জৈব কৃষি এবং আমাদের প্রত্যাশা

জৈব কৃষি একটি বাস্তবসম্মত পদ্ধতি যা আজকের অর্থনীতির তুলনায় আগামীকালের বাস্তুসংস্থানকে আরো গুরুত্বপূর্ণ বলে উপলব্ধি করে। এর মূল উদ্দেশ্য কৃষি-পরিবেশের প্রাকৃতিক অবস্থা থেকে শিক্ষা নেয়া । জৈব কৃষি হলো এমন একটি উৎপাদন ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে বাস্তুবিদ্যার বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রাকৃতিক জৈবিক প্রক্রিয়াচর্চার আধুনিক বিজ্ঞান ও সনাতন জ্ঞানের মধ্যে সুন্দর একটি যোগসূত্র স্থাপন। প্রকৃতপক্ষে জৈব চাষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল যে ফসল উৎপাদনের বর্তমান পর্যায়ে টিকে থাকতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে যথেষ্ট জৈব  সার না পাওয়া  । জৈব পদার্থের প্রতিযোগিতামূলক ব্যবহার যেমন গার্হস্থ্য রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হয়। বেশীরভাগ ফসলের অবশিষ্টাংশগুলি বার্ন করে দেওয়া হয়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে যদি আপনি সত্যিই জৈবিক কৃষি প্রতিষ্ঠা করতে চান তবে আপনাকে জৈব সার কারখানা, জৈব-ইনোকুলান্টস, জৈবপদার্থ পুনর্ব্যবহার, জৈব ভিত্তিক ঐতিহ্যগত প্রচলন, রোগের জন্য জৈব নিয়ন্ত্রণ এজেন্ট, কীটপতঙ্গ এবং নিম্যাটোড ম্যানেজমেন্ট, পরিবেশের অনুকূল  বিকল্প প্রযুক্তির প্রয়োজন। । প্রকৃতপক্ষে বর্তমান পরিস্থিতিতে জৈব কৃষিজাত বস্তুর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা কৃষকের পক্ষে সম্ভব নয়।বর্তমান সময়ে আপনি আপনার দেশের মানুষকে খাওয়ানোর জন্য জৈব চাষে সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে পারবেন না। কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ সঙ্গে উচ্চ কারিগরি জৈব প্রযুক্তি বিকাশ আছে। জৈব চাষের নিকেস চিহ্নিত করা প্রয়োজন। ফসলের অবশিষ্টাংশ  সম্পূর্ণভাবে ব্যাবহার করা উচিত। কৃষকদের মানসিকতা পরিবর্তন করার জন্য এক্সটেনশনের প্রচেষ্টার সংস্করণে খামারের অবশিষ্টাংশ এবং বর্জ্য  পুনঃব্যবহার / দ্রুত কম্পোস্টিংয়ের জন্য সম্ভাব্য প্রযুক্তির প্রয়োজন।

বর্তমান ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে, জৈব কৃষিই সমাধান

সদস্য ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর অর্গানিক এগ্রিকালচার মুভমেন্ট (আইএফওএএম) সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ জৈব কৃষি নেটওয়ার্ক (বিওএএন)

পেশাগত ক্যারিয়ারের সূচনা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বারি)। দেশের জৈব কৃষি আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখা শুরু সেখান থেকেই। এখানে জৈব কৃষি গবেষক হিসেবে কাজ করছেন বিভিন্ন সংগঠনে। জৈব কৃষি গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এরই মধ্যে এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর অর্গানিক ফার্মিং টেকনোলজির (আনসপ্ট) প্রধান অনুসন্ধানকারী ও ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর অর্গানিক এগ্রিকালচার মুভমেন্টের (আইএফওএএম) সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। টেকনোলজি ইনোভেশন প্লাটফর্ম অব আইএফওএএমের কার্যকরী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছাড়াও বাংলাদেশ জৈব কৃষি নেটওয়ার্কের (বিওএএন) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বর্তমানে বারির আদর্শ জৈব কৃষি গ্রাম কর্মসূচি বাস্তবায়নে সচেষ্ট রয়েছেন। একই সঙ্গে সেখানে সামাজিক প্রত্যয়ন ব্যবস্থা (পিজিএস) নিয়ে কাজ করছেন। দেশে অর্গানিক পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন সম্ভাবনা এবং প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সম্প্রতি আলাপ করেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন সাইদ শাহীন—

অর্গানিক খাদ্য নিয়ে কেন এত আগ্রহ তৈরি হচ্ছে?

