গবেষণায় হাতে খড়ি

সাস্টেইনেবল টেকনোলজি: পরিবেশ ও প্রকৌশলের সমন্বয়

Share
Share

ভোরের আলো ফুটতেই একটা নদীপাড়ের গ্রামে ছেলেটা হাঁটতে বের হয়। তার শৈশবের নদীটা আজ আর আগের মতো নেই—পানি ঘোলা, তলদেশে কালচে আস্তরণ। সে জানে না “ইন্ডাস্ট্রিয়াল পল্যুশন” কী, “কার্বন ফুটপ্রিন্ট” কাকে বলে। শুধু জানে, তার বাবার ছোট নৌকাটা এখন আর ঠিকমতো ভাসে না, মাছও আগের মতো ধরা পড়ে না। প্রকৃতি যেন ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। আর সেই দূরত্বের মাঝেই তার মাথায় প্রশ্ন জন্মায়—যে মানুষ পাহাড় কেটে শহর বানাতে পারে, সে কেন একটা নদী বাঁচাতে পারে না?

এই প্রশ্নটা শুধু একটা গ্রামের নয়, এই প্রশ্ন বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শহর, প্রতিটি নদী, প্রতিটি শিশুর চোখে লেখা থাকে। ঢাকার বাতাসে শ্বাস নেওয়া যেন এখন বিলাসিতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বায়ু দূষণ মাত্রা বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহরগুলোর একটি, যেখানে প্রতি বছর দশ হাজারের বেশি অকালমৃত্যু ঘটে শুধুমাত্র বাতাসের বিষে। বিশ্বব্যাংক বলছে, পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষতি জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ। সংখ্যা শুনতে হয়তো ভারী লাগে, কিন্তু এই সংখ্যার পেছনে লুকিয়ে আছে নষ্ট হওয়া ফুসফুস, শুকিয়ে যাওয়া জমি, আর হারিয়ে যাওয়া ভবিষ্যৎ।

ঠিক এই জায়গাতেই জন্ম নেয় সাস্টেইনেবল টেকনোলজি নামের এক নীরব বিদ্রোহ। এটা শুধু পরিবেশবাদীদের কান্না নয়, এটা প্রকৌশলীর নতুন শপথ। প্রযুক্তি কি কেবল বড় ফ্যাক্টরি বানানোর নাম, নাকি প্রযুক্তির কাজ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আজ বোস্টনের কোনো ল্যাবে, টোকিওর কোনো ওয়ার্কশপে, সিঙ্গাপুরের কোনো স্মার্ট সিটিতে জন্ম নিচ্ছে এমন সব প্রযুক্তি, যা বিদ্যুৎ বানায় রোদ থেকে, পানি পরিষ্কার করে ব্যাকটেরিয়া দিয়ে, আর প্লাস্টিক ভাঙে এনজাইম দিয়ে। আধুনিক বিজ্ঞান আজ আর কেবল শক্তিশালী হওয়ার স্বপ্ন দেখে না, সে স্বপ্ন দেখে টিকে থাকার।

ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, প্রকৌশল শুরু হয়েছিল মানুষের জীবন সহজ করতে, কিন্তু একসময় সেই সহজ করা জিনিসটাই পৃথিবীর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শিল্প বিপ্লব মানুষকে আলোকিত করেছিল, কিন্তু অন্ধকারও জমেছিল আকাশে। আজ সেই ভুল শুধরে নেওয়ার সময়। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, আমরা একই চিন্তায় বসে যে সমস্যার জন্ম দিয়েছি, সেই চিন্তায় বসে তার সমাধান হবে না। সাস্টেইনেবল টেকনোলজি সেই নতুন চিন্তারই নাম, যেখানে দক্ষতার সঙ্গে যুক্ত হয় দায়িত্ব।

বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এই ধারণা আর ফ্যাশন নয়, এটা বেঁচে থাকার কৌশল। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, গ্রাম গিলে খাচ্ছে নদী, শহর গ্রাস করছে কংক্রিট। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু হতে পারে। এই বাস্তবতায় প্রযুক্তি যদি পরিবেশকে উপেক্ষা করে, তবে উন্নয়ন আসলে ধ্বংসের আরেক নাম। কিন্তু যদি প্রযুক্তি প্রকৃতির বন্ধু হয়, তবে তা হতে পারে আশার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

