চিকিৎসা বিদ্যা

আমাদের পাকস্থলী আসলে এক যুদ্ধক্ষেত্র

Share
Share

সকালবেলা। তুমি এখনো কিছু খাওনি। বাইরের পৃথিবী নিশ্চুপ, কিন্তু তোমার শরীরের ভেতর একটা অদ্ভুত শব্দ গুনগুন করছে। সেটা ক্ষুধা নয় বরং পাকস্থলীর সৈন্যদলের মৃদু সরবতা। তোমার পাকস্থলী তখনও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মানুষ ভাবে, পাকস্থলী কেবল খাবার হজমের জন্য। কিন্তু আসলে এটা এক জীবন্ত দুর্গ, যেখানে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ চলতে থাকে রাসায়নিক আর জীববৈজ্ঞানিক যুদ্ধ। এমন এক যুদ্ধ যা তুমি দেখতে পাও না, কিন্তু তোমার অস্তিত্বকে রক্ষা করে রাখে।

এই যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো বন্দুক নেই, কোনো বারুদ নেই। আছে কেবল অণু, এনজাইম, অ্যাসিড, ব্যাকটেরিয়া আর কোষ। তারা কেউ তোমার বন্ধু, কেউ শত্রু, কেউ আবার উভয় চরিত্রে অভিনয় করে। তোমার পাকস্থলীকে যদি এক মহাবীর হিসেবে কল্পনা করো তবে তার প্রথম অস্ত্র হলো Hydrochloric Acid, দ্বিতীয়টি Digestive Enzyme, আর তৃতীয়টি Mucus Barrier। এই তিন অস্ত্রই একে বাঁচায়, আবার একে বিপদেও ফেলে।

প্রতি বেলা খাবারের সঙ্গে তুমি নিজের অজান্তে হাজারো জীবাণু গিলে ফেলো। তোমার জিভের উপরে, দাঁতের ফাঁকে, বাতাসে ভাসা ধুলিকণায় অসংখ্য অদৃশ্য শত্রু তোমার খাদ্যের সাথে পাকস্থলীতে পৌঁছে যায়। কিন্তু একবার সেখানে পৌঁছানোর পরই শুরু হয় এক ভয়ংকর পরিশুদ্ধি প্রক্রিয়া। Hydrochloric acid তখন যেন একদম যুদ্ধ ঘোষণার মতো হুংকার দেয়।

এই অ্যাসিডের পিএইচ এত কম প্রায় ১.৫ থেকে ২, যে কোনো ইস্পাতের টুকরো রাখলেও তা ক্ষয়ে যাবে। অথচ সেই আগুনের ভেতরেও তোমার পাকস্থলীর কোষগুলো বেঁচে থাকে, কারণ তারা জানে এই যুদ্ধ জেতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

তবে সব শত্রুই তো সরল নয়। কিছু শত্রু যেমন Helicobacter pylori, তারা সরাসরি অ্যাসিডের মুখোমুখি হয় না। তারা বুদ্ধিমানের মতো mucus স্তরের নিচে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। সেখানে তারা একটি এনজাইম তৈরি করে, নাম urease, যা অ্যাসিডকে নিরপেক্ষ করে দেয়। এভাবে তারা পাকস্থলীর আস্তরণে গর্ত করে, ধীরে ধীরে তৈরি করে ulcer—একটা যুদ্ধক্ষেত্রের ভেতর রক্তক্ষরণ।

তবু পাকস্থলী থামে না। প্রতিদিন নতুন কোষ তৈরি হয়, পুরনো কোষ মরে যায়, নতুন কোষেরা আবার ঢাল তুলে দাঁড়ায়। যেন একটা চিরন্তন যুদ্ধ চলছে জীবনের পক্ষ আর মৃত্যুর বিপক্ষে।

যুদ্ধক্ষেত্রের একটা নিয়ম আছে: যত শক্তিশালী অস্ত্র, তত বেশি আত্মরক্ষার প্রয়োজন। পাকস্থলীর ভেতরের সেই আগুনে অ্যাসিড আসলে বুমেরাং-এর মতো; যদি একবার ভুল দিকে ঘুরে যায়, তবে নিজের টিস্যুকেই পুড়িয়ে দেয়। তাই প্রকৃতি সেখানে তৈরি করেছে mucus barrier, একটা পিচ্ছিল, অদ্ভুত স্তর, যেখানে কোষগুলো লুকিয়ে থাকে, যেন সৈনিকেরা ঢালের আড়ালে।

যখন কোনো কারণে (যেমন মানসিক চাপ, ঘুমের অভাব, বা NSAID ওষুধ) এই স্তর দুর্বল হয়ে যায়, তখন শুরু হয় অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়ংকর পর্ব। তখন অ্যাসিড নিজের সেনাদেরই আঘাত করে gastric mucosa পুড়ে যায়, দেখা দেয় জ্বালাপোড়া, ব্যথা, bleeding ulcer। এটা যেন এক বিদ্রোহ—নিজের ভেতরের যুদ্ধ নিজেরই বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ায়। তবুও, যুদ্ধ থামে না। পাকস্থলীর প্রতিটি সেল জানে, পরের বেলা খাবার এলেই আবার তাকে যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে হবে।

