সূত্র: সমকাল
প্রথম প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৫
বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এখন শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ধারায় একটি ধাপ নয়, বরং শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের চালিকাশক্তি। স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে আর্থিক খাত, কৃষি থেকে উৎপাদন– প্রতিটি ক্ষেত্রেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু এই প্রযুক্তি গ্রহণের সবচেয়ে বড় অন্তরায় দক্ষ জনবলের ঘাটতি। সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের ৭৬% বড় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বীকার করেছে, তাদের প্রতিষ্ঠানে অভিজ্ঞ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে এবং ৯৩% প্রতিষ্ঠানের মতে, ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হবে ‘অত্যাবশ্যক’ প্রযুক্তি।
কিন্তু এই বিশেষজ্ঞের সংকট বৈশ্বিকভাবেই স্পষ্ট। ভারতের মতো বড় প্রযুক্তি বাজারেও আগামী ৫-১০ বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চাহিদার অর্ধেকও পূরণ করা সম্ভব হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্য বলছে, গত এক বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সংশ্লিষ্ট দক্ষতার চাহিদা দাঁড়িয়েছে পাঁচ গুণ। জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব (যেমন চ্যাটজিপিটি) এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে এখন ‘প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ার’ বা ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ’ নামে নতুন পদ তৈরি হচ্ছে, যা কয়েক বছর আগেও ছিল অকল্পনীয়।
দক্ষতার এই ঘাটতি আউটসোর্সিং সেবা গ্রহণের প্রবণতাকে দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ নিয়োগ ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন বাহ্যিক সেবা প্রদানকারীর ওপর নির্ভরশীল। প্রায় ৯০% বড় উদ্যোক্তা বলছেন, তাদের কর্মী বাহিনীকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রস্তুত করতে বাইরের প্রশিক্ষণ বা বিশেষজ্ঞ দরকার।
এখানেই বাংলাদেশের জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। দেশে অনেক বড় তরুণ শ্রমশক্তি রয়েছে, যারা দ্রুত ডিজিটাল দক্ষতা রপ্ত করছে। গত এক দশকে তথ্যপ্রযুক্তি ও আউটসোর্সিং খাত উল্লেখযোগ্য প্রসার লাভ করেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বাজারমূল্য ৪.৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে, যেখানে সাধারণ সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের অনেক সেবাও গুরুত্ব পাবে। বর্তমানে বিপিও শিল্প বছরে প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করছে এবং ৮০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে।
কীভাবে এই প্রবৃদ্ধিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা-সায়েন্স সেবার দিকে ঘুরিয়ে আনা যায়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে আমাদের কিছু কোম্পানি গ্রাহকসেবা স্বয়ংক্রিয়করণ, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালিটিক্স এবং মার্কেটিং ডেটা বিশ্লেষণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার শুরু করেছে। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে সুসংগঠিত রোডম্যাপ প্রয়োজন। কৌশলগতভাবে প্রথম ধাপে, অর্থাৎ আগামী ১-২ বছরে বিদ্যমান সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত সেবা শুরু করা উচিত। যেমন ডেটা লেবেলিং ও অ্যানোটেশন, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল প্রশিক্ষণের জন্য অপরিহার্য। একইভাবে চ্যাটবট ও ভয়েসবটের মাধ্যমে গ্রাহকসেবা স্বয়ংক্রিয় করলে আন্তর্জাতিক বাজারে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-রেডি’ পরিচিতি পাওয়া যাবে। পাশাপাশি মেশিন লার্নিং বেজ্ড পূর্বাভাসমূলক বিশ্লেষণ যোগ করে বিদ্যমান ডেটা অ্যানালিটিক্স সেবার মূল্য অনেক গুণ করা সম্ভব।
এ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশের কৌশল নির্ধারণে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার বিষয়টি উপেক্ষা করা যাবে না। ভারতের বেঙ্গালুরু, ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি এবং ফিলিপাইনের ম্যানিলা ইতোমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত সেবা রপ্তানিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। কিন্তু আমাদের তুলনামূলক কম ব্যয়, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা এবং বৃহৎ তরুণ জনসংখ্যা আমাদের বিশেষ সুবিধা দিতে পারে। সঠিক বাজার পজিশনিংয়ের মাধ্যমে আমরা এই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে পারি। দীর্ঘমেয়াদে অর্থাৎ ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত শিল্পভিত্তিক বিশেষায়িত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমাধান তৈরি করা। গার্মেন্টস, কৃষি, ব্যাংকিং ও মোবাইল ফিন্যান্স, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবহন– এসব খাতে স্থানীয় অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে বিশ্বমানের সমাধান তৈরি করা সম্ভব। গার্মেন্টস খাতে মেশিন ভিশন দিয়ে ত্রুটি শনাক্তকরণ, কৃষিতে রোগ নির্ণয় মডেল বা স্বাস্থ্যসেবায় এক্স-রে/এমআরআই বিশ্লেষণ– এসব উদাহরণ শুধু রপ্তানিযোগ্য নয়, বরং বাংলাদেশের বিশেষত্ব হয়ে উঠতে পারে।
একই সঙ্গে প্রকল্পভিত্তিক সেবা থেকে পণ্যভিত্তিক মডেলে রূপান্তর গুরুত্বপূর্ণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করলে বহু ক্লায়েন্ট সাবস্ক্রিপশন নিয়ে ব্যবহার করতে পারবে, যা স্কেলেবল এবং টেকসই আয়ের উৎস হবে। এ জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ অপরিহার্য। এই যাত্রায় প্রবাসী বাংলাদেশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ। একটি ‘গ্লোবাল বাংলাদেশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেটওয়ার্ক’ তৈরি করে রিমোট মেন্টরিং, প্রশিক্ষণ এবং যৌথ প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় দক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
দেশীয় স্টার্টআপ ও এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষায়িত ফান্ড গঠন করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ডেটা সার্ভারের সুবিধা, মেন্টরশিপ ও আন্তর্জাতিক বাজার সংযোগ দেওয়া উচিত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়নকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হবে। আর সেটিই হবে প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনৈতিক রূপান্তরের প্রকৃত সূচনা।
ড. মশিউর রহমান:
ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার, ওমরন হেল্থকেয়ার সিঙ্গাপুর
[email protected]
Leave a comment