কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পড়াশোনা, গবেষণা, প্রোগ্রামিং থেকে শুরু করে ছবি বা ভিডিও তৈরির কাজেও আমরা নির্ভর করছি চ্যাটবট ও জেনারেটিভ মডেলের উপর। কিন্তু এই নির্ভরতার আড়ালে যে বিপুল শক্তি ব্যয়ের গল্প লুকিয়ে আছে, তা আমরা কতটা ভাবি? একেকটি প্রশ্ন, একেকটি ছবি কিংবা ছোট্ট ভিডিও তৈরি করার পেছনে যে অজস্র বিদ্যুৎ খরচ হয়, সেটি আমাদের দৃষ্টির বাইরে থাকে। অথচ এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তি-ব্যয়ের যোগফল তৈরি করছে এমন এক সংকট, যা শুধু প্রযুক্তি নয়, জলবায়ু পরিবর্তনকেও নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে।
এআই প্রশিক্ষণ বা ট্রেনিং ধাপটিই প্রথমে আলোচনায় আসে। উদাহরণস্বরূপ, ওপেনএআই-এর জিপিটি-৪ মডেল তৈরি করতে খরচ হয়েছিল প্রায় একশো মিলিয়ন ডলার এবং প্রয়োজন হয়েছিল ৫০ গিগাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ, যা দিয়ে পুরো সান ফ্রান্সিসকো শহরকে তিন দিন চালানো সম্ভব। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত শক্তি ব্যয়ের বড় অংশ ঘটে যখন আমরা মডেলকে ব্যবহার করি—অর্থাৎ ইনফারেন্স পর্যায়ে। এখন প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ শক্তি খরচ হচ্ছে এই ব্যবহারের পেছনে, কারণ প্রতিদিন কোটি কোটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে এআই।
ডেটা সেন্টারগুলোই এই পুরো প্রক্রিয়ার মূল মঞ্চ। যুক্তরাষ্ট্রে এখন প্রায় তিন হাজার ডেটা সেন্টার রয়েছে, যেখানে হাজার হাজার গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট (GPU) সারাক্ষণ চালু থাকে। এগুলোকে ঠান্ডা রাখতে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ গ্যালন পানি ব্যবহার হয়, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস বা কয়লার মতো দূষণ-সৃষ্টিকারী শক্তি। একেকটি অনুরোধ কোথায় প্রক্রিয়াকৃত হচ্ছে, কোন বিদ্যুৎ গ্রিড থেকে শক্তি আসছে, আর সেই শক্তির কার্বন তীব্রতা কেমন—এসব তথ্য গোপন রাখছে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো। ফলে প্রকৃত প্রভাব বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সামনে থাকে অগণিত ফাঁকা ঘর।
তবু কিছু পরিমাপ আমাদের চোখ খুলে দেয়। মেটার খোলা উৎস মডেল লামা (Llama)-এর সবচেয়ে ছোট সংস্করণ একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গড়ে ১১৪ জুল শক্তি খরচ করে, আর সবচেয়ে বড় সংস্করণে লাগে ৬,৭০৬ জুল। তুলনার জন্য বলা যায়, এটি মাইক্রোওভেন কয়েক সেকেন্ড চালানোর সমান। ছবি তৈরির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও ভিন্ন। স্টেবল ডিফিউশন নামের জনপ্রিয় ইমেজ জেনারেটর একটি সাধারণ মানের ছবি বানাতে খরচ করে প্রায় ২,২৮২ জুল শক্তি। কিন্তু ভিডিও তৈরির ক্ষেত্রে শক্তি খরচ আকাশছোঁয়া—চীনা প্রতিষ্ঠান ঝিপু এআই-এর কগভিডিওএক্স (CogVideoX) মডেলের মাত্র পাঁচ সেকেন্ডের ভিডিও বানাতে লেগে যায় প্রায় ৩.৪ মিলিয়ন জুল, যা একটি মাইক্রোওভেন এক ঘণ্টারও বেশি সময় চালানোর সমান।
