ড. মশিউর রহমান
একটা দৃশ্য কল্পনা করুন। ঢাকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বসে আছেন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নাবিল। একসময় পরীক্ষার আগের রাত মানেই ছিল বইয়ের পাতায় ডুবে থাকা, খাতায় খাতায় হিসাব মেলানো। কিন্তু এখন চ্যাটজিপিটি খুললেই কয়েক সেকেন্ডে নোট তৈরি, অঙ্কের সমাধান, এমনকি পুরো প্রবন্ধের খসড়াও তৈরি হয়ে যায়। প্রথমে নাবিলের কাছে এটা ছিল যাদুর মতো। কয়েক মাস পর সে বুঝল, শিক্ষক যখন ক্লাসে হঠাৎ কোনো প্রশ্ন করেন, মস্তিষ্ক যেন খালি হয়ে যায়। উত্তর মাথায় আসে না, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। প্রযুক্তির আরাম তার চিন্তার পেশিকে নিঃশব্দে দুর্বল করে ফেলেছে।
এটাই বিজ্ঞানীরা বলছেন “cognitive offloading”—অর্থাৎ চিন্তার ভার অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে গবেষক পল রাস্ট ও নিনা ভাসান সতর্ক করেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে অলস করে দিতে পারে। তাদের সমাধান: “AI fasting”—নিয়মিত সময়ের জন্য এআই থেকে বিরতি নেওয়া, যেন স্মৃতিশক্তি, সৃজনশীলতা এবং সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতা অটুট থাকে।
কেবল সতর্কবার্তাই নয়, তথ্যপ্রমাণও বলছে একই কথা। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় ৩০০ শিক্ষার্থীকে দুটি দলে ভাগ করে পরীক্ষা করা হয়। একদল চ্যাটজিপিটির সাহায্যে সমস্যার সমাধান শেখে, অন্যদল শুধুমাত্র নিজেদের চেষ্টায় সমাধান করে। প্রথমদিকে এআই-নির্ভর শিক্ষার্থীরা ২৫ শতাংশ বেশি নম্বর পেলেও, কয়েক সপ্তাহ পর এআই ছাড়া পরীক্ষায় তাদের গড় নম্বর ১৮ শতাংশ কমে যায়। অপরদিকে যারা নিজস্ব প্রচেষ্টায় শিখেছিল, তাদের ফলাফলে তেমন পার্থক্য দেখা যায়নি। গবেষকরা বলছেন, প্রথম দলের মস্তিষ্ক কেবল ‘সহজ রাস্তা’ শিখেছিল, নিজে সমস্যা বিশ্লেষণ করার গভীর ক্ষমতা তৈরি হয়নি।
মনোবিজ্ঞানীরা যাকে বলেন “mastery experiences”—নিজের প্রচেষ্টায় সমস্যার সমাধান করার যে কঠিন কিন্তু তৃপ্তিকর পথ, সেটিই আসলে আত্মবিশ্বাস ও মানসিক শক্তির মূল ভিত্তি। যখন আমরা কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়ে লড়াই করে সমাধান বের করি, তখন শুধু জ্ঞান অর্জন করি না, নিজের ওপর আস্থাও গড়ে তুলি। এটাই আমাদের প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাঁড় করায় এবং সত্যিকারের দক্ষতা তৈরি করে। অথচ এআই-এর অতিরিক্ত ব্যবহার এই স্বাভাবিক শিক্ষণপ্রক্রিয়াকে বাইপাস করে দেয়। চিন্তা করার সেই মেহনত এড়িয়ে গেলে ধীরে ধীরে আমাদের সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা ও সৃজনশীলতার পেশি শুকিয়ে যেতে শুরু করে।
আরও বড় চিত্রটা দেখতে গেলে দেখা যায়, ২০২৫ সালের শুরুতে প্রকাশিত পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক সমীক্ষা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৬২ শতাংশ তরুণ প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা জেনারেটিভ এআই টুল ব্যবহার করছে, এবং তাদের মধ্যে ৪১ শতাংশ স্বীকার করেছে যে, কোনো নতুন বিষয় শেখার সময় তারা প্রথমে নিজে চেষ্টা না করে সরাসরি এআই-এর সাহায্য নেয়। এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, কয়েক বছরের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তা ও বিশ্লেষণের অভ্যাসে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
