সাধারণ বিজ্ঞানস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

স্বপ্ন কি বয়সের সঙ্গে পাল্টায়?

Share
Share

শিশুর ঘুমে দানব লুকিয়ে থাকে—আমরা এমনটা ভাবি। আর বড় হলে স্বপ্নে ঢুকে পড়ে পরীক্ষার হল, অফিসের ডেডলাইন, অথবা জীবনের অমীমাংসিত চাপ। কিন্তু এই জনপ্রিয় ধারণার পেছনে কি কোনো বৈজ্ঞানিক সত্য আছে? বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বপ্ন কি সত্যিই বদলায়, নাকি আমরা শুধু বদলে যাই—আর সেই বদলে যাওয়াটাই স্বপ্নের রঙ পাল্টে দেয়?

স্বপ্নের বিষয়টি বিজ্ঞানীদের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই রহস্যময়। কারণ স্বপ্ন ধরার মতো কোনো যন্ত্র নেই; আছে শুধু জেগে ওঠার পর মানুষের বর্ণনা। তবু ইতালির লুকা শহরের ইএমটি স্কুলের ঘুম গবেষক ড. জুলিও বার্নার্দির মতো বিজ্ঞানীরা বলেন, স্বপ্ন নির্ভর করে কল্পনা, স্মৃতি ও আবেগের স্নায়ুতন্ত্রের ওপর—যেগুলো সারাজীবন ধরে গড়ে ওঠে, পরিণত হয়, আবার বদলাতেও থাকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বয়সের ভেদে স্বপ্নের রূপান্তর নিয়ে খুব বেশি পদ্ধতিগত গবেষণা হয়নি। তবু যেগুলো হয়েছে, সেগুলো একটি পরিস্কার ইঙ্গিত দেয়—শিশু, তরুণ, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ বয়সে স্বপ্ন কেবল আলাদা নয়, মানুষের অন্তর্জগতের মানচিত্রও তাতে বদলে যায়।

একটি ব্যাখ্যা বহুদিন ধরেই জনপ্রিয়, যাকে বলা হয় “ধারাবাহিকতা-অনুমান।” এর কথা, স্বপ্ন হলো জেগে থাকা জীবনের প্রতিবিম্ব। ছুটির আনন্দে ডুবে থাকলে ঘুমে ভাসে সমুদ্র আর বালির দৃশ্য, পরীক্ষার আগে হলে ঘুম ঢাকে পড়ার টেবিল। এই ধারণায় কিছু সত্য আছে। কিন্তু এটি এই প্রশ্নের পুরো উত্তর দেয় না—কেন বয়স বাড়লে স্বপ্নের রং, গতি আর আবেগের তীব্রতা বদলায়?

শৈশবের স্বপ্ন নিয়ে পথপ্রদর্শক গবেষণা করেছিলেন ডেভিড ফাউল্কস। তাঁর কাজ দেখায়, ছোটদের স্বপ্ন তুলনামূলক সরল। সেখানে থাকে খেলনা, পশু-পাখি, স্থির বস্তু, ছোটখাটো ঘটনা। শিশুরা সাধারণত নিজেরা স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু হয় না, বরং দর্শকের মতো ঘটনাগুলো দেখে যায়। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ এই বয়সে মস্তিষ্কের কল্পনাশক্তি, আত্মজ্ঞান ও ভাষার দক্ষতা এখনও তৈরি হওয়ার পথে। আবার শিশু স্বপ্ন বর্ণনা কীভাবে করবে—এ বিষয়টি তার শব্দভাণ্ডার আর বোঝাপড়ার ওপরও নির্ভর করে। তাই শিশুর স্বপ্নের গবেষণা মানেই একরকম দোভাষীর কাজ: শিশুর অভিজ্ঞতার ভাষ্যকে বিজ্ঞানের ভাষায় অনুবাদ করা।

কৈশোরে এসে দৃশ্যপট দ্রুত বদলায়। এই বয়সে হরমোনের ঢেউ, সামাজিক পরিচয়ের টানাপড়েন, ভবিষ্যৎ নিয়ে দোলাচল—সব মিলিয়ে স্বপ্ন হয়ে ওঠে উজ্জ্বল, তীব্র, কখনো ভয়ংকর। ছোট কিশোরদের ঘুমে তাড়া খাওয়া, পড়ে যাওয়া, অদ্ভুত প্রাণীর দেখা পাওয়ার মতো দৃশ্য বেশি। বড় কিশোরদের স্বপ্নে ঢোকে নতুন সম্পর্কের উৎকণ্ঠা, পড়াশোনার চাপ, আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন। কৈশোরের আগ্রাসন ধীরে ধীরে স্বপ্নেও ফুটে ওঠে, আবার সেই আগ্রাসন বয়সের সঙ্গে নতুন রূপও নেয়—যেমন, নিজের সীমা পরীক্ষা বা অন্যের প্রত্যাশার ভার।

প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে স্বপ্নের নাটকীয়তা কমে না, কিন্তু বদলায় তার ধরন। গবেষণায় দেখা যায়, এই বয়সে মানুষের স্বপ্নে প্রায়শই ফিরে আসে একটি থিম—কোথাও দেরিতে পৌঁছানো, বারবার একই কাজ করার চেষ্টা। বিচিত্রতা থেকে বেশি জায়গা নেয় অভ্যস্ততার পুনরাবৃত্তি। বাস্তব জীবনের দায়িত্বের মতোই স্বপ্নেও ঢুকে পড়ে দৈনন্দিনতার অনুষঙ্গ। বিচ্ছিন্ন দুঃস্বপ্ন থাকে, কিন্তু কৈশোরের তীব্রতা ফিকে হতে থাকে। এখানে স্বপ্ন আর বাস্তবের সেতু আরও শক্ত হয়—যেন ঘুম শুধু পালিয়ে যাওয়ার জায়গা নয়, বরং জেগে থাকা জীবনের অনুরণনকক্ষ।