গত শতকে শুরু হওয়া পেট্রোলিয়ামনির্ভর চাষ ব্যবস্থায় উৎপাদিত খাদ্যই আজ আমাদের নানা রকম রোগব্যাধি ও প্রাণনাশের বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের দেহের পুষ্টিচাহিদা মেটানোর জন্য প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ দানাদার খাদ্য, শাকসবজি ও ফলমূলসহ সুষম খাদ্য গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু আমরা খাদ্য গ্রহণের নামে প্রতিদিন জেনে বা না জেনে বিষ সেবন করে চলেছি। চালে ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, শাকসবজি, ফলমূলসহ এসব খাদ্যে উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে মেশানো হচ্ছে নানাবিধ বিষাক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক দ্রব্য। আধুনিক জাতের উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ও জিএম শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসল ও ফলমূল উৎপাদন করতে গিয়ে দফায় দফায় প্রয়োগ করা হচ্ছে বিষাক্ত কীটনাশক, মাকড়নাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক ইত্যাদি। সবজিতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগের পর পরই বাজারে বিক্রি করা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিত্য ঘটনা। খাদ্যের সঙ্গে এসব আমাদের দেহে ঢুকছে। আবার এসব শাকসবজি ও ফলমূল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ ও পাকানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কার্বাইডসহ নানাবিধ বিষাক্ত পদার্থ। মাছ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহূত হচ্ছে বিষাক্ত ফরমালিন। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য শাকসবজি ও ফলমূলে মেশানো হচ্ছে নানা বিষাক্ত রঞ্জক। এসব ফলে খেয়ে একদিকে যেমন আমাদের দেহে নানাবিধ রোগব্যাধি দেখা দিচ্ছে, অন্যদিকে জীবনী শক্তি ও আয়ুষ্কালও কমে যাচ্ছে।

অর্গানিক ফুড বা পণ্য প্রডাক্ট বলতে আসলে কী বোঝায়?

সাধারণভাবে জৈব খাবার অথবা অর্গানিক ফুড বা প্রডাক্ট বলতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই অর্থাৎ জৈব উপায়ে উৎপাদিত খাবারকেই বোঝায়। জৈব কৃষি হলো এমন একটি উৎপাদন ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে বাস্তুবিদ্যার বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রাকৃতিক জৈবিক প্রক্রিয়াচর্চার আধুনিক বিজ্ঞান ও সনাতন জ্ঞানের মধ্যে সুন্দর একটি যোগসূত্র স্থাপিত হয়। জৈব কৃষিতে হয়। অথচ প্রচলিত চাষ ব্যবস্থা কৃত্রিম বালাইনাশক ও পানিতে দ্রবণীয় রাসায়নিক সারের কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে করা হয়। ফলে জৈব কৃষিকে প্রচলিত কৃত্রিম বালাইনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহারকেন্দ্রিক কৃষির মানদণ্ডে বিচার করা সমীচীন হবে না। আধুনিক জৈব কৃষির প্রয়োগ পদ্ধতি স্বাস্থ্য, পরিবেশ, স্বচ্ছতা ও তদারকি বা যত্ন এ চারটি নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রতিটি নীতি একটি আরেকটির ওপর নির্ভরশীল এবং এটি অনুসরণের মাধ্যমে জৈব কৃষিকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করা সম্ভব। জৈব খাদ্য যে বেশি নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ, তা অসংখ্য গবেষণায় প্রমাণিত।

দেশে এটি কীভাবে সম্প্রসারণ হচ্ছে?