আজ বাংলাদেশের কিছু তরুণ প্রকৌশলী সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে কাজ করছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে, কেউ বানাচ্ছেন কম খরচে পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র, কেউ ভাবছেন বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরির কথা। এগুলো ছোট উদ্যোগ মনে হলেও, আসলে এগুলো ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ব্লুপ্রিন্ট। সিঙ্গাপুর আজ পানি রিসাইক্লিং করে নিজের প্রয়োজনের বড় অংশ মেটায়, নেদারল্যান্ডস সমুদ্রের নিচে কৃষি করছে, জার্মানি তার বিদ্যুতের বড় অংশ নিচ্ছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। এরা শুধু ধনী দেশ নয়, এরা দূরদর্শী দেশ।

সাস্টেইনেবল টেকনোলজি মানে শুধু গাছ লাগানো নয়, মানে এমন যন্ত্র বানানো, যা কম বিদ্যুৎ খায়, এমন ঘর বানানো, যা গরমে নিজেই ঠাণ্ডা থাকে, এমন শহর বানানো, যেখানে মানুষ আর আকাশ একে অপরকে সহ্য করে না, ভালোবাসে। এই ভালোবাসা কোনো কবিতার লাইন নয়, এই ভালোবাসা গণিতের সূত্রে, প্রকৌশলের নকশায়, কোডের লাইনে লেখা থাকে।

তুমি যদি একজন শিক্ষার্থী হও, হয়তো ভাবছো, আমি কী করবো? আবার সেই প্রশ্ন, যা বড় স্বপ্নের সামনে ছোট মনে হয়। কিন্তু প্রতিটি বড় প্রযুক্তির শুরু হয়েছে একটুখানি অস্বস্তি থেকে। তুমি যেখানেই পড়ো না কেন, তোমার চারপাশের পরিবেশটাই তোমার গবেষণাগার হতে পারে। নদীর পানি পরীক্ষা করা, বিদ্যুৎ খরচ হিসাব করা, প্লাস্টিকের নতুন ব্যবহার ভাবা—এসবই বিজ্ঞান। আর এই বিজ্ঞানই একদিন তোমাকে পৃথিবীর কাছে দায়বদ্ধ নাগরিক বানাবে।

মেরি কুরি রেডিওঅ্যাক্টিভিটির রহস্য ভেদ করেছিলেন মানবকল্যাণের জন্য, চার্লস ডারউইন প্রকৃতিকে বুঝতে চেয়েছিলেন তাকে শাসন করতে নয়, আর আবদুস সালাম বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞান উন্নয়নশীল দেশের মুক্তির পথ। সেই পথ আজ অন্য মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, সেই মোড়ের নাম টেকসই উন্নয়ন। এখানে বিজ্ঞানী মানে শুধু আবিষ্কারক নয়, বিজ্ঞানী মানে রক্ষক।

গভীর রাতে যখন তুমি বইয়ের পাতা উল্টাও, হয়তো ভাবো, আমি কি একদিন সত্যিই কিছু বদলাতে পারবো? এই প্রশ্নটাই তোমাকে আলাদা করে। কারণ যে প্রশ্ন করে, সে-ই একদিন উত্তর খুঁজে। পৃথিবী আজ ক্লান্ত, বাতাস ভারী, নদী অসুখী। কিন্তু পৃথিবী এখনও বিশ্বাস করে মানুষের ওপর। আর সেই মানুষদেরই একজন তুমি।

হয়তো তুমি কোনোদিন বড় ল্যাবে কাজ করবে, হয়তো কোনো ছোট গ্রামে বসেই বদলে দেবে অনেক কিছু। জায়গাটা বড় না, তোমার দৃষ্টিটাই আসল। মনে রেখো, প্রকৌশল যদি তোমার হাত হয়, পরিবেশ হতে হবে তোমার হৃদয়। এই দুই একসঙ্গে না থাকলে, উন্নয়ন কেবল গতি, গন্তব্য নয়।

আজকের পৃথিবী তোমার কাছে খুব বেশি কিছু চায় না। চায় কেবল দায়বদ্ধতা। চায় এমন প্রজন্ম, যারা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করবে পৃথিবীকে জয়ের জন্য নয়, পৃথিবীর সঙ্গে বাঁচার জন্য। আর সেখানেই, নীরবে, জন্ম নেয় আগামী দিনের ইতিহাস।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org