কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বিশ্ব ও বাংলাদেশ
বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির উত্থান কর্মক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের অনুমান অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রায় ৮.৫ কোটি চাকরি প্রতিস্থাপন করবে। একই সাথে নতুন ধরনের দক্ষতার চাহিদা তৈরি হচ্ছে – ডেটা বিশ্লেষক, মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞ, এআই-বিষয়ক কারিগরি দক্ষ কর্মীর চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশেও এআই প্রযুক্তির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যদিও সরকার “স্মার্ট বাংলাদেশ” গড়ার লক্ষ্যে কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে, বাস্তবে এআই গ্রহণ ও প্রয়োগ এখনো সীমিত। আইএমএফের এআই প্রস্তুতি সূচকে বাংলাদেশের স্কোর মাত্র ০.৩৮ – উন্নত দেশ এমনকি কিছু প্রতিবেশীর তুলনায়ও অনেক নিচে। এই নিম্ন স্কোর ইঙ্গিত দেয় যে আমাদের ডিজিটাল অবকাঠামো, মানবসম্পদ ও নীতিমালায় বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। দেশের প্রধান শিল্পগুলোতেও প্রযুক্তিগত রূপান্তর শুরু হয়েছে; উদাহরণস্বরূপ, তৈরি পোশাক (RMG) খাতে প্রায় ৪৭% বড় কারখানা এবং ২৫% মাঝারি কারখানা উৎপাদনে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে। এই বাস্তবতা ইঙ্গিত দেয় যে ভবিষ্যতের শ্রমবাজারে টিকে থাকতে প্রযুক্তির সাথে খাপ খাওয়ানোর বিকল্প নেই।
সেকেলে শিক্ষাব্যবস্থার ঝুঁকি ও দক্ষতার ফাঁক
কর্মক্ষেত্র যখন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, তখন যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী না হয়, বাংলাদেশ গুরুতর ঝুঁকির মুখে পড়বে। ইতিমধ্যেই লক্ষণ স্পষ্ট। শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ উচ্চশিক্ষিত হয়েও কর্মসংস্থানের বাইরে রয়েছে – দেশের প্রায় ৯ লক্ষ স্নাতক বেকার, যা স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩.৫% (জাতীয় গড় বেকারত্ব ৪.৪৮% এর তুলনায় বহু ঊর্ধ্বে)। এর একটি বড় কারণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাওয়া শিক্ষা ও বাস্তব চাকরির বাজারের চাহিদার মাঝে বিশাল দূরত্ব। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের (4IR) যুগে দক্ষতার ধরণ বদলে গেছে, কিন্তু আমাদের বহু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম এখনো যুগের চেয়ে পিছিয়ে আছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি অর্জন করলেও শিল্পের প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না।
একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষাবিদ সতর্ক করেছেন যে 4IR–এর পরিবর্তিত কর্মপরিবেশের চাহিদা পূরণে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবিলম্বে পাঠ্যক্রম পুনর্গঠন প্রয়োজন। কেবল তত্ত্বনির্ভর শিক্ষা থেকে বের হয়ে বাস্তব কর্ম-দক্ষতা ও প্রয়োগযোগ্য জ্ঞান বাড়াতে হবে; শিল্পক্ষেত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ তৈরি না করলে স্নাতকদের বাজারের বিদ্যমান চাকরির জন্য প্রস্তুত করাও সম্ভব হবে না। বাস্তব অবস্থাও তাই ইঙ্গিত করছে: ২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় বাংলাদেশের ৪৬% বেসরকারি নিয়োগদাতা জানিয়েছেন, চাকরিপ্রার্থীদের যথার্থ দক্ষতার অভাবে শূন্যপদ পূরণ করতে সমস্যা হচ্ছে। ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, আমাদের স্নাতকদের শেখা দক্ষতা এবং শ্রমবাজারের চাহিদার মধ্যে স্পষ্ট গ্যাপ বা ফাঁক বিদ্যমান। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা যথাযথ দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে পারছে না, যার ফলে অনেক তরুণ-তরুণী ডিগ্রি নিয়েও বেকার থাকছেন বা যোগ্যতা-অসম্পন্ন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
আধুনিক দক্ষতা ও মৌলিক কম্পিউটিং জ্ঞানের গুরুত্ব
বর্তমান শিক্ষাক্রমের অন্যতম দুর্বলতা হল এটিতে আধুনিক কম্পিউটেশনাল চিন্তাধারা ও মৌলিক প্রোগ্রামিং জ্ঞানের ঘাটতি। প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে শুধু ব্যবহারকারী হিসেবে নয়, সৃষ্টিকর্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রামিং লজিক, অ্যালগরিদম, ডেটা স্ট্রাকচার এবং মেমরি ব্যবস্থাপনার মতো ভিত্তি বিষয়গুলোতে দক্ষ হওয়া জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষার্থীরা এআই সরঞ্জাম ব্যবহার করতে শিখছে ঠিকই, কিন্তু একই সাথে কীভাবে এআই কাজ করে – সেই মূল ধারণাগুলো শেখাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে এআই পড়ানো বা শুরু থেকেই লজিক, ডেটা সায়েন্স ও কোডিং অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেবল প্রযুক্তির ভোক্তা নয়, উদ্ভাবক হিসেবেও গড়ে উঠতে পারে।
বর্তমানে অনেক ছাত্র-ছাত্রী উচ্চস্তরের প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ বা রেডিমেড টুল ব্যবহারে দক্ষ হলেও কম্পিউটারের অন্তর্গত কাজের প্রক্রিয়া সম্পর্কে গভীর ধারণা পায় না। ফলে অ্যাসেম্বলি ভাষা বা মেমরি ম্যানেজমেন্টের মতো নিম্নস্তরের বিষয়গুলো উপেক্ষিত রয়ে যাচ্ছে, যা একদিকে সফটওয়্যারের কর্মদক্ষতা ও নিরাপত্তা বোঝার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। মৌলিক অ্যালগরিদম ও স্মৃতিনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত জ্ঞান দুর্বল হলে নতুন সমস্যার সমাধান বা উদ্ভাবনী সফটওয়্যার তৈরির সময় আমাদের তরুণ প্রজন্ম সমস্যায় পড়বে। উচ্চশিক্ষায় তাই আবার এসব ভিত্তিমূলক বিষয় জোর দিয়ে পড়ানো দরকার। একজন প্রাক্তন উপাচার্য প্রস্তাব করেছেন যে STEM এবং মানবিক শাখার কৃত্রিম বিভাজন ভেঙে দিয়ে প্রতিটি বিষয়ে ন্যূনতম গণিত, ডেটা সায়েন্স, প্রোগ্রামিং, ভাষা, দর্শন ও নৈতিকতা শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত – যাতে ছাত্ররা সমন্বিত ও সতর্ক চিন্তাধারার অধিকারী হয়ে 4IR যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। উচ্চশিক্ষার পাঠ্যক্রমেও জাতীয় ও বৈশ্বিক চাহিদার সমন্বয় ঘটিয়ে গণনা-ভিত্তিক চিন্তার উন্নয়ন ঘটাতে হবে, যাতে আমাদের স্নাতকরা দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানে প্রতিযোগিতা করতে পারেন।
এআই সরঞ্জামের আগাম ব্যবহার: আশীর্বাদ না অভিশাপ?