যখন তুমি একটা মিষ্টি খাও, বা এক কাপ কফি পান করো, তখন সেই স্বাদ আসলে শুধু জিভেই নয়, পাকস্থলীতেও পৌঁছায়। কারণ তোমার মস্তিষ্ক আর পাকস্থলীর মধ্যে আছে এক অদ্ভুত যোগাযোগ ব্যবস্থা brain-gut axis; যা নিয়ে আমি এর আগের কোন এক লিখনীতে লিখে এসেছি।

তোমার মন যদি শান্ত থাকে, পাকস্থলী নিঃশব্দে কাজ করে। কিন্তু তুমি যদি উদ্বিগ্ন হও, চিন্তিত হও, তবে পাকস্থলীর পেশিগুলো টানটান হয়ে যায়, secretion বদলে যায়, digestion থেমে যায়। এই মানসিক যুদ্ধও আসলে পাকস্থলীর এক অংশ, শরীর ও মনের মিলিত যুদ্ধক্ষেত্র।

তোমার পাকস্থলী দেখতে হয়তো ছোট্ট, বাঁকানো একটা থলের মতো, কিন্তু এর ভেতরকার জীবন এক বিরাট নগরের মতো ব্যস্ত। যেখানে প্রতিটি অণু, প্রতিটি এনজাইম, প্রতিটি ব্যাকটেরিয়ার আছে নিজস্ব ভূমিকা, কেউ নির্মাতা, কেউ বিধ্বংসী, কেউ গুপ্তচর।

এই নগরের ভেতরেই বসবাস করে কিছু উপকারী জীবাণু। তারা আমাদের হজমে সাহায্য করে, নির্দিষ্ট ভিটামিন তৈরি করে, আর পাকস্থলীর পরিবেশকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখে। কিন্তু প্রতিবার যখন বাইরের কোনো আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়া আসে যেমন, খাদ্যের সঙ্গে ঢুকে পড়া Salmonella, E. coli, বা Clostridium — তখন এই শান্ত নগর হঠাৎ এক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

এ লড়াই শুরু হয় অণুর স্তরে। তুমি সেটা টের পাও না, কিন্তু তোমার পাকস্থলীর কোষগুলো তখন জেগে ওঠে, Pattern Recognition Receptors (PRRs) নামের সেন্সরগুলো আক্রমণকারীদের উপস্থিতি শনাক্ত করে। তারপরই ছুটে আসে ইমিউন সিস্টেমের সৈন্যরা— macrophage, neutrophil, T-cell, আর cytokine নামের সংকেতবাহকরা।

এই কোষগুলো যেন শহরের পাহারাদার, যারা চিৎকার করে বলে— “শত্রু ঢুকেছে!”

এদিকে পাকস্থলীর ভেতরের ব্যাকটেরিয়ারা, যারা এতদিন হজমে সাহায্য করছিল, তারা নিজেদের অবস্থান ঠিক করে নেয়। কেউ লুকিয়ে পড়ে মিউকাস স্তরে, কেউ আবার নতুন এনজাইম বের করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়।

এই যুদ্ধে কোনো স্পষ্ট জয় নেই, প্রতিটি খাবারের সঙ্গে আবার নতুন সেনা আসে, নতুন লড়াই শুরু হয়। তোমার শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে কে জিতবে। যদি ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়, তবে সেই শত্রু ব্যাকটেরিয়া পাকস্থলীর প্রাচীরে গর্ত করে ফেলে, ulcer হয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। কিন্তু যদি ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয়, তবে তুমি কিছুই টের পাও না—যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় নিঃশব্দে, শরীর জিতে যায় অদৃশ্য লড়াইয়ে।

কখনও কখনও, এই যুদ্ধে নতুন খেলোয়াড় হিসেবে আসে ওষুধ। যেমন, তুমি যখন কোনো সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক খাও, সেটা শুধু তোমার অসুখ সারায় না, পাকস্থলীর ভেতরের শান্তিপ্রিয় জীবাণুগুলোকেও মেরে ফেলে দেয়। তখন হঠাৎ ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। যে জীবাণুগুলো আগে তোমার হজমে সাহায্য করত, তারা হারিয়ে গেলে পাকস্থলী হয়ে ওঠে অনিরাপদ, নতুন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত এক দুর্বল দুর্গ। ফলাফল— gastritis, bloating, indigestion, বা acid reflux। তুমি তখন ভাবো, “আমার শুধু গ্যাস্ট্রিক হয়েছে।” কিন্তু আসলে সেটা গ্যাস্ট্রিক নয়, এক চলমান যুদ্ধের প্রতিধ্বনি


মো. ইফতেখার হোসেন 
এমবিবিএস ১ম বর্ষ , কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ |
আগ্রহের ক্ষেত্র মূলত আচরণবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান ও অভ্যাসবিজ্ঞান।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফ্রি ইমেইল নিউজলেটারে সাবক্রাইব করে নিন। আমাদের নতুন লেখাগুলি পৌছে যাবে আপনার ইমেইল বক্সে।

বিভাগসমুহ

গবেষণার তথ্য ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানী.অর্গ নবীন প্রজন্মকে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

Contact:

biggani.org@জিমেইল.com

সম্পাদক: ড. মশিউর রহমান

Biggani.org connects young audiences with researchers' stories and insights, cultivating a deep interest in scientific exploration.

নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ইমেইল নিউজলেটার, টেলিগ্রাম, টুইটার X, WhatsApp এবং ফেসবুক -এ সাবস্ক্রাইব করে নিন।

Copyright 2024 biggani.org