ষাটের দশকের আগে অর্থাৎ বর্তমান রাসায়নিক ব্যবস্থা চালুর আগে পুরো কৃষি ব্যবস্থা ছিল জৈব কৃষি। বর্তমানে দুভাবে এ ব্যবস্থা চালু আছে। প্রথমটি হলো, মানুষ নিজের খাদ্য, বিশেষ করে ফল ও সবজি বাড়ির আঙিনায় নিজ ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন করছে। আরেকটি হলো, সংগঠিত আকারে ব্যবসা করার জন্য বাণিজ্যিক চাষ। যেমন কেকেটিই বতর্মানে পঞ্চগড়ে তার নিজস্ব বাগানে বাণিজ্যকভাবে চাসহ অন্যান্য দ্রব্যাদি উৎপাদন করে দেশে ও দেশের বাইরে (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন) বিক্রি করছে। আধুনিক জৈবপণ্যে তৃতীয় পক্ষের সার্টিফিকেট প্রয়োজন পড়ে, যা কেকেটিই অনুসরণ করছে। দেশে বর্তমানে জৈব চিংড়ি উপাদন হচ্ছে এবং তা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইইউ, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ভারতে রফতানি হচ্ছে। এছাড়া দেশে কিছু অঞ্চলে চাষীরা নিজ উদ্যোগে উৎপাদন ও বিপণন করছে। ঝিনাইদহ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, দিনাজপুর, টাঙ্গাইল, পাবনা, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, সিলেট, গাজীপুর জেলায় এ ধরনের কর্মকাণ্ড হচ্ছে তৃতীয় পক্ষের সার্টিফিকেশন ছাড়াই। এছাড়া আমাদের বাড়ির আঙিনায় উৎপাদিত সব পণ্যই জৈবপণ্য। বাংলাদেশের বেশকিছু সংগঠন স্বাধীনতার পর থেকে এ নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে প্রশিকা ও উবিনীগ অন্যতম। বর্তমানে উন্নয়নধারা, হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড, অ্যাকশনএইড, রাজশাহী কৃষি পাঠাগার, বারসিক, এএলআরডি, কারিতাস জৈব বা টেকসই কৃষি নিয়ে কাজ করছে।

সরকারি সংস্থা কি অর্গানিক খাদ্য উৎপাদনে এগিয়ে এসেছে?

খাদ্য উৎপাদনে বিষের প্রয়োগ ভয়াবহ রকমে বেড়েছে। এর ফলে জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ক্রমে জৈব কৃষি চাষাবাদের দিকে যেতেই হবে। আমরা ৪০ বছর ধরে বিষ প্রয়োগ করে মাটির উপকারী অণুজীবগুলো মেরে ফেলেছি। সেটিকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হওয়ায় প্রাকৃতিক কৃষি চাষবাসের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে তাপমাত্রা কখনো মাইনাসের নিচে নামে না। ফলে সারা বছর প্রকৃতিতে জৈব উপাদন থাকে। গাছপালাও পুষ্ট হয়, প্রকৃতিও সতেজ ও সবুজ থাকে। এ আবহাওয়াকে কাজে লাগিয়ে ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক চাষবাস করা যেতে পারে, যা সারা বিশ্বে মডেল হতে পারে। বিশ্বজুড়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জৈব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে জৈব কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনে আইএফওএএম বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সহায়তা করবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করছে না। তবে মাটির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি ও পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে সমন্বিত উদ্ভিদ পুষ্টি পদ্ধতি, জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি ও আইপিএম পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক কাজ করছে। বারির প্রধানতম কাজ হলো মানুষের চাহিদা অনুযায়ী গবেষণা ও উন্নয়ন কাজ করা। সে লক্ষ্যে বারির সবজি বিভাগ ২০০৬ সাল থেকে গবেষণা করছে। এরই মধ্যে বারি একটি স্ট্যান্ডার্ড ও অংশগ্রহণমূলক নিশ্চয়তা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। এছাড়া জৈব কৃষি নিয়ে কাজ করে এমন গবেষক, সম্প্রসারণকর্মী, প্রতিষ্ঠান নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে, যা বাংলাদেশ জৈব কৃষি নেটওয়ার্ক নামে পরিচিত। বারি জৈব কৃষি উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে, যা কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ হচ্ছে। জৈব কৃষির প্রাণ হলো স্থানীয় জ্ঞান। বারি এসব স্থানীয় জ্ঞান সংগ্রহ করছে ও অন্যান্য সুবিধাভোগীর সঙ্গে এ নিয়ে সমন্বয়ের জন্য নিয়মিত কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের কাজ করছে। বারি কৃষকদের মধ্যে প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য আদর্শ জৈব গ্রাম কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এ পর্যন্ত নেত্রকোনা,      ময়মনসিংহ ও ধামরাইয়ের তিনটি গ্রামে এ নিয়ে কাজ হচ্ছে। সেখানে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

