বিজ্ঞানী অর্গ, প্রযুক্তি ডেস্ক
আমরা সবাই জানি, ইন্টারনেটে কিছু খুঁজতে গেলে সাধারণত গুগলে গিয়ে কীওয়ার্ড লিখি, আর তার ফলাফল হিসেবে কিছু ওয়েবসাইটের লিংক পাই। কখনো উত্তর সরাসরি পাওয়া যায়, কখনো প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য লিংক খুলতে হয়। কিন্তু এই চিত্র দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
আমরা এখন এমন এক নতুন যুগে প্রবেশ করছি যেখানে ইন্টারনেট অনুসন্ধান মানেই আর কেবল কীওয়ার্ড নয়, বরং স্বাভাবিক ভাষায় প্রশ্ন করা এবং সরাসরি উত্তর পাওয়া। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এখন থেকে গুগল বা অন্য কোনো সার্চ ইঞ্জিন আপনাকে শুধু ওয়েবসাইটের লিংক দেবে না, বরং সম্পূর্ণ উত্তরও দেবে, যা বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত এবং AI-এর মাধ্যমে গঠিত।
কেমন হবে নতুন অনুসন্ধান?
আগে গুগলে যদি আপনি “জাপানে বেড়াতে গেলে কোন ফেস্টিভাল দেখতে পারবো?” লিখতেন, তাহলে আপনাকে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের লিংক দেখানো হতো। কিন্তু AI-চালিত সার্চ আপনাকে সরাসরি উত্তর দেবে—যেমন, “আপনি টোকিও থাকলে শিনজুকু গিও-এনে এই উৎসব দেখতে পারেন।”
এমনকি আপনি যদি কোনো পাখির নাম না জেনে শুধুমাত্র তার গায়ের রঙ বা ডাকের ধরণ বর্ণনা করেন, AI আপনাকে তার সম্ভাব্য নাম এবং আরও বিস্তারিত তথ্য দিতে পারবে। একইভাবে, ফ্রিজের কোনো সমস্যা বা গাড়ির অদ্ভুত শব্দ সম্পর্কে জানতে চাইলে AI আপনাকে সমাধানের পথ বাতলে দেবে।
গুগল ও অন্যান্য কোম্পানির প্রতিযোগিতা
গুগল দীর্ঘদিন ধরেই সার্চ ইঞ্জিনের শীর্ষে ছিল। তবে AI-ভিত্তিক অনুসন্ধানের ফলে এখন মাইক্রোসফটের বিং, ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি, মেটার ল্যাব এবং স্টার্টআপ পারপ্লেক্সিটি নতুন প্রতিযোগী হয়ে উঠছে। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো চাইছে তাদের প্ল্যাটফর্মকে আরও স্মার্ট করে তোলা, যাতে ব্যবহারকারীরা সহজেই প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারেন।
গুগল ইতিমধ্যেই AI-ভিত্তিক সার্চ সিস্টেম চালু করেছে, যার মাধ্যমে তথ্য আরও সহজলভ্য হচ্ছে। মাইক্রোসফট তাদের বিং সার্চে AI যুক্ত করেছে, যা আরও উন্নত ফলাফল প্রদান করছে। ওপেনএআই তাদের চ্যাটজিপিটিকে ইন্টারনেট ব্রাউজিং ক্ষমতা দিয়েছে, ফলে এটি এখন আরও শক্তিশালী তথ্য প্রদান করতে সক্ষম।
এ পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ কী?
AI-চালিত অনুসন্ধান প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে কিছু নতুন সমস্যাও দেখা দিচ্ছে।
১. কন্টেন্ট নির্মাতাদের উদ্বেগ: অনেকে মনে করছেন, AI যদি সরাসরি উত্তর দিয়ে দেয়, তাহলে মানুষ ওয়েবসাইটে প্রবেশ করবে না, ফলে কন্টেন্ট নির্মাতারা আয় হারাবেন। অনেক সাংবাদিক ও ব্লগারদের অভিযোগ, তাদের লেখা AI ব্যবহার করে উত্তর তৈরি হচ্ছে, কিন্তু মূল লেখকের স্বীকৃতি বা পেমেন্ট মিলছে না।
২. তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা: AI মাঝেমধ্যে ভুল তথ্য দিতে পারে, যা বিভ্রান্তিকর হতে পারে। AI কোথা থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে, সেটি নিশ্চিত হওয়া কঠিন। কখনো কখনো এটি ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিতে পারে, যার ফলে ব্যবহারকারীরা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
৩. কপিরাইট সমস্যা: অনেক ওয়েবসাইট তাদের প্রিমিয়াম কন্টেন্টকে সাবস্ক্রিপশন বা অর্থের বিনিময়ে প্রদান করে। কিন্তু যদি AI এই কন্টেন্ট সংগ্রহ করে বিনামূল্যে ব্যবহারকারীদের দেয়, তাহলে এটি নৈতিক ও আইনি প্রশ্ন তুলতে পারে। নিউজ এজেন্সি এবং প্রকাশকরা AI কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করছে যাতে তাদের কন্টেন্ট সুরক্ষিত থাকে।
৪. ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা: AI যদি ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে এবং ব্যবহার করে, তাহলে এটি ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তার জন্য হুমকি হতে পারে। অনেক কোম্পানি AI-এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীর আগ্রহ, অবস্থান এবং অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করছে, যা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন হতে পারে।
আমাদের ভবিষ্যৎ কী?
নিঃসন্দেহে, AI-ভিত্তিক অনুসন্ধান প্রযুক্তির উন্নতি আমাদের দৈনন্দিন জীবন সহজ করে তুলবে। সাধারণ প্রশ্নের জন্য লিংক না খুঁজে সরাসরি উত্তর পাওয়া অনেক সময় সাশ্রয় করবে। তবে এই পরিবর্তনের ফলে গবেষক, সাংবাদিক এবং কন্টেন্ট নির্মাতাদের নতুন কৌশল খুঁজে বের করতে হবে, যাতে তাদের কাজের মূল্য বজায় থাকে।
আমরা এমন এক যুগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে ইন্টারনেট অনুসন্ধান আর আগের মতো থাকবে না। তথ্য সংগ্রহের এই নতুন প্রক্রিয়াকে বোঝা ও যথাযথভাবে ব্যবহার করা আমাদের সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
ভবিষ্যতে, AI আরও শক্তিশালী হবে, যা কেবল তথ্য খোঁজার কাজই করবে না, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে প্রযুক্তির এই পরিবর্তন যেন মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যবহৃত হয়, সেটি নিশ্চিত করাও আমাদের দায়িত্ব।
Leave a comment