নিউজ ডেস্ক, বিজ্ঞানী অর্গ |
বিজ্ঞান যখন আমাদের সামনে তার জটিল আবরণ খুলে দেয়, তখন আমরা অনেক সময়ই সেই আবিষ্কারের মানবিক দিকটা ভুলে যাই। পরীক্ষাগার, সূত্র, পরিসংখ্যান আর প্রযুক্তির স্তূপে ঢাকা পড়ে যায় আবিষ্কারের পেছনের মানুষগুলো—তাদের লড়াই, অনিশ্চয়তা, দ্বন্দ্ব, কিংবা স্বপ্ন। “The Double Helix” বইটি এই চেনা কাঠামো ভেঙে পাঠকদের সামনে এনেছে বিজ্ঞানচর্চার সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো, যেখানে আবিষ্কারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে প্রতিযোগিতা, সংকীর্ণতা, ভুল সিদ্ধান্ত, এবং কখনো কখনো নির্লজ্জ উৎসাহ।
জেমস ডি. ওয়াটসনের লেখা এই আত্মজৈবনিক গ্রন্থটি শুধু ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের কাহিনি নয়, বরং এটি একজন তরুণ বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা ১৯৫০-এর দশকের বিজ্ঞানজগতের প্রতিচ্ছবি। ডিএনএ সম্পর্কে আমরা আজ জানি যে এটি জীবনের মৌলিক নকশা, যার মধ্যেই নিহিত থাকে উত্তরসূরির জন্য প্রেরিত সমস্ত জৈবিক তথ্য। কিন্তু এই ধারণাটিকে যে কতটা জটিল পথ পেরিয়ে স্পষ্টভাবে স্থাপন করা হয়েছিল, তার পেছনের কাহিনিটিই এই বইয়ের মূল আকর্ষণ।
ওয়াটসনের বর্ণনায়, কেমব্রিজের ক্যাভেনডিশ ল্যাবরেটরির গবেষণাগার যেন একরকম নাট্যমঞ্চ, যেখানে প্রতিটি চরিত্র নিজ নিজ ভূমিকায় অভিনয় করছে—কখনো বন্ধুত্বের, কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার, আবার কখনো কৌশলের। ফ্রান্সিস ক্রিকের সঙ্গে তার অংশীদারিত্ব ছিল এক ধরণের সৃজনশীল অরাজকতা, যেখানে যুক্তির চেয়ে কখনো বেশি কাজ করেছে প্রবল কৌতূহল ও কল্পনা। তবে সেই সৃজনশীল দৌড় প্রতিবারই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে, যখন রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিনের মতো বিজ্ঞানীরা পদ্ধতিগত গবেষণায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন বিষয়টিকে।
বইটি পড়তে পড়তে পাঠক বুঝতে পারে যে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কখনো নিছক যুক্তির ধারাবাহিকতা নয়। বরং এটি এক ধরনের রোমাঞ্চকর অভিযান, যেখানে ভুল সিদ্ধান্ত, অপ্রত্যাশিত বাঁক, হঠাৎ প্রাপ্ত তথ্য, কিংবা অন্যের কাজ থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা—সবকিছু মিলেই গড়ে ওঠে চূড়ান্ত সাফল্যের কাঠামো। ডিএনএর ডাবল হেলিক্স গঠন আবিষ্কারে রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিনের তোলা এক্স-রে ছবি, যার নাম ফটো ৫১, ছিল সেই এক ধরণের অপ্রত্যাশিত তথ্য যা ওয়াটসন ও ক্রিককে সঠিক কাঠামো আঁকতে সাহায্য করেছিল। তবে এই তথ্য আদায়ের প্রক্রিয়াটি বিতর্কিত ছিল, এবং বইটি সেই বিতর্কটিকেও এড়িয়ে যায়নি।
ওয়াটসনের বিবরণ বরং নির্মোহ, অনেকক্ষেত্রে নিষ্ঠুরভাবে খোলামেলা। তিনি নিজের ও সহকর্মীদের সীমাবদ্ধতাও সামনে এনেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি পাঠককে শুধুই আবিষ্কারের মাহাত্ম্যে নয়, বরং বিজ্ঞানীদের স্বভাব-প্রবৃত্তি, রাজনৈতিক টানাপড়েন, লিঙ্গবৈষম্য, এমনকি অহংবোধ সম্পর্কেও ভাবতে বাধ্য করে। রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিনের প্রতি ওয়াটসনের দৃষ্টিভঙ্গি, যা প্রায়শই অবজ্ঞার ছায়া ফেলেছে, তা আজকের পাঠকের কাছে অস্বস্তিকর হলেও সেই সময়ের বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলের সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে তুলে ধরে।