দেশে অর্গানিক ফুডের ভবিষ্যৎ কী?

দেশে অর্গানিক ফুডের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং উৎপাদনও হচ্ছে। তবে অর্গানিক ফুড নিয়ে কিছু ভুল ধারণা আছে। কেউ কেউ না জেনে উৎপাদন কম, দাম বেশি— এমন প্রচারণা করে থাকেন। নিরাপদ খাবার কে না চায় বা কার প্রয়োজন নেই? দেশের সব শ্রেণীর জনগণই জানে, জৈব খাবার নিরাপদ। বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত। দেশে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগে উৎপাদনকে গুরুত্ব দেয়া হয়। পাশাপাশি জৈব উৎপাদনকে অবজ্ঞা বা নিরুৎসাহিত করা হয়। গত ৬০ বছরে এ-সংক্রান্ত কোনো গবেষণা করা হয়নি। বর্তমান পদ্ধতি ‘বেশি উপকরণ দাও, বেশি উৎপাদন করো’ এমন মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এতে মাটি ও পরিবেশ এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বর্তমান পদ্ধতির সমর্থকরাও এ কথা বলছেন। কিন্তু বিকল্প কী? বিকল্পের কথা সেভাবে আসছে না। আবার জৈব কৃষির কথা কেউ কেউ বলছেন, কিন্তু নীরবে। আমার বক্তব্য পরিষ্কার। বর্তমান ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে, জৈব কৃষিই সমাধান। তবে রাতারাতি সারা দেশে জৈব কৃষি প্রবর্তন কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়। এর জন্য প্রস্তুতি দরকার। ফলে কৌশলগত উদ্যোগ নিতে হবে।

জৈব কৃষির মাধ্যমে খাদ্যচাহিদা পূরণ করা সম্ভব?

জৈব কৃষি একটি সচল ও গতিশীল পদ্ধতি। এটি স্থবির নয় এবং অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাহিদার মুখে নব নব উদ্ভাবনার ভিত্তিতে টিকে থাকে। ফলে বর্তমান প্রযুক্তি হয়তো বাদ পড়ে যাবে বা পরিশীলিত হবে এবং প্রয়োজনে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করা হবে। খাদ্য জোগানের হাতিয়ার কৃষি এবং এ কৃষি কী পদ্ধতিতে চলবে, এখন তা নির্ধারণের সময় এসেছে। সতিকার অর্থে তা অবশ্যই জৈব উপায়ে পরিচালিত হতে হবে। এ দেশের কৃষি ও কৃষক যে সংকট মোকাবেলা করছে, তা নিরসনের পাশাপাশি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন একটি স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান দেয়া জৈব কৃষির পক্ষে আদৌ সম্ভব কিনা, তা নিয়ে দেশের নীতিনির্ধারক মহল থেকে শুরু করে অনেকের মধ্যেই যথেষ্ট সন্দেহ লক্ষ করা যায়। এ বিষয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উঠে আসা বিশেষজ্ঞদের অভিব্যক্তি প্রণিধানযোগ্য। সেখানে বলা হয়েছে, জৈব কৃষি সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম। বিজ্ঞানীরা সাম্প্রতিক কালে একটি তাত্ত্বিক মডেল দিয়েছেন। এতে দেখানো হয়েছে, এ মডেলের ব্যবহার দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ও ফলন না বাড়িয়েই শুধু জৈব কৃষির মাধ্যমেই বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য দৈনিক ২ হাজার ৬৪০ থেকে ৪ হাজার ৩৮০ কিলোক্যালরি খাদ্য জোগান দেয়া সম্ভব।

জৈব কৃষি টিকে থাকার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কী?