এই সংখ্যাগুলো শুনে হয়তো মনে হতে পারে এগুলো তুচ্ছ, কিন্তু হিসাবটা বদলায় যখন আমরা দেখি ব্যবহারের পরিসর। ওপেনএআই জানিয়েছে, চ্যাটজিপিটি প্রতিদিন এক বিলিয়নেরও বেশি বার্তা পায়। শুধু পাঠ্য নয়, ছবি তৈরির অনুরোধও প্রতিদিন প্রায় আট কোটি। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, বছরে এআই কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই শত শত গিগাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ খরচ করছে, যা দিয়ে কয়েক মিলিয়ন বাড়ি চালানো সম্ভব হতো। গবেষণা বলছে, ২০২৮ সালের মধ্যে শুধু এআই-সংক্রান্ত সার্ভারগুলোর বিদ্যুৎ খরচ হবে ৩২৬ টেরাওয়াট-ঘণ্টা পর্যন্ত, যা যুক্তরাষ্ট্রের সব বাড়ির প্রায় ২২ শতাংশের সমান।
বিদ্যুতের এই বাড়তি চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে টেক জায়ান্টরা ছুটছে নানা পথে। মাইক্রোসফট ও মেটা পারমাণবিক শক্তি প্ল্যান্টে বিনিয়োগ করছে, ওপেনএআই ও তাদের অংশীদাররা ৫০০ বিলিয়ন ডলারের স্টারগেট প্রকল্পে ডেটা সেন্টার বানাচ্ছে, আর গুগল শুধু ২০২৫ সালেই এআই অবকাঠামোতে ৭৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু নতুন পারমাণবিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে সময় লাগবে দশকের পর দশক, আর ততদিন পর্যন্ত এআই-নির্ভর ডেটা সেন্টারগুলো ভরসা রাখবে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর। এর ফলস্বরূপ, ডেটা সেন্টারগুলোর কার্বন নিঃসরণ গড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য খাতগুলোর তুলনায় প্রায় ৪৮ শতাংশ বেশি।
এই পরিস্থিতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো স্বচ্ছতার অভাব। ওপেনএআই, গুগল বা মাইক্রোসফট কেউই সুনির্দিষ্টভাবে জানাচ্ছে না যে তাদের প্রতিটি অনুরোধে কতটা শক্তি খরচ হয়। গবেষকরা বিকল্প উপায়ে খোলা উৎস মডেলের তথ্য ব্যবহার করে অনুমান করছেন, কিন্তু এগুলো সবই খণ্ডিত। ফলে নীতিনির্ধারক, পরিবেশবিদ এমনকি বিদ্যুৎ সরবরাহকারীরাও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে পারছেন না সঠিকভাবে। বরং অনেক সময় এই বাড়তি খরচ সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হচ্ছে—গবেষণায় দেখা গেছে, ভার্জিনিয়ার মতো কিছু অঙ্গরাজ্যে গড়ে প্রত্যেক বাসিন্দার মাসিক বিদ্যুৎ বিল বেড়ে যেতে পারে প্রায় ৩৭.৫০ ডলার।
সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো, এই ব্যয় আমাদের সমাজের জন্য কতটা সার্থক। একটি রসিকতা লিখিয়ে নেওয়া, কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করার জন্য পাঁচ সেকেন্ডের ভিডিও বানানো—এগুলোর জন্য এত বিপুল শক্তি ব্যয় কতটা যৌক্তিক? প্রযুক্তি হয়তো বলছে এটি ভবিষ্যতের অবধারিত পথ, কিন্তু আমরা কি প্রস্তুত এমন এক ভবিষ্যতের জন্য যেখানে প্রতিদিনের অনলাইন কার্যকলাপের অদৃশ্য ছায়া হয়ে থাকবে বাড়তি কার্বন নিঃসরণ?
এআই আমাদের জীবনকে সহজ করছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু এর সাথে যে বিদ্যুতের অদৃশ্য বিল যুক্ত হচ্ছে, তা আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। এআই কোম্পানিগুলো যদি সত্যিই টেকসই ভবিষ্যতের কথা ভাবে, তবে তাদের প্রথম দায়িত্ব হবে পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা—প্রতিটি মডেল কত শক্তি ব্যবহার করছে, কোন উৎস থেকে সেই শক্তি আসছে, আর সেই ব্যবহার পৃথিবীর উপর কেমন প্রভাব ফেলছে। অন্যথায়, প্রযুক্তির উন্নতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই অদৃশ্য খরচ একদিন জলবায়ু সংকটকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে।
Leave a comment