এআই বিপ্লবের সূচনালগ্নেই বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীরা ChatGPT-এর মতো জেনারেটিভ এআই সরঞ্জাম ব্যবহার করা শুরু করেছেন। সুবিধার দিক থেকে এসব টুল দ্রুত তথ্য সরবরাহ, লেখা বা কোড তৈরিতে সহায়তা করে, যা কাজের গতি বাড়ায়। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দেশের স্কুল-কলেজে নিঃশব্দে একটি পরিবর্তন ঘটে গেছে – অনেক শিক্ষার্থী বাড়ির কাজ করতে এখন এআই-এর সহায়তা নিচ্ছে এবং শিক্ষকরা পাঠ পরিকল্পনায় এআই টুল ব্যবহার করছেন। শিক্ষার্থীরা দ্রুত ফল পাওয়ার লোভে কখনো কখনো পড়াশোনা এড়িয়ে কেবল এআই-এর জেনারেট করা উত্তরের উপর নির্ভর করছে। ফলস্বরূপ, সম্পূর্ণ এআই-নির্ভর লেখা বা প্রতিবেদন জমা দেওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে, যা সত্যিকার জ্ঞান অর্জনের বদলে মুখস্থ করা উত্তর পেশ করার সমান। এমন পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষক মূল্যায়নের পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনছেন – ক্লাসে উপস্থিত থেকে তাৎক্ষণিক রচনা লেখা, মৌখিক পরীক্ষা বা প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর নিজস্ব চিন্তার ক্ষমতা যাচাই করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই: ছাত্ররা যেন শুধু এআই-এর তৈরি উত্তরের উপর নির্ভর না করে, নিজের বিচার-বুদ্ধিও কাজে লাগায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই আগাম এআই ব্যবহার আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ? দুটি দিকই আছে। একদিকে, সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এআই শ্রম ও সময় বাঁচিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে। গবেষণা থেকে জানা গেছে যে জেনারেটিভ এআই ব্যবহারে দক্ষ কর্মীদের কার্যক্ষমতা উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পায় এবং কম দক্ষ কর্মীরাও এআই-এর সাহায্যে কাজ দ্রুত শিখতে পারে। অন্যদিকে, অতি-নির্ভরতায় ঝুঁকিও আছে। শিক্ষার্থী বা নবীন পেশাজীবীরা যদি এআই-এর উত্তরের উপর অন্ধভাবে ভরসা করে মৌলিক ধারণা রপ্ত না করেন, তবে তারা চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতা হারানোর ঝুঁকিতে থাকবেন। ভুল বা অতিবিশ্বাসযোগ্য মনে হলেও ভ্রান্ত তথ্য এআই দিতে পারে – যা যাচাই করার দক্ষতা ব্যবহারকারীর না থাকলে বিপর্যয় ঘটতে পারে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ কারণেই এআই পুরোপুরি নিষিদ্ধ না করে দায়িত্বশীল ব্যবহারের উপর জোর দিচ্ছেন। যেমন, ঢাকার একটি বিদ্যালয়ের উপপ্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন যে তারা পাঠ্যক্রমে এআই অন্তর্ভুক্ত ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষাবোর্ডের সাথে কাজ করছেন, যেন প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল নেওয়া যায় এবং সাথে সাথে ছাত্রদের অন্যায়ভাবে এআই ব্যবহারের প্রবণতা শনাক্ত করা যায়। মোটকথা, এআইকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়, বরং এটি কীভাবে এবং কোথায় ব্যবহার উপযোগী তা শিখতে হবে। শিক্ষার্থীদের এআই ব্যবহারের সময় সমালোচনামূলক মানসিকতা অবলম্বন করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে – যেন তারা এআই-এর উত্তরের সঙ্গে সবসময় একমত না হয়ে নিজে বিশ্লেষণ করে দেখেন এবং তথ্যের সত্যতা নিরীক্ষণ করেন। এভাবে এআইকে একটি সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে, নিজের মৌলিক দক্ষতাকে শাণিত রাখাই হবে মূলমন্ত্র।