তাহলে উপায় কী? সমাধান মোটেও এআইকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া নয়। বরং এআইকে ব্যবহার করতে হবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে—যেমনটা আমরা স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস মেনে চলি। প্রথম ধাপ হতে পারে নিজের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে খসড়া তৈরি করা। একটি লেখার রূপরেখা নিজে বানিয়ে নেওয়ার পর এআইকে বলা যেতে পারে সেই খসড়াটিকে পরিমার্জন করতে। এর ফলে প্রাথমিক ভাবনা নিজের মাথা থেকেই আসবে, এআই কেবল নিখুঁত করার কাজটুকু করবে। এভাবেই মস্তিষ্ক থাকবে সক্রিয়, আর এআই হবে সহায়ক, প্রভু নয়।
এআইকে যদি শিক্ষক হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তাতেও উপকার মেলে। কেবল উত্তর চাইবার বদলে ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ চাইলে যুক্তি শেখা যায়, সমস্যার সমাধানের পথ বোঝা যায়। যেমন গণিতের কোনো জটিল অঙ্কে সরাসরি উত্তর না নিয়ে এআইকে যুক্তির ধাপগুলো বুঝিয়ে বলতে বলা যেতে পারে। এতে মস্তিষ্ক নিজেও যুক্তির সিঁড়ি বেয়ে ওঠে, সহজ শর্টকাটে নির্ভর করে না।
তবে যেকোনো এআই-উৎপন্ন লেখা বা বিশ্লেষণকে চোখ বুজে মেনে নেওয়া যাবে না। আউটপুটগুলোকে সমালোচনামূলক চোখে দেখা, তথ্য-উৎসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা জরুরি। যেমন, এআই যদি কোনো প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ দেয়, সেটি আসল উৎসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা উচিত। এতে শুধু ভুল ধরা পড়ে না, নিজের বিশ্লেষণ ক্ষমতাও ঝালিয়ে নেওয়া হয়।
সবচেয়ে কঠিন হলেও সবচেয়ে জরুরি ধাপটি হলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সম্পূর্ণ এআইমুক্ত থাকা। প্রেজেন্টেশনের স্লাইড তৈরি করা বা কোনো নতুন আইডিয়া নিয়ে ব্রেইনস্টর্ম করা—এই ধরনের কাজে মাঝে মাঝে এআই-কে একেবারেই ব্যবহার না করে নিজের মাথাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া। প্রথমে এটা অস্বস্তিকর মনে হলেও কিছুদিনের মধ্যেই এর সুফল ধরা দেবে—মস্তিষ্কের জড়তা কাটবে, নতুন নতুন সংযোগের স্ফুরণ ঘটবে।
এই প্রক্রিয়াকে সহজ করতে কয়েকটি ছোট কৌশল কাজে লাগতে পারে। প্রতিদিন অন্তত ত্রিশ মিনিট নিজের চিন্তাশক্তি দিয়ে কোনো একটি বিষয় লিখে রাখুন—হোক তা ডায়েরির পাতায় বা গবেষণার নোটে। সপ্তাহে অন্তত একদিন পুরোপুরি “এআই-ফ্রি” দিন ঘোষণা করুন, যেখানে কোনো প্রবন্ধ, প্রেজেন্টেশন বা সৃজনশীল কাজ শুধুমাত্র নিজের প্রচেষ্টায় করবেন। জটিল সমস্যার সমাধানে প্রথমে নিজের সমাধান খুঁজে দেখুন, তারপর এআই-এর পরামর্শের সঙ্গে মিলিয়ে নিন। এবং সবচেয়ে জরুরি—বন্ধু বা সহকর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যুক্তি-তর্কে অংশ নিন, কারণ প্রাণবন্ত বিতর্কই মস্তিষ্ককে সবচেয়ে বেশি সচল রাখে।
শেষ পর্যন্ত সমাধান একটাই: এআইকে শত্রু ভাবার দরকার নেই, আবার অন্ধভাবে নির্ভর করাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। যেভাবে যোগব্যায়াম বা ধ্যান মনকে প্রশান্ত রাখে, সেভাবেই প্রযুক্তির এই যুগে প্রয়োজন “এআই ডিটক্স”—একটি সচেতন অনুশীলন, যা আমাদের বুদ্ধিকে সতেজ রাখবে, সৃজনশীলতাকে প্রখর করবে এবং মানুষ হিসেবে আমাদের স্বকীয় শক্তিকে অটুট রাখবে।
Leave a comment