অন্যান্যগবেষকদের জন্যে বইবই আলোচনা

নির্বিঘ্ন অনুসন্ধানের শিল্প: একজন গবেষকের পথচলা

Share
Share

নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ |
[email protected]

একজন শিক্ষার্থী যখন গবেষণার জগতে প্রথম প্রবেশ করে, তার চোখে গবেষণা অনেকটা ধোঁয়াশার মতো। কীভাবে শুরু করতে হবে, কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়, কোন তথ্যগুলো বিশ্বাসযোগ্য, কিংবা কীভাবে নিজের চিন্তাভাবনাকে একটি সুসংহত প্রবন্ধে রূপ দিতে হয়—এসব প্রশ্ন যেন একে অপরকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। “The Craft of Research” বইটি ঠিক এই জায়গায় এসে পথ দেখায়, আলো জ্বালে, এবং একজন নবীন গবেষককে পরিণত করে আত্মবিশ্বাসী চিন্তাশীল লেখকে।

ওয়েইন সি. বুথ, গ্রেগরি জি. কোলম্ব, এবং জোসেফ এম. উইলিয়ামসের যৌথ রচনা এই বইটি গবেষণাকে শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ বা বই পড়ার কাজ হিসেবে দেখে না। বরং এটি গবেষণাকে দেখে এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপচারিতা হিসেবে, যেখানে গবেষক একজন অংশগ্রহণকারী নাগরিক, যিনি কোনো বিষয়ে নতুন কিছু জানাতে, বোঝাতে বা বোঝাতে চেয়ে প্রশ্ন তোলেন। গবেষণার মূল চালিকাশক্তি যে ‘প্রশ্ন’, বইটি বারবার এই সত্যটিকে কেন্দ্র করে পাঠককে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করে।

বইটির শুরুতেই লেখকরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট করে দেন—গবেষণার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র উত্তর খোঁজা নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ প্রশ্ন তোলা। তারা বলেন,
“Good research starts with a problem you want to solve, not just a topic you want to cover.”
এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের দেশের গবেষণা চর্চায় এখনো খুব কম দেখা যায়, যেখানে প্রবন্ধের বিষয় ঠিক হয় একজন সুপারভাইজারের নির্দেশে, আর উদ্দেশ্য থাকে “কিছু একটা লিখে জমা দেওয়া”। অথচ এই বই জানিয়ে দেয়, একটি ভালো প্রশ্নই একটি ভালো গবেষণার প্রথম ধাপ।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘রিসার্চ মেথডোলজি’ নামের কিছু কোর্স থাকলেও, সেগুলোর মূল লক্ষ্য প্রায়ই সীমিত থাকে কিছু পরিভাষা শেখানো ও কিছু কাঠামো দেখিয়ে দেওয়া পর্যন্ত। সেখানে “The Craft of Research” বইটি এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এটি পাঠককে শেখায় কীভাবে একটি সাধারণ ধারণাকে ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা সমস্যায় রূপান্তরিত করা যায়, কীভাবে প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করতে হয়, এবং কীভাবে নিজস্ব অবস্থান যুক্তিসংগতভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়।

বইটির অন্যতম শক্তি হলো এর ভাষার সহজতা এবং পাঠকের সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনের ভঙ্গি। এটি কোনো বিদগ্ধ পণ্ডিতের দূরবর্তী নির্দেশনা নয়, বরং একজন সহপাঠীর মতো করে বলে—“তুমি এটা এভাবে ভেবে দেখতে পারো।” এই আত্মীকতার ভঙ্গিমা আমাদের দেশের তরুণদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ গবেষণার প্রতি ভয় ও অনীহার বড় কারণই হলো, বিষয়টিকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কঠিন মনে হওয়া।

গবেষণা শুধু তথ্য জড়ো করার কাজ নয়, বরং এটি একধরনের যুক্তিনির্মাণ—বইটির এই মূল বার্তাটি পাঠকের মধ্যে এক ধরণের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায়। একজন গবেষক কেবল তথ্য উপস্থাপন করেন না; তিনি সেই তথ্যের ভিত্তিতে নিজের মত গঠন করেন, এবং সেই মতকে প্রমাণ করতে প্রয়োগ করেন যুক্তি ও প্রমাণ। এই বই পাঠিয়ে দেয় সেই নির্মাণশিল্পের গভীরে—যেখানে প্রতিটি অনুচ্ছেদ, প্রতিটি রেফারেন্স, এমনকি প্রতিটি বাক্যও একটা বড় চিন্তার ভিতরকার কাঠামোর অংশ।