ভবিষ্যতের কর্মশক্তি ও জনমিতিক চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ বর্তমানে “জনমিতিক লভ্যাংশ” এর সুবিধাজনক পর্যায়ে রয়েছে – মোট জনগোষ্ঠীর তিন-চতুর্থাংশই তরুণ (২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশের ৭৫.৩% মানুষ의 বয়স ৪১ বা তার কম)। এই বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠী আগামী দুই দশকে আমাদের অর্থনীতির চালিকা শক্তি হতে পারে। তবে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP) অনুযায়ী, এ সুযোগ চিরস্থায়ী নয়; দেশের জনমিতিক লভ্যাংশের উইন্ডো ২০৪০ সালের পর বন্ধ হতে শুরু করবে। ইতিমধ্যে ২০২৩ সালেই কর্মক্ষম জনগণের অনুপাত সামান্য কমার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, যা দেখাচ্ছে যে আগামীতে প্রবীণ নির্ভরতা বাড়বে। অর্থাৎ আমাদের হাতে আর ১৫ বছরেরও কম সময় আছে, যখন দেশের যুবসমাজকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা দ্রুত ঘোরানো সম্ভব।
দুঃখজনক হলো, এত বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ কর্ম বা প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত নেই। NEET (Not in Education, Employment, or Training) সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৫-২৪ বছর বয়সী যুবাদের মধ্যে প্রায় ৪১% বর্তমানে কোনো শিক্ষা, চাকরি বা প্রশিক্ষণে নিযুক্ত নয়, যা সংখ্যায় প্রায় ১.৩ কোটি তরুণ-তরুণী। বিশেষ করে তরুণীদের ক্ষেত্রে এ হার ৬২% মতো, যা আরও উদ্বেগজনক। অর্থাৎ আমাদের বিশাল যুবশক্তির বড় অংশটাই কার্যত অব্যবহৃত ও অদক্ষ রয়ে যাচ্ছে। এই উপলক্ষ্যহীন যুবসমাজ ভবিষ্যতে দেশের জন্য ভার হয়ে দাঁড়াতে পারে, যদি না আমরা এখনই তাদের দক্ষ করে তুলতে পারি।
আরেকটি উদ্বেগের দিক হলো জ্যেষ্ঠ পেশাজীবীদের অবসরজনিত শূন্যতা। বর্তমানে বিভিন্ন শিল্প ও পেশাক্ষেত্রে যারা বিশেষজ্ঞ এবং দেশকে টেনে নিচ্ছেন, আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে তাঁদের অনেকে অবসরে যাবেন। তখন দায়িত্ব কাদের হাতে যাবে? যদি বর্তমান শিক্ষার্থীরা যুগোপযোগী জ্ঞান ও নেতৃত্বের ক্ষমতা অর্জন না করে, তবে একটি দক্ষতার শুন্যস্থান তৈরি হবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, দেশে তথ্যপ্রযুক্তি কিংবা প্রকৌশল খাতে যে সিনিয়র বিশেষজ্ঞরা আছেন, তাঁদের মেধা ও অভিজ্ঞতার বিকল্প তরুণ প্রজন্ম এখনও পুরোপুরি তৈরি নয়। বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন: “তরুণদের কীভাবে এমনভাবে প্রস্তুত করবেন যে তারা কেবল বর্তমানের নয়, ভবিষ্যতে যে ধরণের কাজ সৃষ্টি হবে সেগুলোর জন্যও দক্ষ থাকবে?” – এই প্রশ্ন বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যদি আমরা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার এখনই না করি, তবে একদিকে যুগের সাথে তাল মেলাতে না পারা বেকার স্নাতকের সংখ্যা বাড়বে অন্যদিকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের ঘাটতি দেশের অর্থনীতিকে পিছিয়ে দেবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (উদাহরণস্বরূপ ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য) অর্জন করতেও দক্ষ মানবসম্পদই হবে মূল চালিকা শক্তি। তাই জনমিতিক সুযোগের সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই আমাদের তরুণদের সক্ষম করে তুলতে হবে।
প্রতিবেশী দেশের শিক্ষা-সংস্কার থেকে শেখা
বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য আশার বিষয় হলো, কাছাকাছি অনেক দেশ ইতোমধ্যে শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন এনে এআই যুগের জন্য উপযোগী কর্মী তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতের উদাহরণ ধরা যাক: ২০২০ সালের জাতীয় শিক্ষা নীতি (NEP 2020) অনুসারে সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে কোডিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মৌলিক ধারণা শিক্ষার্থীদের শেখানোর সুপারিশ করা হয়েছে। সেন্ট্রাল বোর্ড (CBSE) ইতোমধ্যে নবম-দশম শ্রেণিতে এআই ও আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) বিষয়ক পাঠ্যক্রম চালু করেছে। লক্ষ্য হচ্ছে শুরু থেকেই ডিজিটাল দক্ষতা ও প্রোগ্রামিং যৌক্তিকতা গড়ে তোলা, যাতে ছাত্রছাত্রীরা ভবিষ্যতের ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য প্রস্তুত হয়। ভারতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক প্রশিক্ষণেও এআই অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধান ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী দক্ষতা দেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
আরেকটি উদাহরণ ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম সরকার শিক্ষা খাতে এআই সংশ্লিষ্ট রূপান্তরের জন্য জাতীয় কর্মসূচি হাতে নিয়েছে এবং ২০২5 সালের মধ্যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এআই ব্যবহারে পারদর্শী করতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ভিয়েতনামে অনলাইনে সক্রিয় মানুষের মধ্যে ৭৮% ইতিমধ্যেই কোনো না কোনো এআই টুল ব্যবহার করে দেখেছে, যা অভাবনীয় উদ্দীপনার ইঙ্গিত। দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২৫ জাতীয় পরিকল্পনায় শিক্ষকদের জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণ ও বিদ্যালয়ে এআই টুলের পাইলট প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করেছে। একটি প্রদেশে ৪,০০০ শিক্ষকের এআই প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে, এবং শ্রেণিকক্ষে এআই ও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তি পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগ ভিয়েতনামের ছাত্র-শিক্ষকদের ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানো এবং ২১শ শতকের দক্ষতায় দিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে গৃহীত। তার ফলও দেখা যাচ্ছে – প্রযুক্তিখাতে ভিয়েতনামের অগ্রগতি ও রপ্তানিমুখী আইটি সেবা খাতে সফল উপস্থিতি। প্রতিবেশী আরও দেশ – যেমন মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর – তাদের শিক্ষাব্যवস্থায় প্রোগ্রামিং ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারা খুব কম বয়স থেকে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং ফলশ্রুতিতে বৈশ্বিক কর্মবাজারে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করছে। নিজেদের স্বার্থেই বাংলাদেশকে এই অঞ্চলের উদাহরণগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
উপসংহার: পাঠ্যক্রম সংস্কারের এখনই সময়
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত ভবিষ্যতের জন্য আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার অপরিহার্য। সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই; আগামী এক-দুই দশকই নির্ধারণ করে দেবে বাংলাদেশ এআই যুগের অর্থনীতিতে এগোবে নাকি পিছিয়ে পড়বে। তাই এখনই কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত:
জরুরি পদক্ষেপসমূহ
- জাতীয় কারিকুলাম আধুনিকায়ন টাস্কফোর্স গঠন: সরকারি উদ্যোগে শিক্ষাবিদ, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, শিল্পখাতের প্রতিনিধি ও নীতিনির্ধারকদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স দ্রুত গঠন করতে হবে। …
- পাঠ্যক্রমে এআই ও প্রযুক্তি বিষয়ক কোর্স যোগ: সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ে (বিশেষত বিজ্ঞান, প্রকৌশল, ব্যবসা ও সমাজবিজ্ঞান শাখায়) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, ডেটা সায়েন্স, এবং অটোমেশন প্রভৃতি বিষয়ের

Leave a comment