রাতে হলুদ আলোয় ভেসে যাওয়া একতলা বাড়ির বারান্দায় বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিলেন রূপা। দৃষ্টিতে ছিল এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তা। ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করার পর অনেক দিন ধরেই তিনি ভাবছিলেন, এত সব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের দুনিয়ায় ‘মানবিকবিদ্যা’ (Humanities) পড়ে আদৌ কি ভালো কোনো পেশা পাওয়া সম্ভব? পরদিন সকালে এক দৈনিকে চোখ বুলিয়ে এক নতুন শব্দবন্ধ তাঁর চোখে পড়ল—“AI Wrangler”। বড় হরফে শিরোনাম ছিল, “Want A Job in AI? Get a Humanities Degree”। বিস্মিত রূপা স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন: প্রযুক্তি দুনিয়ায় কীভাবে ইতিহাস, মনস্তত্ত্ব আর দর্শনের মতো বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে?
রূপার মতো হাজারো শিক্ষার্থী ও তরুণ পেশাজীবী এখন ভাবছেন—কীভাবে এই নতুন যুগে কেবল কোডিং দক্ষতা ছাড়াও অন্য নৈপুণ্য ও সংবেদনশীলতার সমন্বয়ে এআইকে (AI) ঠিক ‘মানবিক’ রূপ দেওয়া যায়?
প্রযুক্তির বাইরেও দরজা খুলছে এআই
গত কয়েক বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) উন্নয়নে প্রযুক্তিগত সক্ষমতার বাইরেও উন্মুক্ত হয়েছে এক নতুন দিগন্ত। গুগল ল্যাবসের ‘NotebookLM’-এর সম্পাদকীয় পরিচালক স্টিভেন জনসন সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেন, “AI এখন এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে দর্শন, মনোবিজ্ঞান আর সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের মতো বিষয়ের জ্ঞান অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কারণ, কেবল প্রযুক্তি জানলেই হবে না—এআইয়ের সুর, তার নৈতিক অবস্থান এবং মানুষের সঙ্গে তার সহজ-সরল যোগাযোগ কেমন হবে, সেটিও ঠিক করতে হবে।”
জনসনের এই কথাই ইঙ্গিত দেয় যে, ভবিষ্যতে কেবল কোড লিখতে পারলেই এআই শিল্পে সুযোগ মিলবে না। এআইকে মানুষের সাথে সংযোগ ও সহাবস্থানে রাখতে, মানবিকবিদ্যার শিক্ষা এবং ভাবনার সূক্ষ্মতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
‘AI Wrangler’—একটি নতুন পেশার উত্থান
টেক দুনিয়ায় সম্প্রতি উঠে আসছে আরেকটি নতুন পদবি, যার নাম ‘AI Wrangler’। স্টিভেন জনসনের ভাষায়, “এআই র্যাংলার হলো এমন পেশাদার, যিনি এআই মডেলের শক্তি ও দুর্বলতা দুটোই ভালোভাবে বোঝেন। তাঁরা কোড লেখা আবশ্যিকভাবে জানেন না, কিন্তু এআইকে কীভাবে সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটা গভীরভাবে বুঝে নেন।”
একজন এআই র্যাংলারকে হতে পারে মানবিকবিদ্যার পটভূমি থেকে আসা কেউ—যিনি ভাষা, মানুষের আবেগ, সংস্কৃতি আর মনস্তত্ত্ব বুঝে এআইকে নির্দিষ্ট প্রয়োজন অনুযায়ী গড়েপিটে তুলতে পারেন।
একজন রুটিন পাঠক অনুপম জানালেন, “আমি কোনো কোডিং ভাষা জানি না। কিন্তু মানুষকে বোঝার চেষ্টা করি, কেন আমরা কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এইভাবে আচরণ করি। এখন শুনছি, এআইকে মানবিক রূপ দিতে এটাই নাকি বড় শক্তি! কে জানত, একদিন এ নিয়ে কাজের সুযোগ তৈরি হবে?”
মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিক দায়িত্ব
সমস্যা হলো, এআই নিয়ে গবেষণা বা তার মূল কাঠামো তৈরির কাজ এখনো অনেকটাই প্রকৌশলী ও সফটওয়্যার ডেভেলপারদের দখলে। মূল মডেলের স্থাপত্য ও গঠন নির্ধারণের পর, কোথায় কেমন ভাষা প্রয়োগ হবে, কী হবে এআইয়ের আচরণগত নিয়ম, সেই পরিমার্জনার কাজ তখন দর্শন, মনস্তত্ত্ব বা ভাষাতত্ত্বের বিশেষজ্ঞদের কাছে যায়। যেমন, অ্যানথ্রপিকের দার্শনিক অ্যামান্ডা আসকেল ‘এআই মডেলের নৈতিক ধ্যানধারণা’ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কী আদৌ নৈতিক বিবেচনা করতে শেখানো উচিত? আর শেখালে, ঠিক কোন মানবিক আদর্শ বা সূত্রকে ধরে এগোব?”
এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার দায়িত্ব এআই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানীদের, যাঁরা অনেক সময় মূল প্রকৌশল দল থেকে কিছুটা আলাদা থাকেন। ফলে এআই-এ মানবিকবিদ্যার অবদান প্রশংসিত হলেও, অনেকে বলছেন যে এ অবদান পুরোমাত্রায় প্রতিফলিত হচ্ছে না, কারণ সূচনা থেকেই তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রে থাকেন না।
শক্তি-দখলের প্রশ্ন ও ভবিষ্যত দৃষ্টিভঙ্গি
অনেকে মনে করছেন, এআইকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে মানবিকবিদ্যার গুরুত্ব আরও বাড়বে। কিন্তু কিছু বিশ্লেষক সতর্ক করে বলেছেন: “শুধু তৈরি হওয়া মডেলগুলোর ব্যক্তিত্ব বা নৈতিকতা পালিশ করার পর্যায়ে একজন দর্শন বা মনোবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞকে আনা হলে, আসল ক্ষমতা বা নিয়ন্ত্রণ কিন্তু প্রকৌশলীদের হাতে থেকেই যাবে।”
যখন এআই-এর মূল যুক্তি (core logic) স্থির করা হয়, তখন যদি ভাষাতত্ত্ববিদ, দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিকরা সেই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত না হন, তবে মডেলের গভীরে তাঁদের প্রভাব সীমিত হবে। ভবিষ্যতে মানবিকবিদ্যা পেশাজীবীদের জন্য বড় সুযোগ হলো, শুধু পরিমার্জনা বা সংশোধনের পর্যায়ে নয়, বরং প্রথম থেকেই এআই-এর নকশায় অংশ নেওয়া।
উপসংহার
রূপা যখন ফের তাঁর ইতিহাস বইয়ের পাতা উল্টে দেখছিলেন, ঠিক তখনই মনে হলো, হয়তো ইতিহাসের পাঠ শুধু অতীতের গল্প নয়, ভবিষ্যতের এআই সিদ্ধান্তেও ভূমিকা রাখতে পারে। মানুষের সাংস্কৃতিক বিবর্তন, মূল্যবোধের পটভূমি—এসব ঠিকঠাক বোঝাই এআই-কে সঠিক পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। কোডিংয়ের বাইরে চিন্তা-ভাবনা, সৃজনশীলতা, নীতি ও নৈতিক দর্শন—এসবই ভবিষ্যতের এআই বিকাশের প্রধান চালিকাশক্তি হতে পারে।
যেমনটা স্টিভেন জনসন বলেছেন, “এআই এখন এমনই একটা জায়গায় এসেছে, যেখানে প্রযুক্তি আর মানবিকতা হাতে হাত রেখে এগোবে। শুধু কোডার নয়, বড় দরকার সেই মানুষদের, যাঁরা পুরো সমাজের প্রতিচ্ছবি এআই-তে বসাতে পারবেন।”
সত্যিই, যুগ বদলাচ্ছে। কোড শব্দের রাজ্যে মানবিকতার রঙ মিশে যাচ্ছে। আর এই পরিবর্তনের পথে, মানবিকবিদ্যার পটভূমি নিয়ে কাজ করা নতুন প্রজন্মের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে অশেষ সম্ভাবনা। শুধু দরকার সেই ধৈর্য আর পরিকল্পনা—প্রযুক্তির মূল নকশায় মানবিকযুক্তিবাদকে সঠিকভাবে জায়গা করে দেওয়া। বলাই বাহুল্য, এআইয়ের ভবিষ্যৎ তখনই উজ্জ্বল হবে, যখন মানুষের সত্যিকারের মূল্যবোধ আর সমাজের বহুমুখী চাহিদা এআই-এর গভীর বুননে সযত্নে জায়গা পাবে।
Leave a comment