তবে গবেষণার আরেকটি বাস্তব চ্যালেঞ্জ হলো নিজের ভাবনাকে সুসংগঠিতভাবে তুলে ধরা—মানে, লেখা। এক্ষেত্রেও “The Craft of Research” দুর্দান্তভাবে সহায়তা করে। বইটির শেষাংশ গবেষণাপত্র লেখার কৌশল, সংগঠন, পাঠকের দৃষ্টিকোণ বিবেচনা, এমনকি ভাষার ধরন পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে। একজন লেখক কীভাবে পাঠকের সম্ভাব্য আপত্তি ভেবে নিজের যুক্তি প্রস্তুত করবেন, কিংবা কীভাবে তথ্যকে সাজিয়ে বক্তব্যকে বেশি কার্যকর করবেন—এসব দিক নির্দেশনাগুলো গবেষণাকে কেবল ‘জ্ঞান চর্চা’ না করে একধরনের ‘দর্শনচর্চা’তে পরিণত করে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ বইটির গুরুত্ব তাই দ্বিগুণ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার পরিমাণ বাড়লেও, গুণগত মান নিয়ে বহু প্রশ্ন আছে। অনেক ক্ষেত্রেই গবেষণা মানে হয়েছে তথ্যসংগ্রহ ও ‘পেপার সাবমিশন’, চিন্তার গভীরতা বা প্রশ্নের বিশ্লেষণ সেখানে অনুপস্থিত। সেই ঘাটতি পূরণে এমন একটি বই তরুণ গবেষকদের আত্মজিজ্ঞাসা করতে শেখায়—”আমি কী বলছি?” আর তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—”আমি কেন এটা বলছি?”

এই বইয়ের আরেকটি শক্তিশালী দিক হলো এর বহুমাত্রিক ব্যবহারযোগ্যতা। শুধু গবেষণা নয়—প্রবন্ধ লেখা, উপস্থাপনা তৈরি, এমনকি সাংবাদিকতা বা নীতিনির্ধারণের কাজেও এই বইয়ের প্রণালী কার্যকর। যেকোনো যুক্তিনির্ভর লেখালেখি বা চিন্তাভাবনার ভিত্তি হিসেবে এই বই একটি নির্ভরযোগ্য নকশা দিতে পারে। এমনকি একজন পাঠক যদি কোনো গবেষণা না-ও করেন, তবু এই বই তাঁকে চিন্তার শৃঙ্খলা ও আত্মসমালোচনার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

একটি উন্নত সমাজের ভিত্তি হলো তার চিন্তাশীল নাগরিক। আর চিন্তাশীল নাগরিক তৈরি হয় তখনই, যখন তারা শুধু তথ্য জানে না, বরং সেই তথ্যকে প্রশ্ন করে, বিশ্লেষণ করে, এবং তা থেকে নতুন জ্ঞান গড়ে তোলে। “The Craft of Research” ঠিক এই ধরণের নাগরিক গঠনে সহায়ক—যে নাগরিক নিজের চারপাশের জগৎকে প্রশ্ন করে, উত্তর খোঁজে, এবং সেই উত্তরকে অন্যের সঙ্গে যুক্তিপূর্ণভাবে ভাগ করে নেয়।

আমরা যদি চাই বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী গবেষণাভিত্তিক সংস্কৃতি গড়ে উঠুক, তবে কেবল গবেষণার পরিকাঠামো গড়ে তোলাই যথেষ্ট নয়। দরকার এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, যেখানে গবেষণা হবে কৌতূহল, অন্বেষণ ও আত্ম-নির্মাণের অংশ। “The Craft of Research” বইটি সেই পরিবর্তনের সূচনাবিন্দু হতে পারে—বিশেষ করে যখন আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের শেখাতে চাই, কীভাবে শুধু পড়তে নয়, বরং চিন্তা করতে হয়।

অতএব, গবেষণার পথিকদের জন্য এই বইটি কেবল একটি নির্দেশিকা নয়—এটি একটি মানসিক প্রস্তুতির হাতেখড়ি। একজন গবেষক, শিক্ষক, কিংবা যে কেউ যিনি যুক্তিসঙ্গত চিন্তার পথে হাঁটতে চান, তাঁর জন্য “The Craft of Research” যেন একটি নিঃশব্দ সঙ্গী, যিনি প্রতিটি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে বলেন—“চলো, এবার যুক্তি দিয়ে এগিয়ে চলি।”

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org