একবিংশ শতকের নিউরোপ্রযুক্তির বিস্ময়
২০২৫ সালের এক সকালে, যুক্তরাষ্ট্রের একটি নিউরোসার্জারি ক্লিনিকে ৬৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি ধীরপায়ে প্রবেশ করেন। তাঁর হাত কাঁপছে, মুখে অসহায়তা—এ যেন পারকিনসন রোগের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। কিন্তু কিছুদিন আগেও এমন ছিলেন না তিনি। তিনি একজন শিক্ষক ছিলেন, যিনি বোর্ডে লিখতেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা দিতেন। সেই স্বাধীনতা আজ যেন থেমে গেছে নিজের মস্তিষ্কের সাথে এক অবিরাম যুদ্ধের কারণে। তবে এই গল্পের বাঁক বদলেছে এক নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে—’অ্যাডাপটিভ ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন’ বা aDBS।
পারকিনসন (Parkinson’s disease) একটি প্রগ্রেসিভ নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ—অর্থাৎ এটি ধীরে ধীরে স্নায়ুতন্ত্রের কিছু অংশকে ক্ষয় করে দেয়। এতে মূলত মস্তিষ্কের বেসাল গ্যাংলিয়া নামক এক অঞ্চলের সংকেতচক্রে সমস্যা হয়, যেটি চলাফেরা ও মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে রোগীদের শরীরে অনিয়ন্ত্রিত কাঁপুনি, চলাচলে জড়তা, শরীর শক্ত হয়ে পড়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
এই সমস্যার পেছনে কাজ করে এক বিশেষ ধরণের সংকেতের গোলযোগ, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে Oscillopathy—অর্থাৎ মস্তিষ্কের তরঙ্গ সংকেতে অসামঞ্জস্যতা। গবেষণা বলছে, পারকিনসন রোগীদের ক্ষেত্রে এই সংকেত কখনো অস্বাভাবিকভাবে উচ্চমাত্রায় পৌঁছায়, যার ফলে হাত কাঁপা, মুখ কুঁচকে থাকা কিংবা শরীর স্থির হয়ে পড়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
প্রায় তিন দশক আগে বিজ্ঞানীরা একধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন—ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন (DBS)। এটি মূলত একধরনের ইমপ্ল্যান্টযোগ্য যন্ত্র যা মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অঞ্চলে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ পাঠিয়ে সমস্যাজনিত সংকেতগুলোর ভারসাম্য আনার চেষ্টা করে। তবে পুরোনো DBS যন্ত্রগুলো ছিল “স্ট্যাটিক”, অর্থাৎ একই রকম সংকেত সবসময় পাঠাতো, মস্তিষ্কের বাস্তব সংকেত ওঠানামার প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল ছিল না।
সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন অ্যাডাপটিভ ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন (adaptive DBS বা সংক্ষেপে aDBS)। এই প্রযুক্তিতে সংযুক্ত করা হয়েছে “ব্রেন রেডিও” নামক এক ক্ষুদ্র চিপ, যা মস্তিষ্কের তরঙ্গ শুনে তার ধরন অনুযায়ী ইলেকট্রিক সিগন্যালের মাত্রা কমায় বা বাড়ায়। এটি যেন মস্তিষ্কের একরকম লাইভ রেডিও সম্প্রচার, যা শুনে চিকিৎসা দেয়—এককথায়, মস্তিষ্কের সুরে সুর মেলায়।
এই প্রযুক্তির মূল উপাদান দুটি: প্রথমত, পাতলা একধরনের ইলেকট্রোড তার, যা মস্তিষ্কের গভীরে নির্দিষ্ট অঞ্চলে পৌঁছে বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠায়; দ্বিতীয়ত, এক ক্ষুদ্র চিপ, যা মস্তিষ্কের তরঙ্গের ওঠানামা বুঝে সংকেতের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন, যদি কোনো মুহূর্তে রোগীর মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক কম্পন ধরা পড়ে, তখন যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৈদ্যুতিক স্টিমুলেশন বাড়িয়ে দেয়, এবং বিপরীত পরিস্থিতিতে তা কমিয়ে আনে।