বার্ধক্যে এসে মানুষ প্রায়শই বলে—স্বপ্ন কমে গেছে। কেউ কেউ বলেন “সাদা স্বপ্ন”-এর কথা, যেখানে স্বপ্নের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, কিন্তু গল্পটি মনে পড়ে না। এর পেছনে একটি বড় কারণ ঘুমের মানের অবনতি। বয়স বাড়লে ঘুম হালকা হয়, ভাঙে বেশি। কিন্তু এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কাজ করে—স্মৃতির ধরন বদলে যায়। জার্মানির সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ-এর গবেষক মাইকেল শ্রেডল বলেন, আমরা যা পাই তা “স্বপ্ন” নয়, বরং স্বপ্নের স্মৃতিচারণ। তাই স্বপ্নের প্রকৃতি যতটা বদলায়, তার চেয়ে বেশি বদলায় আমরা সেটি মনে রাখার ক্ষমতা।

জীবনের শেষ প্রান্তে স্বপ্ন আবার অন্য এক রূপ নেয়। 호স্পিসের রোগীদের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, এই সময়ে মানুষ প্রিয়জনের দেখা পায় স্বপ্নে, দেখে যাত্রার প্রস্তুতি, গুছিয়ে নেওয়ার দৃশ্য। আশ্চর্য হলো—এই স্বপ্নগুলো ভয় জাগায় না, বরং সান্ত্বনা দেয়। যেন অবচেতন মন নিজস্ব ভাষায় বলছে, “সব ঠিক আছে।” জীবদ্দশার হিসাব-নিকাশ, ভালোবাসা আর বিদায়ের বেদনা—সব একসঙ্গে এসে শান্তির আবরণে ঢেকে দেয় ঘুমের শেষ পর্বগুলো।

তাহলে কি স্বপ্নের এই রূপান্তর কেবল বয়সের খেলা? না, এটি বয়সের সঙ্গে মস্তিষ্কের স্থাপত্যের বদলের গল্প। ঘুমের ধাপগুলো—বিশেষ করে র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট বা রেম ঘুম—বয়সের সঙ্গে পাল্টায়। স্মৃতির প্রক্রিয়াকরণ, আবেগের নিয়ন্ত্রণ, কল্পনার বিস্তার—সবই স্নায়ুতন্ত্রের পরিণতির সঙ্গে জড়িত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা শুধু নতুন স্মৃতি জমাই না, পুরনো স্মৃতিকে বাছাইও করি। সেই বাছাইয়ের ছাপ পড়ে স্বপ্নে।

এই জায়গায় শিক্ষার্থীদের জন্য স্বপ্নের বিজ্ঞান একটি অদ্ভুত শক্তিশালী পাঠ। কারণ এটি শেখায়, মানুষ একমাত্র প্রাণী যে নিজের জীবনকে গল্প হিসেবে অনুভব করতে পারে—জেগে আর ঘুমিয়ে উভয় অবস্থায়। স্বপ্ন কোনো ভৌতিক সিনেমা নয়; এটি আপনার মস্তিষ্কের নির্মাণশালা, যেখানে প্রতিদিন নতুন দৃশ্য নির্মিত হয়, পুরনো দৃশ্য পুনর্গঠিত হয়। বয়সের সঙ্গে সেই নির্মাণশালার স্থাপত্য পাল্টায়—কখনো রঙ কমে, কখনো গল্প জটিল হয়, কখনো আবেগ মোলায়েম হয়।

আমরা যদি স্বপ্নকে ভয় না পেয়ে কৌতূহলের চোখে দেখি, তাহলে এটি আমাদের শিক্ষা দেবে নিজেদের বুঝতে। কেন পরীক্ষার আগের রাতে একই স্বপ্ন ফিরে আসে? কেন জীবনের বড় সিদ্ধান্তের সময়ে ঘুম অস্থির? কেন বুড়ো বয়সে মানুষ পুরনো মানুষের মুখ দেখে? এগুলো কুসংস্কার নয়—এগুলো আমাদের মস্তিষ্কের ভাষা। এই ভাষা শিখতে পারলে, নিজের মনকে পড়তে শিখব।

শেষ পর্যন্ত একটি প্রশ্ন থেকেই যায়—স্বপ্ন কি বদলায়, না বদলাই আমরা? বিজ্ঞান বলছে—দুটোই। আর সেই দ্বৈত বদলের ভেতরে লুকিয়ে আছে মানুষের সবচেয়ে মানবিক বৈশিষ্ট্যটি: কাহিনি বানানোর ক্ষমতা। ছোটবেলার সরল গল্প থেকে বার্ধক্যের শান্ত উপসংহার—স্বপ্ন আমাদের জীবনের অদেখা আত্মজীবনী। ঘুমের ভেতরেই আমরা প্রতিদিন নিজের আরেকটি অধ্যায় লিখে ফেলি।

তথ্যসূত্র:
https://www.livescience.com/health/dreams/do-your-dreams-change-as-you-age

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org