জৈব কৃষি মাটি, উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার পাশাপাশি এর উন্নয়নকে একক ও অবিভাজ্য হিসেবে বিবেচনা করে। জৈব কৃষির এ নীতিটি জৈব কৃষি ব্যবস্থার মূলভিত্তি। মাটির ক্ষুদ্র অণুজীব থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত সব জীবিত সিস্টেমের অংশ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। যদিও তারা আলাদা সত্তা, কিন্তু তারা একত্রে আরো একটি একক পরিমণ্ডল তৈরি করে। জৈব কৃষি সমন্বিতভাবে লিভিং সিস্টেমকে গুরুত্ব দেয়। স্বাস্থ্য হলো শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণ। শুধু রোগবালাই বা পীড়া থেকে মুক্ত থাকা নয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা লিভিং সিস্টেমকে সচল রাখার জন্য খাদ্য ও প্রয়োজনীয় শক্তিকে সংগ্রহ ও বিতরণ করে। স্বনিয়ন্ত্রণ ও দ্রুত পুনরুদ্ধার এ প্রক্রিয়ার মূল বৈশিষ্ট্য। পেট্রোলিয়াম নিয়ন্ত্রিত বর্তমান কৃষি শুধু খাদ্য উৎপাদনকে প্রাধান্য দেয় এবং প্রকৃতির অন্য উপাদানগুলোকে কার্যকরী রাখার ওপর গুরুত্ব দেয় না। গত ১০০ বছরে পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের দুরবস্থার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। জৈব কৃষির মূলনীতিটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিলে বর্তমান ব্যবস্থার উন্নতি হবে।

যেমন ধরা যাক মাটির স্বাস্থ্যের কথা। মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুণকে সমানভাবে বিবেচনায় আনতে হয়। অথচ গত ১০০ বছরের তথাকথিত আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় শুধু রাসায়নিক গুণাগুণ বিবেচনায় জমিতে জৈব সারের ব্যবহার কমিয়ে রাসায়নিক সার ব্যবহারের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হয়েছে। অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগে মাটির অণুজৈবিক বাস্তুসংস্থান ভেঙে গেছে। একটা কৃষিজমিতে প্রায় তিন টন অণুজীব বাস করে এবং সেখানে তাদের জীবত্কাল শেষ করে আবার পুনরুৎপাদিত হয়। এভাবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এদের কার্যক্রম পরিচালিত হলে মাটিতে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি পড়ে না। গাছের পুষ্টির জন্য এ পর্যন্ত ১৬-১৭টি উপাদানকে চিহ্নিত করা গেছে, যার মাত্র তিনটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে প্রয়োগ করা হয়। আবার তিনটি উপাদানের মধ্যে শুধু নাইট্রোজেনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। অথচ মাটিতে প্রয়োগকৃত প্রতি ১০০ কেজি রাসায়নিক নাইট্রোজেনের মধ্যে গাছ মাত্র ২৭-৩০ কেজি ব্যবহার করতে পারে। বাকি রাসায়নিক পদার্থ পানির সঙ্গে ধুয়ে বা গ্যাস আকারে নষ্ট হয়। অন্যদিকে এর অতিরিক্ত প্রয়োগে ফসলের ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি অণুজৈবিক কার্যক্রমও নষ্ট হয়ে যায়।

