বুয়েট আলুমনি প্রফেসর এ. কে. এম. ফজলে হুসাইনের জীবনকাহিনি যেন এক টurbulence থেকে আরেক turbulence-এর মধ্য দিয়ে উদ্ভাবনের সন্ধানে ছুটে চলার গল্প। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশে। সুযোগ ছিল সীমিত, অবস্থা ছিল অনিশ্চিত; কিন্তু তাঁর কৌতূহল ছিল সীমাহীন। ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ—যা পরে BUET হয়—সেখানে তিনি শুধু একজন মেধাবী ছাত্রই ছিলেন না, বরং ছিলেন একজন সংগঠক, সম্পাদক ও তরুণ প্রকৌশলী, যার চোখের সামনে ছিল বড় পৃথিবীর স্বপ্ন। ছাত্রজীবনে তিনি BUET-এর ছাত্র সংসদের সভাপতি ও সম্পাদক হন, পত্রিকার সম্পাদক হয়ে লেখালেখি করেন, আবার নদী চলাচলের জন্য ডকইয়ার্ডে জাহাজ ডিজাইনও করেন। এই বহুমুখী অভিজ্ঞতা তাঁকে খুব ছোট বয়সেই একাধারে বিশ্লেষক, প্রকৌশলী ও মানবিক নেতৃত্বে রূপ দেয়।
নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে নৌযানের বাঁক, ঢেউ, তরঙ্গ—এই সব বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর তরল প্রবাহের প্রতি গভীর অনুভব তৈরি হয়। বইয়ের পাতায় যেটাকে আমরা fluid mechanics হিসেবে দেখি, তিনি তা হাতের স্পর্শে, চোখের সামনে, বাস্তব জলে দেখেছিলেন। অনেকেই বলেন, turbulence সম্পর্কে তাঁর অদ্বিতীয় intuition-এর সূচনা হয়েছিল সেখান থেকেই।
বাংলাদেশ থেকে স্ট্যানফোর্ডে যাওয়া তাঁর সময়ে ছিল প্রায় অসম্ভব স্বপ্ন। কিন্তু Fulbright স্কলারশিপ তাঁকে সেই পথ খুলে দেয়। স্ট্যানফোর্ডে গিয়ে তিনি প্রমাণ করেন—বাংলাদেশের প্রতিভা বিশ্বের সেরাদের সাথে সমান হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেখানে তাঁর গবেষণা এত উচ্চমানের ছিল যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের Eckhart Prize পান, যা অসাধারণ মেধার স্বীকৃতি। পরবর্তী সময়ে তিনি জনস হপকিন্সে গবেষণা করেন—যেখানে তরলযান্ত্রিকতার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যের ভেতর দিয়ে তাঁর ভাবনা আরও শাণিত হয়।
১৯৭১ সালে তিনি Houston বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন, এবং পরবর্তী চার দশকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ turbulence গবেষক হিসেবে পরিচিত হন। তরল প্রবাহে বসবাসকারী ছোট বড় ঘূর্ণি, তাদের ভাঙন, মিলন, বিক্ষিপ্ততা, এবং এর মধ্যে যে লুকানো নিয়ম বিদ্যমান—তিনি সবকিছু দেখেছেন গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। vortex reconnection, coherent structures, jet dynamics, wall-bounded turbulence—এসব ক্ষেত্রকে তিনি শুধু সমৃদ্ধই করেননি; অনেক ক্ষেত্রে নতুন পথও দেখিয়েছেন। তাঁর ছাত্র Jeong-এর সাথে করা Q-criterion আজ বিশ্বজুড়ে ভরবেগ প্রবাহ, এ্যারোডাইনামিক্স, আবহাওয়া মডেলিং, ইঞ্জিন ডিজাইন, কম্পিউটার সিমুলেশন—সবখানেই মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তরলযান্ত্রিকতার মতো কঠিন বিষয়ে ধারাবাহিক সফলতা অনেকের কাছেই বিস্ময়। কিন্তু যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছে, তারা বলে—তিনি যত বড় বিজ্ঞানী, তত বড় মানুষ। তিনি বলতেন—বিশৃঙ্খলার মধ্যেও সৌন্দর্য আছে, turbulence-এর মধ্যেও আছে লুকানো ছন্দ, আর প্রকৃত বোঝার মধ্যে আছে মানবিকতার স্পর্শ।
তাঁর গবেষণার স্বীকৃতি এসেছে বিশ্বের সর্বোচ্চ আসন থেকে। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সদস্য—যা একজন প্রকৌশলীর জীবনে সবচেয়ে বড় সম্মান। পেয়েছেন আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি, ASME, AIAA-র শীর্ষ পুরস্কার। জনস হপকিন্স তাঁকে তাদের Society of Scholars-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। তিনি দেখিয়েছেন—বাংলাদেশের তারুণ্য যদি মনোযোগ, গভীরতা ও দক্ষতা অর্জন করে, তবে তাদের পথও আন্তর্জাতিকভাবে উন্মুক্ত।
টেক্সাস টেকে তিনি বর্তমানে President’s Endowed Distinguished Chair হিসেবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিস্ময়ের বিষয়—এত দীর্ঘ গবেষণা জীবনের পরও তিনি থেমে যাননি। বরং তাঁর কাজ এখন ছড়িয়ে পড়েছে ন্যানোমেডিসিন, ড্রাগ ডেলিভারি, টিউমার মেকানিক্স, ও চিকিৎসা-প্রকৌশল মিলিত নতুন সব ক্ষেত্রে। তাঁর কাজের বিস্তৃতি আজও বিশ্বের গবেষণায় নতুন আলো যোগ করছে।
বাংলাদেশের নবীন গবেষক, প্রকৌশলী ও ছাত্রদের জন্য তিনি এক অবিচ্ছেদ্য অনুপ্রেরণা। তাঁর জীবন বলছে—আমাদের কোনো সীমা নেই। সীমা কেবল তখনই থাকে, যখন আমরা নিজেরা নিজেদের থামিয়ে দিই।
https://www.depts.ttu.edu/me/faculty/fazle_hussain/index.php
Muhammad Rafi
BUET Media & Communication Club
Samiha Mahbub
ফেসবুক থেকে সংগ্রহীত: https://www.facebook.com/share/1AGwSQJpbT

Leave a comment