয়ারের দাম দ্রুত অর্ধেকে নেমে আসে, এবং সপ্তাহের শেষে পতন আরও গভীর হয়।
এখানেই লুকিয়ে আছে সেই শিক্ষাটি, যা বাংলাদেশের প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের জন্য অমূল্য। আমাদের দেশে অনেক স্টার্টআপ গড়ে উঠছে ই-লার্নিং, ই-কমার্স, ফিনটেক বা স্বাস্থ্যসেবার মতো খাতে। কিন্তু যদি সেই পণ্য বা সেবার মূল প্রযুক্তি সহজে প্রতিলিপি করা যায়—বিশেষ করে AI-এর মাধ্যমে—তাহলে প্রতিযোগী আসতে সময় লাগবে না। ডুয়োলিঙ্গোর মতোই, মুহূর্তেই বাজারের ধাক্কা খেতে হবে।
বাংলাদেশে আমরা প্রায়ই শুনি—“আমাদের পণ্যের আইডিয়া খুব ইউনিক।” কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই ইউনিকনেস কি প্রযুক্তিগতভাবে সুরক্ষিত? নাকি কয়েকটি AI টুল ব্যবহার করেই কেউ অনুরূপ বা আরও উন্নত সংস্করণ বানিয়ে ফেলতে পারবে? ডুয়োলিঙ্গোর বার্ষিক প্রতিবেদনে যেমন স্পষ্টভাবে লেখা ছিল—নতুন প্রযুক্তি বিদ্যমান ব্র্যান্ডকে দ্রুত পিছিয়ে দিতে পারে—এই ঝুঁকি আমাদের স্টার্টআপগুলোতেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, AI দ্বিমুখী তরোয়াল। ডুয়োলিঙ্গোর সাফল্যের একটি বড় কারণ ছিল AI-এর দক্ষ ব্যবহার—শিক্ষার্থীদের জন্য কথোপকথন ফিচার, খরচ কমানো, ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা উন্নত করা। কিন্তু একই AI, অন্য কারও হাতে, তাদের জন্য হয়ে উঠল হুমকি। বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোও যদি AI গ্রহণ করে, তাহলে মনে রাখতে হবে—এটি যেমন আপনার প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা বাড়াতে পারে, তেমনি প্রতিযোগীর হাতেও সমান শক্তি তুলে দিতে পারে।
এখান থেকে আমরা আরেকটি অর্থনৈতিক দিকও দেখতে পাই। ওয়াল স্ট্রিটে এখন সফটওয়্যার কোম্পানির চেয়ে বেশি চাহিদা AI অবকাঠামো বা হার্ডওয়্যার কোম্পানির। কারণ ডেটা সেন্টার, চিপ উৎপাদন বা বড় AI সার্ভার তৈরি করা “ভাইব কোডিং” দিয়ে সম্ভব নয়। বাংলাদেশ যদি দীর্ঘমেয়াদে AI দৌড়ে থাকতে চায়, শুধু অ্যাপ বানানোর দিকে নয়, বরং অবকাঠামো, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিং, এবং নিজস্ব ডেটাসেট তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
সবশেষে, ভাষা শেখা হোক বা যেকোনো দক্ষতা অর্জন, প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক না কেন, মানবিক ছোঁয়া পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করা কঠিন। ডুয়োলিঙ্গো প্রতিযোগিতার মুখে পড়লেও, আমার কিংবা আপনার কোনো ফরাসি শিক্ষক—হয়তো অনলাইনে বা সরাসরি—শিক্ষার্থীর প্রয়োজন অনুযায়ী পাঠ গঠন করে দিতে পারেন, যা কোনো সাধারণ অ্যাপের পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের জন্য এখানেই সুযোগ—প্রযুক্তির সাথে মানবিক সেবা মিশিয়ে এমন কিছু বানানো, যা সহজে প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়।
Leave a comment