অথচ সেই নাইট্রোজেন জৈব উৎস থেকে প্রয়োগ করা হলে গাছ সেখান থেকে তার প্রয়োজনীয় পরিমাণ গ্রহণ করে এবং অতিরিক্ত অংশ জমিতে হিউমাস আকারে থাকে, যা আবার পরবর্তী ফসলে খাবার জোগায়। আবার মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক কার্যক্রমও উন্নত করে। মাটিতে নাইট্রোজেন বৃদ্ধির জন্য নানাবিধ ফসল রয়েছে, যা উৎপাদন তালিকায় সংযুক্ত করা যেতে পারে। আমাদের কৃষকরা জানেনই না, কোন কোন জৈব উেস নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি এবং কীভাবে তা মাটিতে প্রয়োগ করে তার দক্ষতা বাড়ানো যায়। চাষীদের কী দোষ, গত সাত-আট দশকে খাদ্য উৎপাদন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যেসব আধুনিক জাত উদ্ভাবন হয়েছে, তার অধিকাংশই উচ্চমাত্রায় এক্সটারনাল ইনপুটখেকো জাত। যাদের থেকে বেশি ফলন পেতে হলে বেশি পরিমাণে রাসায়নিক সার, ও একে পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই কীটনাশক লাগবে। ফলে হয়তো ফলন বেড়েছে, কিন্তু মাটি, মানুষ ও পরিবেশের স্বাস্থ্য বিনষ্ট হওয়া অব্যাহত আছে। এখন গবেষণা চিন্তার গতিধারা পরিবর্তনে গুরুত্ব দেয়া দরকার। কম এক্সটারনাল ইনপুট লাগে, কিন্তু ফলনের তারতম্য নেই, এমন জাতের উদ্ভাবন করতে হবে। প্রকৃতিতে এমন জিন আছে, এগুলো চিহ্নিত করা জরুরি। উন্নত বিশ্বে এ নিয়ে গবেষণা চলছে। আমাদেরও সে পথে অগ্রসর হতে হবে। পাশাপাশি ফসলের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের জৈব উৎস চিহ্নিত করে চাষী পর্যায়ে বিস্তার প্রয়োজন।

অর্গানিক বলতে কী কীটনাশকের বিরোধিতা করা হচ্ছে?

যদি বালাইনাশক ভালো হয়, তবে আমরা এর বিপক্ষে বলব কেন? বালাইনাশক যে ক্ষতিকর, তা পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত। তাছাড়া আমরা বহুমাত্রিক ফসল বাদ দিয়ে একমাত্রিক ফসলের দিকে ঝুঁকছি। ফলে কয়েকটি ফসল অতিমাত্রায় উৎপাদন করা হচ্ছে। অন্য ফসল গুরুত্ব হারিয়ে বিলুপ্ত হচ্ছে। প্রচলিত কৃষি মাটিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে এর উর্বরাশক্তি নষ্ট করেছে। ১০ হাজার বছরের কৃষিতে ৯ হাজার ৯০০ বছরে মাটির জৈব পদার্থ ৫ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশে নেমে এসেছিল। গত ১০০ বছরে তা আরো কমিয়ে আধা থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে প্রচলিত বর্তমান কৃষি ব্যবস্থা। তাহলে উপায় কী? নিশ্চয়ই জৈব কৃষি। কারণ জৈব কৃষি বহুমাত্রিক ফসলের কথা বলে, মাটির প্রাণ ও জৈব পদার্থ বৃদ্ধির উপায় দেয়। খাদ্যকে নিরাপদ করার পাশাপাশি পরিবেশ ভালো রাখে ও কার্বন সংবন্ধন করে। ফলে শুধু কীটনাশকের বিরোধিতার জন্য নয়, মানবসভ্যতাকে স্বাভাবিক নিয়মে টিকিয়ে থাকার জন্যও জৈব খাদ্য জরুরি।

 

 

About salmaAkter

Check Also

গবেষণাপত্র: Increasing homestead Production through Microfinance

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রবলচাপের ফলে প্রতিবছর ১% করে কৃষি জমি কমছে। আবাসন ব্যবস্থাপনার জন্য উজাড় হচ্ছে …

ফেসবুক কমেন্ট


  1. মরিচ গাছের গড়া পচা রোগের সমাধান কি?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।