পিএইচডি করার অভিজ্ঞতা অনেকটা দীর্ঘ ম্যারাথনের মতো। গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে কেবল পরিশ্রম করলেই হয় না, লাগে কৌশল, লাগে সহযাত্রী, আর লাগে নিজের ভেতরের শক্তিকে টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা। আমি যখন গবেষণায় ডুবে ছিলাম, তখন তিনজন ভিন্ন সুপারভাইজারের সঙ্গে কাজ করেছি। প্রত্যেকেই তাদের মতো করে সহায়তা করেছেন, কিন্তু একটা জায়গায় কেউই সতর্ক করেননি আমাকে—তিনটি ফাঁদ, যা আমার পুরো প্রজেক্টকেই প্রায় বিপথে ঠেলে দিয়েছিল। আজ সেই অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করতে চাই, যাতে তরুণ গবেষকরা একই ভুলে না পড়েন।
১️⃣ পরিকল্পনার অভাব — প্রথম এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক ফাঁদ
গবেষণার প্রথম দিকে আমার ভেতরে প্রবল উৎসাহ ছিল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতাম, কিন্তু কাজের ভেতরে কোনো সুসংগঠিত রূপরেখা ছিল না। মনে হতো ব্যস্ততাই যেন উৎপাদনশীলতা। একদিন দেখি অসংখ্য নোটবুক ভর্তি লেখা, ডজন ডজন পরীক্ষার ডেটা, অথচ একসুতোয় বাঁধা কোনো কাঠামো নেই।
এই বিশৃঙ্খলার মাঝেই বুঝলাম, পরিকল্পনা ছাড়া শ্রম কেবলই ছড়িয়ে যায়। গবেষণা তখন আর অগ্রগতির দিকে চলে না, বরং নিজেই নিজের জালে আটকে পড়ে।
সমাধান:
একজন স্থপতির মতো নিজের গবেষণাকে গড়ে তুলতে হয়।
- বড় কাজকে ছোট ধাপে ভাগ করা
- সাপ্তাহিক লক্ষ্য নির্ধারণ
- মাসিক অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ
- প্রতিটি ধাপকে মাইলফলক হিসেবে দেখা
যখন এই অভ্যাস গড়ে তুললাম, তখনই এল পরিবর্তন। বিশৃঙ্খলা কাটল, আর গবেষণা পেল একটি স্পষ্ট মানচিত্র।
২️⃣ নিঃসঙ্গতা — গবেষক জীবনের নীরব শত্রু
অনেকেই মনে করেন গবেষণা মানেই একাকী লড়াই। আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু দ্রুতই বুঝলাম, নিঃসঙ্গতা দৃষ্টিভঙ্গিকে সংকীর্ণ করে। নতুন ধারণা আসে না, বিকল্প পদ্ধতির সন্ধানও পাওয়া যায় না। একসময় নিজের অবস্থান নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়, আর হতাশা গ্রাস করে।
সমাধান:
আমি সচেতনভাবে নেটওয়ার্ক গড়তে শুরু করি—
- অনলাইন সেমিনারে অংশগ্রহণ
- লিঙ্কডইনে গবেষকদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া
- ছোট যৌথ প্রজেক্টে কাজ করা
এই যোগাযোগগুলোই আমার গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। অন্যের চোখে নিজের কাজকে দেখা মানে নতুন আয়নায় নিজেকে আবিষ্কার করা।
৩️⃣ মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তিকে উপেক্ষা — নিজেই নিজের বিরুদ্ধে লড়াই
বিশ্বাস করতাম, যত বেশি সময় কাজ করা যায় ততই সাফল্য বাড়ে। রাত জেগে ডেটা বিশ্লেষণ, ভোরে আবার শুরু—এটাই ছিল রুটিন। কিন্তু ফল হলো উল্টো—
- মনোযোগ হারালাম
- ভুল বৃদ্ধি পেল
- উৎপাদনশীলতা কমতে কমতে প্রায় শূন্যে নেমে এলো
তখনই শিখলাম, গবেষণায় টিকে থাকার প্রথম শর্ত হলো নিজের যত্ন নেওয়া।
- নিয়মিত বিরতি
- হাঁটাহাঁটি
- পর্যাপ্ত ঘুম
যখন ঘুমকে গুরুত্ব দিলাম, সকালবেলার কয়েক ঘণ্টাতেই আগের দিনের দ্বিগুণ কাজ হয়ে যেত। বিশ্রাম বিলাসিতা নয়; বৈজ্ঞানিক উৎপাদনের অপরিহার্য শর্ত।
শেষ কথা: পিএইচডি শুধু একটি ডিগ্রি নয়—একটি জীবনযাত্রা
আজ ফিরে তাকালে মনে হয়, একটি সফল পিএইচডি কেবল গবেষণা-প্রবন্ধ জমা দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি গড়ে তোলে এক ধরনের জীবনধারা—
- সঠিক পরিকল্পনা কাজকে সুশৃঙ্খল করে
- নেটওয়ার্কিং দৃষ্টিকে প্রসারিত করে
- আত্ম-যত্ন দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখে
বাংলাদেশের গবেষণা পরিবেশে অবকাঠামো ও সুপারভিশনের ঘাটতি থাকলেও, এই তিনটি অভ্যাস হতে পারে সাফল্যের প্রধান হাতিয়ার। কারণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে টিকে থাকতে হলে মেধার পাশাপাশি প্রয়োজন সঠিক অভ্যাস এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক শক্তি।
যে গবেষক এই তিনটি ফাঁদ এড়িয়ে চলতে পারেন, তিনি কেবল একটি থিসিস জমা দেন না—বরং গড়ে তোলেন এমন এক শক্ত ভিত, যা তাকে ভবিষ্যতের পুরো ক্যারিয়ারে এগিয়ে রাখে।

Leave a comment