এই প্রযুক্তির বৈপ্লবিক দিক হলো—এটি রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী নিজে নিজেই সাড়া দেয়, প্রতিটি মুহূর্তে মস্তিষ্কের সাথে “সংলাপ” করে চলে। ফলে সাধারণ DBS-এর মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন—কণ্ঠস্বর দুর্বল হয়ে যাওয়া, হঠাৎ পড়ে যাওয়া, বা শরীরের অনিচ্ছাকৃত নড়াচড়া—এসবের আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়।
এখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১০ লাখ এবং ইউরোপে ১২ লাখ মানুষ পারকিনসন রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান না থাকলেও জনসংখ্যা ও চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় রোগীর সংখ্যা লক্ষাধিক বলে অনুমান করা হয়। দেশের জন্য এই প্রযুক্তি এখনও দূর ভবিষ্যতের বিষয় হলেও, বৈশ্বিক উদাহরণগুলোর দিকে তাকালে আশার আলো স্পষ্ট হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের Mayo Clinic এবং UCSF (University of California, San Francisco) বর্তমানে এই aDBS প্রযুক্তির উপর গভীর গবেষণা চালাচ্ছে। ব্রিটেনে Oxford এবং জার্মানির Freiburg বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রযুক্তির সফটওয়্যার অ্যালগরিদম এবং দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করছে। এই প্রযুক্তি কেবল পারকিনসন রোগেই সীমাবদ্ধ থাকবে না—Tourette’s Syndrome, Obsessive Compulsive Disorder (OCD), এমনকি ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রেও এর সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা চলছে।
তবে সব প্রযুক্তির মতো এটিও কিছু বিতর্কের মুখে পড়েছে। একদিকে যেমন রোগীদের কাছে এটি এক আশীর্বাদ, অন্যদিকে প্রশ্ন উঠছে—একটি যন্ত্র সারাজীবন মস্তিষ্কে যুক্ত থাকা কি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য? এর মাধ্যমে কি আমরা মস্তিষ্ককে “নিয়ন্ত্রণ” করতে যাচ্ছি? এছাড়া এই যন্ত্রের খরচ অনেক বেশি—একটি ইমপ্ল্যান্টের খরচ ৩০,০০০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে, যা উন্নয়নশীল দেশের রোগীদের জন্য প্রায় অসম্ভব।
তবুও আশার কথা এই যে, প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে খরচ কমবে এবং কার্যকারিতা আরও বাড়বে। গবেষকরা বলছেন, আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে এই প্রযুক্তি আরও “মিনি” হবে, তারবিহীন হবে, এবং রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যাবে—যেমন কোনো ব্যক্তি পারকিনসনের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে, aDBS চিপ তা আগেই শনাক্ত করে সঙ্কেত দিতে পারবে।
পারকিনসনের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি যেন এক আধুনিক বাঁশির সুর, যা রোগীর দেহে এক নতুন ছন্দ এনে দিতে পারে। আজ যেটি গবেষণাগারে, কাল সেটি হতে পারে এক সাধারণ মানুষের মুক্তির চাবিকাঠি। যদি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এই প্রযুক্তির গবেষণা ও চিকিৎসার সুযোগ উন্মুক্ত করতে পারে, তবে একদিন আমাদের নিজস্ব ‘ব্রেন রেডিও’ও হয়তো সুর তুলবে পারকিনসনের প্রতিরোধে।
এই যুগান্তকারী চিকিৎসা যেন শুধু চিকিৎসকদের নয়, আমাদের সকলের এক সম্মিলিত সংগ্রাম—মস্তিষ্ককে বুঝে, তাকে বন্ধু করে তোলার এক নতুন অধ্যায়।

Leave a comment