বইটির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো এর ভাষার সহজতা ও ব্যক্তিগততা। কোনো জটিল শব্দচয়ন নয়, বরং গল্পের মতো করে লেখা এই আত্মজৈবনিক রচনা বিজ্ঞানপ্রেমী কিশোর বা তরুণদের কাছে যেমন আগ্রহের, তেমনি একজন গবেষক বা অধ্যাপককেও ভাবনায় ফেলে দেয়। বইটি যেন একজন বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত ডায়েরি, যেখানে প্রতিটি বাক্যে লুকিয়ে আছে দ্বিধা, উত্তেজনা, হতাশা ও আশার আলপথ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বইটি একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পাঠ্য, বিশেষ করে আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের জন্য। আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে সাধারণত বিজ্ঞানকে শেখানো হয় একটি কঠোর, নিরাবেগ পদ্ধতি হিসেবে—যেন সব প্রশ্নের উত্তর নির্ধারিত, সব সমাধানের পথ জানা। কিন্তু এই বইটি বুঝিয়ে দেয় যে বিজ্ঞান মানে নিছক জ্ঞান নয়, বরং এটি মানবিক ও সৃজনশীল চর্চা। একজন বিজ্ঞানী ভুল করতে পারেন, দ্বিধায় ভুগতে পারেন, ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা স্বার্থ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন—এই সত্যগুলো জানলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভুল বা ব্যর্থতা নিয়ে দুঃখিত না হয়ে বরং আরও অনুপ্রাণিত হবে।
একজন পাঠক যখন ডিএনএ গঠনের এই আবিষ্কারগাথা পড়ে, তখন তিনি বুঝতে পারেন, বিজ্ঞানের পথ কখনো সরলরেখায় চলে না। বরং এটি এক ধরনের ঘূর্ণিপথ—যেখানে এক মুহূর্তে মনে হয় সঠিক পথে আছেন, আর পরের মুহূর্তেই সেই ধারণাটি ভেঙে পড়ে। ওয়াটসন ও ক্রিকের সেই আবিষ্কার আজ যতটা নিখুঁত মনে হয়, তাদের পথচলা ছিল ততটাই অনিশ্চয়তায় ভরা। এভাবেই “The Double Helix” বইটি আমাদের শেখায় যে আবিষ্কার মানে কেবল ফল নয়, বরং একটি মানসিক অভিযাত্রা।
বইটি নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও, একে পাশ কাটিয়ে যাওয়া চলে না। কারণ এটি কেবল ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের দলিল নয়, বরং এটি বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মনোভাবের প্রতিচ্ছবি—যেখানে বিজ্ঞানীকে দেখা হচ্ছে একজন বাস্তব মানুষ হিসেবে, না যে কেবল নিখুঁত গবেষক, বরং একজন দ্বিধাগ্রস্ত, আবেগপ্রবণ, কৌতূহলী ব্যক্তিত্ব। এই মনোভাব আমাদের দেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের আত্মবিশ্বাসী হতে শেখাতে পারে—নিজেদের স্বাভাবিক দুর্বলতাকে লুকিয়ে না রেখে সেটিকেই নিজেদের জার্নির অংশ হিসেবে মেনে নেওয়ার সাহস জোগাতে পারে।
একটি জাতির বিজ্ঞানমনস্কতা কেবল গবেষণার পরিমাণ বা প্রযুক্তির পরিপক্বতা দিয়ে মাপা যায় না। সেটি মাপা যায় এই দিয়ে যে, সেই জাতি কিভাবে বিজ্ঞানকে উপলব্ধি করে—মানবিক, সাহিত্যিক, আর সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে। “The Double Helix” বইটি সেই উপলব্ধির একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে। এটি আমাদের বিজ্ঞানীদের ইতিহাস জানার পাশাপাশি, তাদের স্বভাব, জীবনদর্শন এবং আবিষ্কারের রোমাঞ্চকে উপলব্ধি করতে শেখায়।
আজকের বাংলাদেশ, যেখানে বিজ্ঞানচর্চা নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এগিয়ে চলেছে, সেখানে এমন বইয়ের অনুবাদ ও আলোচনার প্রয়োজন আরও বেশি। পাঠাগারে বা পাঠ্যসূচিতে এই বই যুক্ত না হলেও, বিজ্ঞানমনস্ক তরুণদের হাতে তুলে দেওয়া উচিত “The Double Helix”–এর মতো রচনাগুলি। কারণ একটি গবেষণাপত্র হয়তো বিজ্ঞান শেখায়, কিন্তু একটি আত্মজৈবনিক গল্প বিজ্ঞান ভালোবাসতে শেখায়।
অতএব, যদি আমরা চাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিজ্ঞানচর্চায় নিছক পেশাগত পথ নয়, বরং আবেগ ও কল্পনারও সমান অংশীদার হোক, তবে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে এমন বই, যেখানে বিজ্ঞান নয় কেবল, বিজ্ঞানীর হৃদয়ও স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। “The Double Helix” সেই শিক্ষাই দিয়ে যায়—বিজ্ঞানের ইতিহাসকে শুধু তথ্য দিয়ে নয়, মানুষ দিয়ে বোঝার এক অনন্য সুযোগ।

Leave a comment